লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে নানা কিসসা-কাহিনি পর্বে পর্বে সংবাদ প্রতিদিন ডট ইনে। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর ‘মৃত্যুরহস্য’ থেকে ইন্দিরা গান্ধীর ‘জেলযাত্রা’, জ্যোতি বসুর ‘ঐতিহাসিক ভুল’ থেকে মোদির ‘রাজধর্ম পালন’- ফিরে দেখা হারানো সময়। লিখছেন বিশ্বদীপ দে।
একটি বিমান। যার ভিতরে অতলান্ত নীরবতা। দিনটা ভারতের ইতিহাসের এক কালো দিন। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর। দেহরক্ষীর ১৬টি বুলেটে ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সেই সময় মেদিনীপুরের কাঁথির জনসভায় এআইসিসি সাধারণ সম্পাদক রাজীব গান্ধী। মঞ্চে তাঁর ঠিক পাশেই ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। কেন্দ্রের ক্যাবিনেটের দুনম্বর ব্যক্তি। দুঃসংবাদ পেয়ে একই বিমানে ফিরছিলেন তাঁরা। যদিও রাজীব ছিলেন ককপিটে। প্রণবের সঙ্গে ছিলেন গনি খান চৌধুরী। তৎকালীন রেলমন্ত্রী। তিনি ও বাকিরা আলোচনা করছিলেন কে প্রধানমন্ত্রী হবেন তা নিয়ে। আলাদা করে সেই আলোচনায় যোগ দেননি প্রণব। ইন্দিরার অসম্ভব অনুরাগী মানুষটি তখনও বিশ্বাসই করতে পারছেন না কী ঘটে গিয়েছে।
পরিস্থিতি এমনই, মাতৃশোকে আকুল হতে হতেও নিজেকে সামলাচ্ছিলেন রাজীব। সেই সময় তিনি কিন্তু মন্ত্রিসভার সদস্য নন। তবু তাঁরই মসনদে বসার সম্ভাবনা সবচেয়ে জোরালো। শোনা যায়, এই সময়ই নাকি মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় সদস্য হিসেবে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ‘ইচ্ছাপ্রকাশ’ করেছিলেন প্রণব (Pranab Mukherjee)। যা মোটেই ভালোভাবে নেননি রাজীব। যে কারণে রাজীবের মন্ত্রিসভা থেকে তাঁকে বাদও পড়তে হয়। প্রণবের জায়গায় অর্থমন্ত্রী হন ভি পি সিং।
কিন্তু সত্যিই কি ইন্দিরার আকস্মিক প্রয়াণের পর কুরসিতে বসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন কীর্ণাহারের কংগ্রেস নেতা? ‘দ্য টার্বুলেন্ট ইয়ার্স, ১৯৮০-১৯৯৬’ বইয়ে প্রণব পরিষ্কার দাবি করেন, এটা একেবারেই গুজব। তিনি মোটেই প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি। এমনকী, প্রণবকন্যা শর্মিষ্ঠা ‘প্রণব মাই ফাদার’ বইয়ে এই দাবিও করেন, রাজীবকে (Rajiv Gandhi) কুরসিতে বসাতেই চেয়েছিলেন প্রণব।
কিন্তু রাজীবের কানে অন্য কথাই পৌঁছেছিল। তাঁকে বোঝানো হয় প্রণবই প্রধানমন্ত্রী হতে চাইছেন। ফলশ্রুতি রাজীবের নতুন মন্ত্রিসভা থেকেই আগের অর্থমন্ত্রীর ছিটকে যাওয়া। ব্যাপারটা বিশ্বাসই করতে পারেননি প্রণব। গোপন সূত্রের মাধ্যমে কোনও খবর আসেনি। এমনকী কোনও গুজবও তাঁর কানে আসেনি। স্ত্রীর সঙ্গে বসে টিভিতে নতুন মন্ত্রীদের শপথ নেওয়া দেখেছিলেন হতভম্ব অবস্থায়। বিমর্ষ মনে এর পর পরিবারকে নিয়ে বেড়াতে চলে যান। এর পর কয়েক মাসের মধ্যে একটি পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইন্দিরার সরকারের সঙ্গে রাজীবের প্রশাসনের তুলনা করার সময় নয়া সরকারকে নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে ফেললেন। স্বাভাবিক ভাবেই এর পর আরও বড় ‘শাস্তি’ দেওয়া হয় তাঁকে। ৬ বছরের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। অগত্যা নতুন দল রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস গঠন করেন প্রণব। যদিও পরের বছর বিধানসভা নির্বাচনে বিশ্রী ভাবে হারেন তাঁর দলের প্রার্থীরা। তবু কংগ্রেসের বহু ভোট ‘কাটতে’ সক্ষম হয়েছিলেন তাঁরা।
তবে শেষ পর্যন্ত বরফ গলতে শুরু করে। আসলে রাজীব গান্ধী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মতো একজন বিচক্ষণ কৌশলীকে ‘মিস’ করতে শুরু করেছিলেন। কেন ইন্দিরা এমন গুরুত্ব দিতেন মানুষটিকে, সেটা শেষপর্যন্ত পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল তাঁর কাছে। ফলত, দলে ফেরানো হয় প্রণবকে। মূল কংগ্রেসে মিশে যায় রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস। ১৯৮৯ সালের ভোটে কংগ্রেসের হারের পর আবারও গুরুত্ব ফিরে পেতে থাকেন প্রণব। ১৯৯১ সালে তাঁকে প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান করা হয়। দ্রুত হারানো সমীহ পেতে শুরু করেন তিনি।
আসলে প্রণবের রাজনৈতিক কেরিয়ার কিন্তু এমনই নাটকীয়তায় ভরা। বাবা কংগ্রেস নেতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী কামদাকিঙ্কর। প্রণব প্রত্যক্ষ রাজনীতি শুরু করার অল্প সময় পরই অজয় মুখোপাধ্যায় (যিনি সেই সময় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী)-সহ বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের সুনজরে পড়েন। ১৯৬৯ সালে রাজ্য়সভার সাংসদ হওয়া। আর তার পরই ইন্দিরা গান্ধীর (Indira Gandhi) নজরে পড়ে যাওয়া। আমৃত্যু সেই ভালোবাসা পেয়েছেন প্রণব। ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন বিশ্বাসভাজন। ১৯৭৩ সালেই প্রথমবার মন্ত্রিসভায় প্রবেশ। গুরুত্ব বাড়তে বাড়তে অর্থমন্ত্রী। মাঝে ‘এমার্জেন্সি’র অস্থির সময়ও ইন্দিরার সঙ্গ কিন্তু ছাড়েননি প্রণব। আশঙ্কা করেছিলেন, তিনিও গ্রেপ্তার হবেন। বইপত্র, পাইপ, তামাক গুছিয়ে তৈরিও হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাঁর কাছে আসেনি। ইন্দিরার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ ছিলেন। যখন যেটা তাঁর অফিস, সেখানে অবশ্যই রাখা থাকত ইন্দিরার একটি ছবি।
যাই হোক। লেখার মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। তিনি রাজীবের জায়গায় দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন কিনা সেটা পরের কথা। কিন্তু সেই আকস্মিক মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী হতেই পারতেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। একই সুযোগ ছিল ২০০৪ সালেও। কিন্তু সেবার দেশের মসনদে বসানো হল মনমোহন সিংকে। অথচ খোদ মনমোহনই বলেছেন, প্রণব যোগ্যতর প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। এবং সেটাও এক সভায়। দর্শকাসনে ছিলেন সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী। মঞ্চে তাঁর পাশেই বসেছিলেন প্রণব। তাঁরই আত্মজীবনীর একটি খণ্ড প্রকাশের অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে মনমোহন সিং পরিষ্কার বলেন, ‘‘তাঁকে যে প্রধানমন্ত্রী করা হয়নি, এতে ক্ষোভ থাকতেই পারে প্রণববাবুর। তিনি যোগ্যতর প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার কিছু করার ছিল না! উনি এটা জানেনও।’’
কিন্তু কেন? কেন প্রণবকে দেওয়া হয়নি কুরসি? সোনিয়া জানিয়েছিলেন ‘অন্তরাত্মার আহ্বানে’ তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন না। যদিও শোনা যায়, পুত্র রাহুলই নাকি মাকে মসনদে বসতে দেননি। ফলে ভেসে উঠছিল প্রণবের নাম। কিন্তু তাঁকে সন্তুষ্ট থাকতে হল অর্থমন্ত্রী হয়েই। প্রতিরক্ষা ও বিদেশ মন্ত্রকও তাঁকে সামলাতে হয়েছে মনমোহন সরকারের ক্যাবিনেটে থাকাকালীন। এর পর ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি হয়ে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া। এটা সত্যিই আশ্চর্যের বিষয়। অর্থ, বিদেশ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রক, প্ল্যানিং কমিশনের দায়িত্ব থেকে একেবারে রাষ্ট্রপতি! গান্ধী পরিবারের এত ঘনিষ্ঠ হয়েও তবু প্রধানমন্ত্রিত্বের আসনটি অধরা রয়ে গেল কীর্ণাহারের বঙ্গসন্তানের। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, নতুন সহস্রাব্দের একেবারে শুরুর সেই সময়ে গোটা দেশেই প্রণবের একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছিল। ফলে তাঁর মতো প্রভাবশালী থাকলে রাহুল গান্ধী সেই ছায়ায় ঢাকা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই কারণেই নাকি মনমোহনকে বেছে নেওয়া হয়।
প্রণব নিজেও জানিয়েছিলেন, ইউপিএ সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী না হওয়ায় তাঁর আক্ষেপ নেই। কেননা সেটা নাকি তাঁর কখনওই লক্ষ্য ছিল না। আসলে রাজনৈতিক জীবনের বেশির ভাগটাই রাজ্যসভায় কাটিয়েছেন প্রণব। তাছা়ড়া মাথায় ছিল একসময়ের তাবড় কংগ্রেস নেতা কামরাজের বলা কথাটা। তিনি নাকি বলতেন, ”নো হিন্দি, নো পিএম।” হিন্দিটা খুব ভালো করে না জানা প্রণব তাই কুরসিতে বসার স্বপ্ন দেখতে চাননি। কিন্তু এটা মানতেই হবে, তিনি চান বা না চান প্রধানমন্ত্রীর কুরসিতে তাঁকে দেখতে পাওয়াটা বিরাট প্রাপ্তি হত বাঙালির কাছে। কিন্তু প্রণবকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখার মতোই আরও একটা গর্বের শরিক হওয়াটা শেষপর্যন্ত তলিয়ে যায় অন্ধকারে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.