সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: পুলিশ-প্রশাসন, সরকারের নাকের ডগায় বসে বহাল তবিয়তে গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়ে গিয়েছে ফারহাত খান৷ এক-দু বছর নয়৷ ২০ বছর ধরে দক্ষতার সঙ্গে পাকিস্তানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করেছে পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই এই লোকটি৷ দিল্লি পুলিশের ম্যারাথন জেরায় কবুল করেছে, ১৯৯৬ সাল থেকেই সে আইএসআই-এর হয়ে চরবৃত্তি করছে৷
সমাজবাদী পার্টির সক্রিয় সদস্য এবং সপা সাংসদ মুনাওয়ার সেলিমের সবচেয়ে আস্থাভাজন কর্মী হিসাবে সরকারি স্পর্শকাতর বহু গুরুত্বপূর্ণ নথিও তার হাতে চলে আসত৷ গত ২০ বছরে অন্তত পাঁচ জন সাংসদের খিদমত খেটেছে ফারহাত৷ স্বভাবে বিশ্বাসী অনুগামী ফারহাত৷ মন্ত্রী সাংসদদের ব্যক্তিগত সহকারী বা আপ্তসহায়ক হয়ে উঠতে সময় লাগেনি ধূর্ত ও ধান্দাবাজ ফারহাতের৷
আপাত নিরীহ ও নরম মনোভাবের ফারহাত যে কতখানি দুঁদে পাকিস্তানি চর তা আন্দাজ করতে পারেননি গোয়েন্দা বা পুলিশকর্তারা৷ অতীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দেওয়া ইফতার পার্টিতে বা হজ ফেরত সম্মেলনে তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল পাকিস্তানি ও সৌদি আরবের দূতাবাসের কর্মীদের৷ ‘মোল’ বা ‘খোচর’ হিসাবে প্রথমে কাজ শুরু করেছিল ফারহাত৷ তার দক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বিশ্বস্ত গুপ্তচর করে নেয় আইএসআই৷ শুধু তাই নয়, ভারত সরকারের এবং উত্তরপ্রদেশ সরকারের কোনও নথি বা ছবি পাক দূতাবাসের চরদের বিক্রি করে মোটা টাকা আয় করত সে৷ সরকারি খবর সে পাচার করত দশ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকার বিনিময়ে৷ খবর ও নথি পিছু কত টাকা সে পাবে তা ঠিক হত খবরের গুরুত্ব ও স্পর্শকাতরতা বুঝে৷ নানা সময়ে সাংসদদের ঘনিষ্ঠ অনুগামী ও তাঁদের অফিস ক্লার্ক হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন মন্ত্রকের কম্পিউটার থেকে পেনড্রাইভ, হার্ডড্রাইভ, স্মার্ট ওয়াচ-সহ একাধিক ডিভাইসের মাধ্যমে সে তথ্য চুরি করত এবং জনবহুল জায়গায় দেখা করে পাক গুপ্তচরদের হাতে তুলে দিত৷ ফারহাত কবুল করেছে, টাকার লোভে এবং পাকিস্তানের প্রতি ভালবাসা থাকায় সে স্বেচ্ছায় এই কাজ করত৷ এজন্য কোনওদিন তাকে সমস্যায় পড়তে হয়নি৷ এভাবেই নানা তথ্য, খবর পাচার করে খেয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল ফারহাত৷ ফারহাত জানিয়েছে, ভারত থেকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে সদ্য বহিষ্কৃত পাক দূতাবাসকর্মী মেহমুদ আখতারতে সে সব নথির ডিজিটাল সংস্করণ পেনড্রাইভ বা ইউএসবি ড্রাইভে তুলে দিত৷ সে নিশ্চিত, চরদের কাছ থেকে পাওয়া ভারতের যাবতীয় গোপন খবরাখবর স্বয়ং পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত বাসিত আলি ফাইনাল চেক করার পর তবেই পাকিস্তানে ই-মেল করে পাঠানো হত৷ তাছাড়া, পাক দূতাবাসের শতকরা ৯৯ জনই আইসআই-এর লোক৷
মেহমুদ আখতারের পূর্বসুরি শামসাদ, ফৈয়াজ নামে আগেকার পাক হাইকমিশনের কর্মীদের হাতেও সে প্রচুর নথি তুলে দিয়েছে৷ ভারতের সেনা মোতায়েন, সীমান্তে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, বিমান চলাচল সংক্রান্ত তথ্য, সমুদ্র বন্দরগুলির নিরাপত্তা ব্যবস্থা, রেল পরিবহণের ত্রুটি-বিচ্যুতি, তাপ ও জলবিদ্যুত্ প্রকল্পগুলির অবস্থান, মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো এবং প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও-র অজস্র স্পর্শকাতর নথি-ছবি তার হাত দিয়ে পাকিস্তানে পাচার হয়েছে গত ২০ বছর ধরে৷ এই প্রসঙ্গে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর চেয়ারম্যান এ এস কিরণ কুমার জানিয়েছেন, “আমরা এখনও পর্যন্ত তথ্য পাচার নিয়ে যা জেনেছি সবই সংবাদমাধ্যম থেকে৷ এখন কোনও মন্তব্য করব না৷ গোয়েন্দারা তদন্ত চালাচ্ছেন৷”
কীভাবে কাজ চালাত পাক চরচক্র? পাক দূতাবাস কর্মী মেহমুদ আখতার ও সমাজবাদী পার্টি সদস্য ফারহাত খানকে ম্যারাথন জেরা করে দিল্লি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, ‘পিৎজা’ ও ‘বার্গার’ -এই দুই সাংকেতিক নামে ডাকা হত তথ্য ও নথিগুলিকে৷ ভিস্যুয়াল ফুটেজগুলিকে কখনও কফি নামেও ডাকা হত৷ পুলিশের ভাষায়, ফাস্ট ফুডের নামে তথ্য পাচার ও চরবৃত্তি পুলিশ ও গোয়েন্দাদের বোকা বানাত৷ কারণ যে কেউ ফোনে আড়ি পাতলে বা মোবাইল ট্যাপ করলে ভাবত, বন্ধু বা পরিচিত ব্যক্তি হয়তো রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়া নিয়ে কথা বলছে৷ ‘চলো আজ পিৎজা খাই’ (ভাল ডকুমেন্ট হাতানো গিয়েছে৷ আজ দিয়ে দেব) কিংবা ‘আজ বার্গার হবে নাকি?’ (ভাল খবর আছে৷ নেবে নাকি?) বেশ ভাল কফি আছে (ভাল ভিডিও ফুটেজ আছে)৷ কোল্ড ড্রিংকস খাওয়াতে হবে কিন্তু…(ভাল পেমেন্ট বা টাকা দিতে হবে কিন্তু… না হলে খবর লিক করব না) ইত্যাদি৷ এসবই সাংবাদিক সম্মেলনে ফাঁস করেছেন দিল্লি পুলিশের ডেপুটি কমিশনার ভীষ্ম সিং, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার সঞ্জয় শেরাওয়াত৷ পাক নাগরিক মেহমুদ আখতার দিল্লিতে দু’ নম্বরি কাজকর্ম করার জন্য জনৈক মেহবুব রাজপুতের নামে একটি ভুয়া আধার কার্ড বানিয়েছিল৷ জাল আধার কার্ড নিয়ে বমাল ধরা পড়ে সে৷ বুধবার তার সঙ্গে ধরা পড়ে বৃদ্ধ গুপ্তচর মৌলানা রমজান ও সুভাষ জাঙ্গির৷ রাজস্থান থেকে ধরা হয় পাসপোর্ট এজেন্ট শোয়েবকে৷ সে জাল পাসপোর্ট ও আধার কার্ড তৈরি করত৷
আখতার পাক দূতাবাসের কর্মী হিসাবে তার বসের গাড়ি নিয়ে নানা সময় বাজার যাওয়ার নাম করে নিয়মিত দিল্লির আনসাল প্লাজা, পিতমপুরা মল, সবজি মান্ডি মেট্রো স্টেশন, ফিরোজ শা কোটলা স্টেডিয়ামে দেখা করত ফারহাত খান ও সুভাষ জাঙ্গিরের সঙ্গে৷ নাশকতা চালাতে জঙ্গি নিয়োগ, সরকারি তথ্য-নথি হাতানো নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হত কফি শপে, রেস্তোরাঁয়, দোকানে, স্টেশন৷ দিল্লি পুলিশের দাবি, পাকিস্তানি চর চক্রের গোটা নেটওয়ার্কটিকেই ধবংস করতে চাইছেন তাঁরা৷ সেজন্য আড়ালে কলকাঠি নাড়া একশ্রেণির প্রভাবশালী লোকজন রয়েছে৷ তাদের কাছে পৌঁছতে হবে৷ একটা গ্রেফতারই আরও চরকে ধরিয়ে দিতে সফল হচ্ছে৷ তাই সতর্ক হয়ে যাওয়া পাক দূতাবাসকর্মীদের গতিবিধির উপর কড়া নজরদারি চলছে৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.