সৌরভ দত্ত: একদিকে মা, দাদা। অন্যদিকে ডাক আমজনতার। খাসতালুক ধরে রাখার লড়াই তো বটেই। আবার সুর অটুট রেখেই ‘নয়া দিশা’য় দেশ বাঁচানোরও ‘সংগ্রাম’। দেশের ‘নয়া দিশারী’ হতে এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন রাহুল। প্রশ্রয় তাঁর যতই থাকুক, ময়দানে থেকেও আড়ালেই সোনিয়া। তাই পরিবার থেকে দেশ, জোড়া দায় একাই যেন কাঁধে তুলে নিয়ে আমেঠি আর রায়বরেলি চষে বেড়াচ্ছেন সোনিয়া-তনয়া প্রিয়াঙ্কা গান্ধী৷
প্রচারের এই শেষ প্রহরে উত্তরপ্রদেশ ছাড়িয়ে তামাম দেশের নজরবন্দি হাই প্রোফাইল জোড়া কেন্দ্র আমেঠি আর রায়বরেলি। আর সেই তল্লাটেই গ্রাম ছাড়িয়ে গঞ্জ, আবার শহরেও গলি থেকে রাজপথে ছুটে চলেছেন প্রিয়াঙ্কা। মুখোমুখি বসে কথা বলার সময় কই তাঁর! বৃহস্পতিবার সকাল গড়িয়ে দুপুর সেই কনভয়ে ছুটে বেড়িয়েও ফুরসত মেলেনি। অবশেষে শুক্রবার ভরা দুপুরে মুখোমুখি প্রিয়াঙ্কা। হাতে মাত্র কয়েক মিনিট।
হাইওয়ে লাগোয়া হরদাসপুর ছাড়িয়ে নেতাই অজগ্রাম চৌপল। গাছের ছায়ায় সেখানেই ‘নুক্কড় সভা’য় প্রিয়াঙ্কা ‘অকপট’। তুমুল উচ্ছ্বাস আর অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে কংগ্রেসের এই ‘নয়া আইকন’ যখন গাড়িতে, ততক্ষণে সংবাদ শিকারিরা এসপিজির-র ঘেরাটোপে। কোনওরকমে টপকে প্রিয়াঙ্কার গাড়ির জানালায় একা, ইতিউতি কয়েকজন।
প্রশ্ন: প্রচার একেবারে শেষ পর্যায়ে। আমেঠি, রায়বরেলির হাওয়া তবে কোনদিকে?
প্রিয়াঙ্কা: গোটা উত্তরপ্রদেশ ঘুরেছি। গত কয়েক দিন ধরে রয়েছি রায়বরেলি ও আমেঠিতে। একটাই ছবি, মানুষ আমাদের পক্ষে। কৃষকের আয় বাড়েনি, অর্ধেক হয়েছে। চাকরি পায়নি বেকাররা। মহিলা থেকে পুরুষ – ভাল নেই কেউই। মানুষ বিলক্ষণ বুঝছেন ভাজপা সরকারের ‘ভাঁওতা’। আর এ তল্লাটের মানুষ জানেন, এই গোটা এলাকার স্থান সবসময়ই আমাদের পরিবারের হৃদয়ে। মা’র হয়ে বা দাদার তরফে যেখানেই যাচ্ছি, বিপুল সাড়া। জিতব আমরাই।
প্রশ্ন: মোদিজি তো বলছেন কৃষক থেকে আমজনতা, সবস্তরেই অগ্রগতি হয়েছে। তাই আবার চাই ‘ভাজপা সরকার’…
প্রিয়াঙ্কা: (থামিয়ে দিয়ে) হ্যাঁ। তরক্কি (অগ্রগতি) হয়েছে, তবে তা শুধু ‘বিজ্ঞাপন’-এ। বাস্তবে নয়। চাষির হাল দেখুন। ফসলের দাম নেই। সেচ নেই। কোনও সহায়তা নেই। রাতভর খেতে চৌকিদারি করেও তার পেট ভরছে না। আর উনি নিজেকে দেশের ‘চৌকিদার’ বলে জাহির করছেন। এসবের জবাব মিলবেই।
প্রশ্ন: ফসল বিমার প্রকল্প তো চালু হয়ে গিয়েছে?
প্রিয়াঙ্কা: কিন্তু সেই টাকা পাচ্ছে কে? চাষিরা ওই বিমার নামে যে টাকা দিচ্ছেন, সেই টাকা লুটে নিয়ে বিজেপি ঘনিষ্ঠ উদ্যোগপতিরা ১০ হাজার কোটি টাকার মুনাফা করছেন। কিন্তু জমি আর চাষ নিয়ে বিপাকে পড়েও চাষিরা কোনও সাহায্যই পাচ্ছে না। আওয়াজ তুললেই ভাজপা নেতারা দমিয়ে দিচ্ছেন। বলছেন, অত টাকা সরকারি খাতে নেই। কিন্তু বলুন তো মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়ে কংগ্রেসের সরকার তাহলে চাষির ঋণ মকুব করে বিমার টাকা দিচ্ছি কী করে?
প্রশ্ন: তাহলে ‘বিকল্প’ কী?
প্রিয়াঙ্কা: বিকল্প হল ‘ন্যায় প্রকল্প’। ঋণ না মেটালেও চাষির উপর মামলা না চাপিয়ে দেওয়ার বিধি চালু করা। গ্রামগঞ্জে লক্ষাধিক রোজগার। চাষির ঘরে বছরে ৭২ হাজার টাকার সংস্থান। এসবই কংগ্রেসের ইস্তাহারে বলা হয়েছে। সবাই দেখেছে মোদি কী করেছেন। এবার আর মোদি নয়, কংগ্রেসকেই চায় জনতা।
প্রশ্ন: এরপরও যদি কংগ্রেস জয়ী না হয়?
প্রিয়াঙ্কা: (থামিয়ে) ধরার কোনও প্রশ্নই নেই। আমরাই জিতব। আমি যত ঘুরছি, ততই মানুষের মনের আভাস যেন আরও স্পষ্ট টের পাচ্ছি। ভাজপার মিথ্যা প্রতিশ্রুতির জারিজুরি ধরে ফেলেছে জনতা। তাই শুধু মোদিজি আর ভাজপা নেতারাই হয়তো সেটা বোঝেননি।
প্রশ্ন: কিন্তু আমেঠিতে তো স্মৃতিজি (ইরানি) রীতিমতো আওয়াজ তুলেছেন ‘সাংসদ লা পাতা’! কী জবাব দেবেন?
প্রিয়াঙ্কা: স্মৃতিজির সঙ্গে আগেও তো অনেকবার কথা হয়েছে। উনি আগেও এই এলাকায় লড়েছেন। উনি তো জানেন আমেঠির রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে চাষিদের সেচের ব্যবস্থা, একের পর এক সেতু এবং আরও অনেক কাজ ‘রাহুলজি’ গত পাঁচ বছরে তো বটেই, তার আগেও করেছেন। উনি যদি ‘লা পাতা’ই হন তাহলে কাজ হল কী করে? পালটা স্মৃতিজিকেই জিজ্ঞাসা করুন না উনি কী করেছেন? আর কেনই বা রাহুলজির পরিকল্পনা অনুযায়ী চালু কাজও এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে?
প্রশ্ন: বিজেপি তো প্রশ্ন তুলছে আপনি রাজনীতিতে ততটা ইচ্ছুকই নন। তাই ভোটেই লড়লেন না।
প্রিয়াঙ্কা: কাজের কথা না বলে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ কথাবার্তা বলাই ভাজপা নেতাদের রীতি। গোটা দেশের আমজনতার ইস্যু বাদ দিয়ে, ওরা এখন এসব অবান্তর বিষয় তুলছেন। আসলে ওদের তো আর বলার মতো কিছু নেই৷ আমি যদি রাজনীতিতে নাই আসতে চাই, তাহলে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিলাম কেন? কেনই বা এতদিন ধরে পড়ে থেকে কংগ্রেসের প্রচার করছি? এগুলি দেখে সত্যি আপনাদের মনে হচ্ছে যে রাজনীতিতে আমার ‘রুচি’ নেই?
প্রশ্ন: সারা দেশে কংগ্রেসের ফলাফল কেমন হবে বলে মনে করেন?
প্রিয়াঙ্কা: এখনই এ বিষয়ে আগাম মন্তব্য করাটা সমীচীন হবে না। তবে আমি নিশ্চিত কংগ্রেসের জয় হবেই।
(গড়িয়ে চলতে থাকা গাড়ির জানালায় ততক্ষণ এই প্রতিবেদক। এসপিজি কর্মীরা তো পারলে তখনই ঘাড়ধাক্কা দেন। ভাগ্যিস চালককে গাড়ি একদম আস্তে চালাতে বললেন প্রিয়াঙ্কা। না হলে অঘটন ঘটতেই পারত। চলতে চলতেই আবার)
প্রশ্ন: বাংলায় এবার কংগ্রেসের ফল কী হবে বলে মনে হয়?
প্রিয়াঙ্কা: আমি তো বাংলায় যাইনি। কাজেই বাংলার হালচাল, বিশেষত ভোট নিয়ে বলতে পারব না। তবে, বাঙালি ঐতিহ্য এবং বাংলার সংস্কৃতিকে আমি এবং আমার গোটা পরিবার ভীষণই শ্রদ্ধা করি। গোটা দেশের মধ্যে বাংলার আসন, অবস্থান অন্য মাত্রা বহন করে।
প্রশ্ন: গোটা দেশে ‘মোদি-বিরোধী’ লড়াইয়ে কংগ্রেস ও অন্য দলের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলার তৃণমূল কংগ্রেসও এককাট্টা। কিন্তু বাংলায় তো ‘কংগ্রেস’ ও ‘তৃণমূল’ এখন দুই মেরুতে।
প্রিয়াঙ্কা: (একটু থেমে) এটা ঠিক যে বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে লড়াই হচ্ছে টিএমসির। কিন্তু নেত্রী হিসাবে আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শ্রদ্ধা করি, সম্মান করি।
প্রশ্ন: মোদি-বিরোধী জোটের জয় প্রসঙ্গে নয়া প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। মমতাজি ‘প্রধানমন্ত্রী’ হতে পারেন বলে মনে করেন?
প্রিয়াঙ্কা: এখন এই বিষয় নিয়ে আলোচনার কোনও মানে হয় না। কারণ সবার আগে লক্ষ্য: মোদি তথা ভাজপাকে হারানো। সেই লক্ষ্যপূরণের পর বিরোধী জোটে থাকা সব দলের নেতারা নিশ্চয়ই আলোচনায় বসবেন। প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, বা হতে পারেন সেটা তো তখনকার আলোচনার বিষয়। তেমন পরিস্থিতি হলে নিশ্চয়ই আলোচনা করেই কারও নাম ঠিক হবে।
পরের প্রশ্ন করার আর অবকাশ মিলল না। একরাশ হাসি ছড়িয়ে প্রিয়াঙ্কার আরজি ‘অব ছোড়িয়ে, প্লিজ…’। আশপাশে ছড়িয়ে থাকা জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে কাচ তুলে দিলেন কংগ্রেসের নয়া ‘আইকন’। নিমেষেই গতি পেল দুধসাদা এসইউভি। প্রচারে প্রিয়াঙ্কার পরবর্তী মহারাজগঞ্জ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.