জ্যোতির্ময় কর্মকার: রবিবার থেকে নয়াদিল্লিতে শুরু হচ্ছে সিপিএমের দু’দিনের পলিটব্যুরো বৈঠক৷ কেরলে প্রত্যাশিত জয় এলেও এবার রীতিমতো গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ৷ অস্তিত্বের সঙ্কট নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল আগেই৷ এবারের বিধানসভা নির্বাচনের পর কার্যত দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হচ্ছে সিপিএম-কে৷ ভোটের ফল ঘোষণার দিনই খোলাখুলি না বললেও ঘুরিয়ে জোটের কার্যকারিতা নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছিলেন পার্টির অনেক কেন্দ্রীয় নেতাই৷ কিন্তু নিচুতলায় কোনও রাখঢাক মানেননি পার্টির নেতা-কর্মীদের অনেকেই৷
স্বয়ং পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি ফল ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যখন বলছেন, জোটের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কি না তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে৷ তখন কেন্দ্রীয় কমিটি বা পলিটব্যুরোর ময়নাতদন্তের তোয়াক্কা না করে রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র এখনও একতরফা জানিয়ে যাচ্ছেন, ভোটের ফল যা-ই হোক, জোট চলবেই৷ এ কে গোপালন ভবন সূত্রের খবর, সম্ভবত জুনের তৃতীয় সপ্তাহে বসতে পারে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক৷ তার আগেই ভোট ভরাডুবির এই আবহে হাত-হাতুড়ির মধুচন্দ্রিমা নিয়ে পলিটব্যুরোর বৈঠকে রীতিমতো ধুন্ধুমার হতে চলেছে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল৷
ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি তিনদিনের পটিলব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের সময়ই জোটের সিদ্ধান্ত রুখতে তীব্র বিরোধিতা করেছিল কেরল লবি৷ প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের নেতৃত্বে পালিটব্যুরোর একটি অংশ বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, বরাবর আদর্শগত ভিন্ন মেরুতে থাকা কংগ্রেসের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা মানুষ ভালভাবে নেবে না৷ কিন্তু বঙ্গ ব্রিগেডের চাপে পলিটব্যুরো তথা কেন্দ্রীয় কমিটিতে জোটের পক্ষে ঐকমত্য গড়তে মূল ভূমিকা নিয়েছিলেন সীতারামই৷ এখন বিপর্যয়ের পর তাঁকেই প্রাথমিকভাবে কাঠগড়ায় তোলার চেষ্টা চলছে বলে পার্টি সূত্রে খবর৷ শিলিগুড়িতে একটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সাফল্যের উপর ভিত্তি করে সারা রাজ্যে শিলিগুড়ি মডেল প্রয়োগের জন্য প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সূর্যকান্তরা কেন রে রে করে উঠেছিলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেক কেন্দ্রীয় নেতাই৷ ফেব্রূয়ারির জোটের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বৈঠকে একদিকে যখন পার্টির সাধারণ সম্পাদকের প্রচ্ছন্ন সমর্থন নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটিতে গৌতম দেব, শ্রীদীপ ভট্টাচার্যরা জোটের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন, তখন উল্টোদিকে কারাট, এসআর পিল্লাইদের ইশারায় অনড় অবস্থান নিয়েছিল দক্ষিণী ব্রিগেড৷ স্বাভাবিকভাবেই এবারের পলিটব্যুরোর বৈঠক বিমান, সূর্যকান্তদের কাছে কার্যত জবাবদিহির বৈঠক হতে চলেছে বলেও মনে করছেন অনেকে৷
জোটের পক্ষে বঙ্গ ব্রিগেডের যুক্তি ছিল, কংগ্রেস ও বামেদের ভোট শতাংশের হিসাবকে যোগ করলে দেড়শোর বেশি আসনে তৃণমূলকে বেকায়দায় ফেলা সম্ভব৷ কিন্তু বাস্তব বলছে, বামেদের ভোট নিয়ে আদতে ঘর গুছিয়েছে কংগ্রেস৷ অন্যদিকে, কংগ্রেসের ভোট পাননি বাম প্রার্থীরা৷ সিপিএমের একতরফা জেদের ফলে চিরাচরিত শক্ত ঘাঁটিতেও মাশুল দিতে হচেছ আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লককে৷ রাজ্য বিধানসভায় এখন রীতিমতো টিমটিম করছেন তাঁরা৷ রাজ্য বামফ্রণ্টের অন্দরেও শরিকরা যে অস্ত্রে শান দিচেছ তা কার্যত বলাই বাহুল্য৷ এদিকে পশ্চিমবঙ্গের বেহাল দশায় অশনি সংকেত দেখছেন ত্রিপুরার মানিক সরকারও৷ ভোটের ফল বেরোনোর আগেই বাংলার জোট নিয়ে প্রকাশ্যেই অসন্তোষের কথা জানিয়েছিলেন তিনি৷ কারণ মমতার ইমেজে ভর করে এবার ত্রিপুরাতেও ভোল বদলাতে পারে কংগ্রেসের একটা বড় অংশ৷ ফলে পলিটব্যুরোয় তিনিও যথেষ্ট আক্রমণাত্মক হবেন বলেই মত রাজনৈতিক মহলের৷
Pঅন্যদিকে, জোটের জট শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, প্রশ্ন তুলে দিয়েছে সিপিএমের সার্বিক পার্টি লাইন নিয়েও৷ পাঁচ রাজ্যের ভোটের আগে সীতারাম জানিয়েছিলেন, আমাদের অন্যতম লক্ষ্য বিজেপিকে আটকানো৷ এই লক্ষ্যের কথা মাথায় রেখেই ঠিক হবে রাজ্যভিত্তিক নির্বাচনী রণকৌশল৷ এই সময় বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলকে এক বন্ধনীতে রেখে কংগ্রেসের সঙ্গে এক নৌকোয় পা রাখার জন্য পার্টির অভ্যন্তরে কারাট লবির উপর পরোক্ষ চাপ বাড়িয়ে ছিলেন ইয়েচুরি৷ দাবি করেছিলেন, “মুসলিম মৌলবাদীদের মদত দিচ্ছে তৃণমূল৷ আর বিজেপি হিন্দু মৌলবাদীদের সঙ্গে নিয়ে চলছে৷ সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের লক্ষ্যে এরা একে অপরের পরিপূরক হয়ে চলছে৷”
কিন্তু জোটের ভরাডুবিতে পশ্চিমবঙ্গে আদতে আসন বাড়িয়েছে বিজেপি৷ কেরলের প্রচারে বাংলার বাম-কংগ্রেস জোটের কথা বলে বাজার মাত করেছেন মোদি, অমিত শাহরা৷ অন্যদিকে অসমে এখন বিজেপির একক কর্তৃত্ব৷ স্বাভাবিকভাবেই বাংলায় মমতা এবং দেশজুড়ে মোদি হাওয়ার এই প্রতিকূলতায় পলিটব্যুরোর আলোচনার গতিপ্রকৃতি কী হয়, সেদিকেই তাকিয়ে রাজনৈতিক মহল৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.