সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: প্রণব মুখোপাধ্যায় (Pranab Mukherjee) তখন দেশের রাষ্ট্রপতি। দেশে নরেন্দ্র মোদির জয়জয়কার চলছে। সেসময় বাংলায় এসে নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করে দিলেন,”এবার আপনাদের হাতে তিনটে লাড্ডু আসতে চলেছে। বাংলায় দিদি আপনাদের জন্য কাজ করবেন। দিল্লিতে আমি আপনাদের জন্য কাজ করব। আর আমার উপরে যিনি আছেন, তিনি তো আপনাদেরই লোক।” রাজনৈতিকভাবে প্রবল বিরোধী প্রণব মুখোপাধ্যায়ও যে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে পারেন, তা অকপটে স্বীকার করে নিয়েছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ নরেন্দ্র মোদিও।
হ্যাঁ, এটাই প্রণব মুখোপাধ্যায়। সেই রাজনীতিবিদ। যিনি তথাকথিত জনাধার না থাকা সত্বেও ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেছেন। আবার, ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও মাটির সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। কংগ্রেসের (Congress) অন্দরে থেকেও সব দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন। আবার প্রয়োজনে কড়া হাতে বিরোধিতাও করেছেন। কংগ্রেসি রাজনীতিতে প্রণববাবুর আগমন ১৯৬৯ সালে। তাঁর আগে সাংবাদিক তথা অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন। নিন্দুকেরা বলেন, রাজনীতিতে সাফল্যের জন্য যে জনাধার প্রয়োজন সেটা তাঁর কোনওদিনই ছিল না। কিন্তু তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক মস্তিস্ক মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁকে ইন্দিরা গান্ধীর স্নেহধন্য করে তুলল। রাজনীতিতে প্রবেশের মাত্র ৪ বছরের মধ্যেই পেলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পদ। ইন্দিরা, রাজীব, নরসিমা রাও থেকে শুরু করে, মনমোহন সিং পর্যন্ত সবার মন্ত্রিসভাতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন। কখনও বাণিজ্যমন্ত্রী হয়েছেন, কখনও বিদেশ দপ্তর সামলেছেন, আবার কখনও সামলেছেন অর্থমন্ত্রক। যখন যে দায়িত্ব পেয়েছেন, সামলেছেন সততার সঙ্গে। কেউ কোনও অভিযোগ করার সুযোগ পায়নি।
তবে প্রণববাবুর ইউএসপি সেটা নয়। তাঁর মূল ইউএসপি হল তাঁর রাজনৈতিক মস্তিস্ক। সেই ইন্দিরার আমল থেকে শুরু করে সোনিয়ার আমল পর্যন্ত, কংগ্রেস যখনই বিপদে পড়েছে, তখনই প্রণবকে স্মরণ করেছে। প্রণববাবুই উদ্ধার করেছেন। বিশেষত সক্রিয় রাজনীতির শেষ দুই দশকে সোনিয়া যখন দলের নেতৃত্বে, তখন প্রণববাবুকেই বলা হত ভারতীয় রাজনীতির চাণক্য। প্রায় সমস্ত আঞ্চলিক দলের নেতাদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। এমনকী সোনিয়া (Sonia Gandhi) নিজেও একসময়কে প্রণববাবুকে গুরুর আসনে বসিয়েছিলেন। ২০০৪ সালে বাজপেয়ীর জনপ্রিয়তা যখন মধ্যগগনে, তখনও তাঁকে পরাস্ত হতে হয়েছিল কংগ্রেস জোটের হাতে। হ্যাঁ, বাজপেয়ীর সমকক্ষ কোনও নেতা তখন কংগ্রেসে ছিল না। কিন্তু স্রেফ জোট সমীকরণের জোরে তাঁকে হারিয়ে দেয় কংগ্রেস। আর সোনিয়ার নেতৃত্বে সেই জোটের মালা কিন্তু গেঁথেছিলেন এই প্রণব মুখোপাধ্যায়ই। আবার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য বামেদের সমর্থন জোগাড়েও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এখানেই শেষ নয়, ২০০৮ সালে বামেরা যখন ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিল, কংগ্রেস সরকার তখন মহাসংকটে। তখনও আসরে নেমেছিলেন এই প্রণবই। মুলায়ম সিং যাদব এবং অমর সিংরা যে রাতারাতি মনমোহন সরকারকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেন, সেটির নেপথ্যেও অনেকে প্রণববাবুর ভূমিকা দেখতে পান।
আসলে রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর কংগ্রেস একপ্রকার পুরোপুরিই জোট নির্ভর হয়ে যায়। তখন থেকেই জোট রাজনীতির খুঁটিনাটি রপ্ত করেছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, দল যখনই কোনও ইস্যুতে বিপদে পড়েছে, বা কোনও রাজ্যে সরকার গঠনে অন্য দলের সমর্থন প্রয়োজন হয়েছে, তখনই তিনি ত্রাতা হিসেবে উঠে এসেছেন। অথচ, সেই প্রণব মুখোপাধ্যায়কেই সুযোগ থাকা সত্বেও প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বঞ্চিত করেছে কংগ্রেস। শুধু তাই নয়, রাহুলের উত্থানে যাতে তিনি বাধা হয়ে না দাঁড়াতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে প্রণববাবুকে সরানো হয়েছে রাষ্ট্রপতি ভবনে। অনেকেই বলেন, আজ যদি প্রণববাবু সক্রিয় রাজনীতিতে থাকতেন, তাহলে হয়তো দেশজুড়ে কংগ্রেসের এই নিশ্চিহ্ন হওয়ার অবস্থা হত না। কংগ্রেসের দুর্ভাগ্য যে তাঁকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিম্বা বিজেপির সৌভাগ্য।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.