Advertisement
Advertisement
Racism

ফর্সা না হলেই সাফল্য অধরা! কীভাবে ভারতে ছড়াল বর্ণবিদ্বেষের কুৎসিত অভিশাপ?

কেবল পাশ্চাত্যে নয়, ভারতেও বিষ ছড়িয়েছে বর্ণবিদ্বেষ।

Racism in India is the outcome of Colonialism। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:November 12, 2021 8:32 pm
  • Updated:March 6, 2022 5:11 pm  

বিশ্বদীপ দে: ‘গোরে রং পে না ইতনা গুমান কর, গোরা রং দো দিন মে ঢল যায়েগা।’ রাজেশ খান্নার লিপে কিশোর কুমারের কণ্ঠে এই আর্তি কি কেবল নায়িকা মুমতাজের প্রতি? নাকি তা আসলে বর্ণবিদ্বেষের বিষ থেকে বিরত থাকার আরজি। গীতিকার কী ভেবে গানটি লিখেছিলেন তা নিয়ে তর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু ভারতীয় পপুলার কালচারে বারবার ফিরে এসেছে এমন প্রসঙ্গ। ঘনিয়েছে বিতর্ক। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ (Black lives matter) কেবল পাশ্চাত্যের সমস্যা নয়। এদেশের হাওয়া-জলেও মিশে আছে বর্ণবিদ্বেষ (Racism)। আপাত ভাবে মনে হতেই পারে, ধর্ম কিংবা জাতিগত বিদ্বেষের মতো এদেশে ততটা ভয়াবহ ছোবল দিতে পারেনি ‘রেসিজম’। কিন্তু সেই তুলনামূলক বিশ্লেষণে না গিয়েও বলা যায় এদেশে গায়ের রং নিয়ে বিদ্বেষের হিসেব কষতে বসলেও চোখ কপালে উঠতে বাধ্য।

কীভাবে বা কবে থেকে এই বৈষম্যের সূত্রপাত, সে আলোচনা নিশ্চয়ই হবে। তবে তার আগে মনে করা যাক সেই বিজ্ঞাপনগুলির কথা যেখানে প্রকট হয়ে উঠতে দেখা গিয়েছে বর্ণবিদ্বেষ। এক জনপ্রিয় প্রসাধনী ক্রিমের মূল বক্তব্যই ছিল, ফর্সা ইজ ইকুয়াল টু সাফল্য। এই ধরনের বিজ্ঞাপনে একটা খুব চেনা ছক আছে। শুরুতে একটি মেয়েকে দেখা যায়, যার গায়ের রং শ্যামলা। মেয়েটি বিমর্ষ। জীবনে কোনও একটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও সে। সেই সময় তার এক ফর্সা বান্ধবী তার হাতে তুলে দেয় সেই ক্রিম। তারপর স্ক্রিন জুড়ে পর্যায়ক্রমে মেয়েটির উজ্জ্বল বর্ণের এক সফল মানুষ হয়ে ওঠার কাহিনি। দেখলে মনে হবে যেন মেয়েটির মুখের উপরে অতিকায় হ্যালোজেনের আলো জ্বেলে দিয়েছে কেউ।

Advertisement
Black-lives-matter
জর্জ ফ্লয়েডের নির্মম হত্যা জন্ম দিয়েছিল ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের

[আরও পড়ুন: ফের শহরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, তপসিয়ার বাসস্ট্যান্ডের কাছে আগুন লাগায় ছড়াল তীব্র চাঞ্চল্য]

কেবল মেয়েরাই নয়, ছেলেদেরও টার্গেট করা হয়েছে। একটি বিজ্ঞাপনে মেয়েদের কাছে পাত্তা না পাওয়া এক কৃষ্ণবর্ণের যুবকের উদ্দেশে শাহরুখ খানকে বলতে শোনা যায়, ”সির্ফ পোজ মারোগে তো কান্ধা বনকে রহে যাওগে। হ্যান্ডসাম বন, বান্দা বন।” অর্থাৎ সরাসরি বলেই দেওয়া হচ্ছে, ফর্সা না হলে মানুষ বলেই গণ্য করা যাবে না! স্বাভাবিক ভাবেই এই ধরনের রুচিহীন বিজ্ঞাপন যে সমাজে তৈরি হয়, সেখানে এমন বক্তব্য বা মানসিকতা যে মোটেই প্রক্ষিপ্ত নয় তা বলাই যায়। ভেবে দেখলে নিজেদের অভিজ্ঞতাতেই এমন উদাহরণের স্মৃতি মনে পড়তে বাধ্য। পাড়ার জেঠিমা-কাকিমাদের আসর হোক কিংবা বয়স্কদের তাসের আসর, ‘মেয়েটির মুখশ্রী ভালই, কেবল গায়ের রং একটু চাপা’ এমন সংলাপ কান পাতলেই শোনা যায়। ‘এবার একটা ফর্সা টুকটুকে বউমা’ নিয়ে আসার পরামর্শও এই নতুন সহস্রাব্দে আকছার পান বহু এলিজেবল ব্য়াচেলারও। সুতরাং শিকড়ে মিশে থাকা বিষের অনুসন্ধান খুব কঠিন কিছু নয়।

সেই সাতের দশকের ‘গোরা অউর কালা’ ছবিতে সুদর্শন রাজেন্দ্র কুমারের ভাই হিসেবে দেখা গিয়েছিল সমদর্শী আরেক রাজেন্দ্রকুমারকে। তিনি কৃষ্ণবর্ণের এক পুরুষ। খল চরিত্রের আদলই ছিল তাঁর মধ্যে। বাংলা ছবিতেও ‘ছায়াসূর্যে’র মতো উদাহরণ রয়েছে। সেই ছবির মূল সূত্রই আবর্তিত হয়েছে ঘেঁটুকে ঘিরে। শ্যামলা রঙের সেই মেয়ের চরিত্রে শর্মিলা ঠাকুরের অনবদ্য অভিনয় বাঙালি দর্শক ভোলেনি। কীভাবে সুন্দরী দিদির কালোকোলো সরলমতি বোন ঘেঁটু ছিল তার নামের মতোই। ঘেঁটুফুলের তুচ্ছতা আরোপ করে দেওয়া হয়েছিল তার উপরে। এর অন্যতম কারণই ছিল তার গায়ের রং।

Bengali Movie
‘ছায়াসূর্য’ ছবির ঘেঁটুকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন শর্মিলা

[আরও পড়ুন:দাউদ ঘনিষ্ঠ গ্যাংস্টারের স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠল হার্দিক পাণ্ডিয়ার বিরুদ্ধে]

এমন উদাহরণ আরও রয়েছে। ‘কালো তা সে যতই কালো হোক’, একথা যতই বলুন রবীন্দ্রনাথ, বাঙালি তথা ভারতীয় জনমানস বিষয়টাকে মোটেই অত হালকাভাবে বিষয়টিকে নেয়নি। স্রেফ গায়ের রঙের কারণে বারবার লাঞ্ছনার মুখে পড়তে হয়েছে বহু মানুষকে। হ্য়াঁ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের হয়তো বেশি করে এই সমস্যায় বেশি ক্ষতবিক্ষত হতে হয়েছে। কিন্তু তা বলে ছেলেরাও রেহাই পায়নি মোটেই।

মনে পড়ে গত বছরের কথা। করোনা সংক্রমণে অস্থির পৃথিবীতে নতুন করে শুরু হয়েছিল কালো মানুষদের আন্দোলন। মার্কিন মুলুকের মিনেসোটায় জর্জ ফ্লয়েডের নির্মম হত্যাকে ঘিরে শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে শুরু হয় ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’। ঠিক সেই সময়ই ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার ড্যারেন সামিও অভিযোগ করেন এদেশে আইপিএল খেলতে এসে ‘সানরাইজার্স হায়দরাবাদ’ দলে তাঁর সতীর্থদের থেকে একটি নাম পেয়েছিলেন তিনি। কাল্লু। মূলত তাঁকে ও শ্রীলঙ্কার থিসারা পেরেরাকে এই নামেই ডাকতেন ইশান্ত শর্মা, ভুবনেশ্বর কুমাররা। কিন্তু সেই সময় সামি সেটা বুঝতে পারেননি। পরে আসল সত্যিটা জানতে পেরেও যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না তাঁর। রাগে ফেটে পড়তে পড়তেও সামির এক উক্তি সত্যিই মনখারাপ করে দেওয়া। ”আমি তো তোমাদের ভাইয়ের মতো দেখতাম।”

Darren Sammy
ড্যারেন সামির অভিযোেগে আইপিএলেও লেগেছিল বর্ণবৈষম্যের কলঙ্ক

বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ সামির হতাশাই তুলে ধরে আসল ছবিটা। আমেরিকান কিংবা ব্রিটিশদের দেখলেই আজও ভারতীয়রা গলে যায়। অথচ আফ্রিকান কিংবা অন্য কোনও মহাদেশের কৃষ্ণাঙ্গ এদেশে এলে তাঁরা সাহেবের মর্যাদা পান না। হয়ে ওঠেন কাল্লু। ঠিক যেমন উত্তরপূর্ব ভারতীয়দের দেখলে ‘চিঙ্কি’, ‘মোমো’র মতো বাছাই বিশেষণ প্রয়োগের অভিযোগ ওঠে। কেবল কটাক্ষেই থেমে থাকে না বিষয়টা। বহু ক্ষেত্রে ঘিরে ধরে গণলাঞ্ছনা থেকে শুরু করে আরও ভয়ানক পরিণতির উদাহরণ ভূরি ভূরি।

আসলে এই যে সাহেবদের দেখলেই গদগদ হওয়া কিংবা কালো সাহেবের প্রতি কটূক্তি- এর মূলে রয়েছে ঔপনিবেশিকতা। ঔপনিবেশিকতা অনেক কিছুই বদলে দিয়েছিল। কেননা মানব সভ্যতার ইতিবৃত্তে এই প্রথম এমন হানার ঘটনা ঘটল যেখানে লুণ্ঠনকারীরা লুঠ করেই পালিয়ে গেল না। উলটে সেখানেই মৌরসী পাট্টা গেড়ে বসল। আর ঠিক সেই কারণেই সাংস্কৃতিক পার্থক্যের ফলে ধীরে ধীরে জন্ম নিল তীব্র বৈষম্যের। আজ যখন আফ্রিকার কালো মানুষদের দেখে ‘কাল্লু’ বলে অপমান করে বসেন কোনও ভারতীয়, তিনি আসলে যেন প্রথম বিশ্বের এক শ্বেতাঙ্গরই প্রতীকী স্বরূপ হয়ে ওঠেন।  

Racism
বর্ণবৈষম্যের ভাইরাস থেকে কবে মুক্ত হবে পৃথিবী?

সুতরাং একথা বলাই যায় যে, ভারতের মতো দেশে বর্ণবৈষম্যের এই ধারা খুব বেশিদিনের নয়। যদিও অনেককে বৈদিক সমাজে বহুল প্রচলিত বর্ণাশ্রমের কথা বলে দাবি করতে দেখা যায়, বর্ণের ভিত্তিতে শ্রেণিভাগ বহু আগে থেকেই এদেশে ছিল। কিন্তু একথা একেবারেই ভিত্তিহীন। প্রাচীন ভারতের ‘বর্ণ’ হল শ্রেণি। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র- এই বিভাজনের সঙ্গে গায়ের বর্ণের কোনও দিক থেকেই কোনও সম্পর্ক নেই। প্রাচীন ভারতে গায়ের রঙের কারণে বিদ্বেষের জন্ম হওয়ার নিদর্শন সেই অর্থে নেই। প্রাক-ঔপনিবেশিক সময়কালে দাস প্রথার প্রচলন থাকলেও তার সঙ্গে গায়ের রঙের কোনও সম্পর্ক নেই। দেখা গিয়েছে, ঔপনিবেশিকতা গোটা পৃথিবীর ইতিহাসকে প্রভাবিত করতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই জাতপাত, ধর্মের মতোই গায়ের রঙের ভিত্তিতেও মানুষকে ‘অপর’ করার বৈষম্য শুরু হয়। 

ইংরেজরা চলে গিয়েছে ঢের দিন হল। তাদের পুঁতে যাওয়া বিষচারা এতদিনে বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। অন্যান্য বহু সমস্যার মতোই ভারতীয় সংস্কৃতিতে গেঁথে গিয়েছে স্রেফ গায়ের রঙের কারণে কোনও মানুষকে অবদমিত করে রাখার বিশ্রী প্রবণতার। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির বছরে পৌঁছে কি তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজব না আমরা? সেই পথের খোঁজ কিন্তু ঘর থেকেই শুরু করতে হবে আমাদের। বিষ যে থমকে রয়েছে শিকড়ে!

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement