সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: নীরব মোদির ১১ হাজার কোটিরও বেশি টাকার ব্যাঙ্ক জালিয়াতির বিরুদ্ধে ফের সরব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ এই ধনকুবেরের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চাইলেন ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর দাবি, পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে ১১,৪০০,০০,০০,০০০ টাকার প্রতারণা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। নোট বাতিলের সময় আরও অনেক বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির হয়েছে। যাবতীয় আর্থিক দুর্নীতির বীজ বপণ হয়েছে। রবিবার এই ভাষাতেই মোদি সরকারের তুমুল সমালোচনা করেন মমতা। প্রশ্ন তুলে দিলেন, কেন নোট বাতিলের আগে ও পরে বড় বড় ব্যাঙ্কের শীর্ষকর্তাদের বদলি করা হল? কারা তাঁদের নিয়োগ করেন? তবে কি সেই সময় আরও বড় কোনও কেলেঙ্কারি হয়েছে? কোন কোন ব্যাঙ্ক এভাবে প্রতারণার শিকার? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর প্রকাশ্যে আসার পক্ষে জোরাল সওয়াল করলেন মমতা।
মহারাষ্ট্রে পিএনবির শাখা থেকে কোটি কোটি টাকার জালিয়াতি খবর প্রকাশ্যে আসায় এর আগেও ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন মমতা। প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরসঙ্গী ধনকুবেরের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি তোলেন তিনি। বলেন, “কে টাকা নিয়ে পালাল, কে খেল সব তদন্ত করতে হবে। সাধারণ মানুষের টাকা জালিয়াতি করা হয়েছে। আমরা কিছুতেই ছাড়ব না।” মুখ্যমন্ত্রীর টুইট, “কী ঘটেছিল পিএনবি-তে? প্রায় এগারো হাজার কোটি লুট। মানুষের গচ্ছিত টাকা ব্যাংকে আর নিরাপদ নয়। এই দুর্নীতির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চাই।”
This is just the tip of the iceberg. This big banking fraud was fuelled at the time of #DeMonetisation. Big money laundering happened during DeMo. Key bank officials were changed. Who are these people put in? There are more banks involved. The full truth must come out
— Mamata Banerjee (@MamataOfficial) February 18, 2018
Look what happened at Punjab National Bank ? A scam of more than Rs 11,000 crore. People’s savings are not safe. There must be a thorough, time bound enquiry
— Mamata Banerjee (@MamataOfficial) February 15, 2018
পিএনবি কেলেঙ্কারি নিয়ে শাসক-বিরোধী চাপান-উতোর অব্যাহত রয়েছে। কেন্দ্রের হয়ে আসরে নেমেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। অন্যদিকে, কংগ্রেসের হয়ে কেন্দ্রকে আক্রমণ করেন প্রবীণ নেতা কপিল সিবাল। প্রায় প্রতিদিনই এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট নীরব মোদির সঙ্গে সম্পর্কিত নতুন নতুন জায়গায় তল্লাশি চালাচ্ছে। এর মধ্যে এই রাজ্যের দুর্গাপুরে নীরবের ব্যাবসায়ীক অংশীদার মেহুল চোখসির সংস্থা ‘গীতাঞ্জলি’র শোরুমও রয়েছে। সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশন (সিভিসি) পিএনবি এবং অর্থ মন্ত্রকের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের ১৯ ফেব্রুয়ারি হাজিরার জন্য নোটিস পাঠিয়েছে।
ED conducted further searches at 21 locations across India in Nirav Modi case & seized diamonds, gold, precious stones/ metals & jewellery worth Rs 25 crore (Book Value). Total seizure till now is Rs 5674 Crore.
— ED (@dir_ed) February 17, 2018
ED conducted further searches at 35 locations across India in Nirav Modi case & seized diamonds, gold & jewellery worth Rs 549 crore (Book Value). Total seizure till now is Rs 5649 Crore.
— ED (@dir_ed) February 16, 2018
যাদের সহযোগিতায় ‘হীরক খণ্ড’ নীরব মোদি এই কর্মকাণ্ড চালিয়ে গিয়েছেন, ইতিমধ্যেই একে একে তাদের জালে তোলা শুরু করেছে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের তরফে অভিযোগ পাওয়ার পর শুরুর দিকে তদন্তকারী আধিকারিকরা ক্রমশ অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিলেন। এখন বেশ আত্মবিশ্বাসী। পলাতক মামা-ভাগ্নেকে খুঁজে দেশে ফেরানো, তাদের বিচারের মুখে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। দেশজুড়ে নীরবের প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি চলছে, বাজেয়াপ্ত হচ্ছে হীরে-গয়না ও গুরুত্বপূর্ণ নথি। সেই সঙ্গে তদন্তের গতি বাড়াচ্ছে সিবিআই। শনিবারও পিএনবির ১১,৪০০ কোটি টাকার ‘মহা প্রতারণা’ মামলায় নীরবের তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে সিবিআই। সিবিআইয়ের জালে পিএনবির প্রাক্তন ডেপুটি ম্যানেজার গোকুলনাথ শেট্টি, সিঙ্গল উইন্ডো ম্যানেজার মনোজ খারাত এবং নীরবের সংস্থার ‘অনুমোদিত স্বাক্ষরকারী’ হেমন্ত ভাট। এই গোকুলনাথই প্রতারণার মূল পান্ডা। অভিযোগ তেমনটাই। ২৯ জানুয়ারি পিএনবির করা এফআইআরে এই তিন অভিযুক্তের নাম ছিল। প্রাথমিকভাবে ব্যাঙ্ক অবৈধ লেনদেনে ২৮০ কোটি টাকার প্রতারণার অভিযোগ করেছিল। পরে ব্যাঙ্ক জানায়, লোকসানের অঙ্ক ১১,৪০০ কোটি টাকা।
Central Bureau of Investigation (CBI) books businessmen Nirav Modi, Nishal Modi & PNB officials for cheating the Punjab National Bank to the tune of Rs 280.7 crores
— ANI (@ANI) February 5, 2018
কিন্তু তদন্তের পরতে পরতে চমকে উঠছে সিবিআই ও ইডি অফিসাররা। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক-সহ বিভিন্ন স্তরে অডিটের পরেও এই প্রতারণা ধরা যায়নি। কেন? এক ব্যাঙ্ক আধিকারিকের কথায়, লেটার্স অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং (এলওইউ) তৈরি করার সুইফট (SWIFT) সিস্টেম সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের কোর ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত নয়। সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ইন্টার ব্যাঙ্ক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন বা সংক্ষেপে সুইফট হল ব্যাঙ্কের একটি প্ল্যাটফর্ম। ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি অর্থ প্রদান-সহ বিভিন্ন তথ্য একটি সুরক্ষিত কোডের মাধ্যমে এর দ্বারা আদান-প্রদান করে থাকে। তদন্তে উঠে আসে, নীরবের প্রতারণায় এই সুইফট কোডের অপব্যবহার হয়েছে। আর তখনই পরিষ্কার হয়ে যায়, নীরবের নিজের বিশ্বস্ত লোক ব্যাঙ্কে না থাকলে, এটা সম্ভব হত না।
মুম্বইয়ে পিএনবির ব্র্যাডি হাউস ব্রাঞ্চেই নিজের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন নীরব মোদি। কর্তাব্যক্তিদের অজ্ঞাতেই চলেছে অবৈধ লেনদেন। এই শাখাটির সুইফট সিস্টেম কোর ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত নয়। লেনদেন গোপন রাখতেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই শাখাটিকেই নীরব বেছে নিয়েছিলেন। এই শাখায় নীরবের নেটওয়ার্কের মাথা ছিলেন ডেপুটি ম্যানেজার গোকুলনাথ শেট্টি। শাখায় সুইফট হ্যান্ডেল করতেন দুই ব্যক্তি, মেকার এবং চেকার। এই দুই ব্যক্তি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর ওই পদগুলিতে নতুন কর্মী আসে। তারাই এই প্রতারণার বিষয়টি ধরেন।
The Court sent them under 14 days police custody. Manoj Kharat was just a clerk & typed letter under pressure from Gokulnath Shetty. He has no role in the case, we’ll file bail application: Kudrat Sheikh, lawyer of Manoj Kharat #PNBFraudCase pic.twitter.com/N9FVfBq0ju
— ANI (@ANI) February 17, 2018
সিবিআইয়ের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া গোকুলনাথ ৩৬ বছর চাকরি করছে পিএনবিতে। নিয়ম অনুযায়ী ডেপুটি ম্যানেজার পদে তিন বছরে বদলি। কোনও বিষয়ে ওই আধিকারিককে সর্বাধিক ৫ বছর পর্যন্ত একই শাখায় রেখে দেওয়া যেতে পারে। সেই হিসাবেই গোকুলনাথের বদলির নির্দেশ এসেছিল। কিন্তু কার নির্দেশে সেই বদলির নির্দেশ আটকে গিয়েছিল এবং তিনি সাত বছর ধরে একই শাখায় কাজ করলেন, সে নিয়েও তদন্ত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, নীরব মোদির সংস্থার জন্য অনুমোদিত অঙ্কের চেয়ে অনেক বেশি অর্থের এলওইউ ইস্যু করা হয়েছে। এর অর্থ হল, ব্যাঙ্ক ওই সংস্থাকে দেওয়ার জন্য বিদেশের ব্যাঙ্কগুলিকে অনুমোদন করেছিল, সংস্থাটি তার চেয়ে ঢের বেশি অর্থ তুলে নিতে পারে। গোকুলনাথ একই এলওইউ রি-ইস্যু করেছেন বলে অভিযোগ। ব্যাঙ্কের এই কর্মীরা নীরবের কাছে লেনদেন পিছু কমিশন পেতেন বলে অভিযোগ। এমনকী, গত বছর মে মাসে অবসর নেওয়ার আগেও নীরব-বিশ্বস্ত গোকুলনাথ এমন ব্যবস্থা করে রাখেন, যাতে আরও এক বছর এই প্রতারণার ব্যাপারটি কারও নজরে না আসে।
PNB’s investigation reports revealed that logs in swift were used by many officials including Gokulnath Shetty by using passwords in capacity of authoriser enabling fraudulent Swift messages.Involvement&connivance of more staff members & outsiders can’t be ruled out: CBI #PNBScam
— ANI (@ANI) February 17, 2018
কিন্তু নীরব-পর্বের মধ্য দিয়ে ব্যাঙ্কিং পদ্ধতির বড় একটি ‘ফাঁক’ ধরা পড়েছে। ২০১১ থেকে যাবতীয় অডিট ও সিবিএসে এই প্রতারণা ধরা গেল না কেন? পুরনো কর্মীরা অবসর নেওয়ার পর নীরব-গোষ্ঠী ওই শাখায় নতুন বিশ্বস্ত সঙ্গী খুঁজতে থাকে। তখনই প্রতারণার ব্যাপারটি ধরা পড়ে। জানা গিয়েছে, এত সবের পরেও নীরব মোদি তাঁর বিদেশের ব্যবসা বাড়িয়েই চলেছেন। সিবিআই তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করার পরেও ম্যাকাও, কুয়ালা লামপুরে দুটি নতুন শোরুম খুলেছেন তিনি। সূত্রের খবর, নিউ ইয়র্কে বিলাসবহুল হোটেলে বহাল তবিয়তে আছেন ডায়মন্ড কিং। সেখানে তাঁর স্ত্রী এমিরও আসা-যাওয়া চলছে। আশ্চর্য শান্ত রয়েছেন নীরব। তবে কি এই ভরসাও কেউ দিয়েছে যে তাঁর ‘কিছু হবে না’?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.