সোম রায়, শ্রীনগর: সামগ্রিক উন্নতি যদি চান, বর্জন করুন পরিবারতন্ত্র। কাশ্মীরিদের কাছে এমনটাই আবেদন করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। রবিবার কাঠুয়ায় মোদি বলেন, “জম্মু ও কাশ্মীরের তিনটি প্রজন্মকে শেষ করে দিয়েছে আবদুল্লা ও মুফতি পরিবার। আপনাদের উচিত এবার ওই দুই পরিবারকে সরিয়ে দেওয়া। না হলে জম্মু-কাশ্মীরের উন্নয়ন অসম্ভব।” ‘আয়রন ম্যান’-এর এই বক্তব্য শোনার পর থেকেই মনে একটা প্রশ্ন দানা বাঁধছিল। আবেদনের মাধ্যমে তিনি না হয় এই দাবি জানিয়ে গেলেন, কিন্তু সাধারণ কাশ্মীরিরা মোদির এই বক্তব্যে সঙ্গে কতটা সহমত পোষণ করছেন?
প্রশ্নের উত্তর পেতে পয়লা বৈশাখ সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম শ্রীনগরের অলিগলিতে। নতুন বছরের প্রথম দিনের শুরুতেই গন্তব্য শঙ্করাচার্য মন্দির। প্রায় আড়াইশো ধাপ ডিঙিয়ে মন্দিরের সামনের রোয়াকে বসে হাঁফাতে হাঁফাতে কথা হচ্ছিল এক সিআরপিএফ জওয়ানের সঙ্গে। বেনারস থেকে নন্দকিশোর গুপ্তা এখানে ডিউটিতে এসেছেন বছর আড়াই আগে। বলছিলেন, “দেখুন, মোদিজির জাদু তো সারাদেশ জুড়েই। তবে এখানে খুব মুশকিল। বিজেপির হিন্দুত্ববাদের জন্যই কাশ্মীর থেকে ভাল ফল করা সমস্যাজনক।”
দেবাদিদেবকে দর্শন করে দৌড়ালাম শের-এ-কাশ্মীর পার্কের দিকে। সেখানে ফারুক আবদুল্লার সমর্থনে জনসভা ছিল ওমর আবদুল্লার। বাবা ও ছেলে-দু’জনই মোদিকে তুলোধোনা করতে কোনও কসুর রাখলেন না। সপ্তাহখানেক আগেই কাশ্মীরের জন্য আলাদা সর্দার-এ-রিয়াসত (রাষ্ট্রপতি) ও উজির-এ-আজম(প্রধানমন্ত্রী)-এর দাবি করেছিলেন ওমর। রবিবারের জনসভায় মোদি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ফলে কোনওভাবেই ওই দাবি মানা সম্ভব নয়। জবাবে ওমর বলেন, “কাশ্মীর যদি ভারতের অঙ্গই হয়, তাহলে আপনি এখানে এলেন না কেন? আমরা তো খুবই ছোট একটা পার্টি। সর্বোচ্চ ছ’জন সদস্য সংসদে পাঠাতে পারি। এত ভয় কীসের যে প্রত্যেক মিটিংয়ে আমাদের নাম করে করে উত্তর দিতে হচ্ছে?”
পরিবারতন্ত্র বর্জন করার যে ডাক মোদি দিয়েছেন, তার উত্তরে নাম না করে ওমর বলেন, “ওঁর স্মৃতিশক্তি এতটা খারাপ জানতাম না। পাঁচ বছর আগেও আপনি এই কথা বলেছিলেন। কিন্তু, তার কয়েকমাসের মধ্যে আপনি পিডিপি-র সঙ্গে কোলাকুলি করে এখানে সরকার গঠন করলেন। যে পরিবার তন্ত্রের কথা বলছেন, শেষ পাঁচ বছরে তার মধ্যে এক পরিবারের দু’জনকে তো আপনিই উজির-এ-আলা (মুখ্যমন্ত্রী) বানিয়েছেন।”
পরিবারতন্ত্রের জবাবে ছেলে ওমরের থেকেও এক গিয়ার উপরে স্পিড তুললেন ফারুক আবদুল্লা। “বিধানসভায় সরকার গড়ার স্বপ্ন দেখে আমায় যে ফোন করেছিলেন, সেটা কি ভুলে গিয়েছেন? আমি এড়িয়ে যাওয়ায় ওমর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যাঁদের হাতে মুসলমানের রক্ত লেগে আছে, তাঁদের সঙ্গে জোট নয়। আর এখন পরিবারতন্ত্র শেষ করার কথা বলছেন কোন মুখে?”
এদিন বিজবেহারায় নির্বাচনী প্রচার ছিল অনন্তনাগ কেন্দ্রের প্রার্থী ও পিডিপি প্রধান মেহবুবা মুফতির। সেখানে যাওয়ার পথে তাঁর গাড়িতে হামলা করেন ‘পাথরবাজ‘রা। তিনি বেঁচে গেলেও কনভয়ের একটি গাড়ি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আহত হন এক ড্রাইভার। তার আগে স্থানীয় খিরাম দরগায় নমাজ পড়তে গিয়েছিলেন মেহবুবা। সেখানে সাংবাদিকদের বলেন, “জম্মু-কাশ্মীরে সাম্প্রদায়িক অশান্তি ও মেরুকরণ করতে চেয়েছিলেন মোদিজি। ব্যর্থ হওয়ায় বালাকোট ড্রামা করলেন। তাতেও প্রথম দফার ভোটে সুবিধা করতে না পেরে বুঝতে পেরেছেন যে সরকারে আসা সমস্যার হয়ে যাচ্ছে। তাই ভুলভাল বকছেন।” পুলওয়ামা কাণ্ডের তদন্ত চেয়ে বলেন, “মমতাদি, মায়াবতীজিরা ঠিকই বলছেন। তদন্ত হওয়া উচিত।”
রাজনৈতিক নেতারা তো নিজেদের দিকে ওঠা প্রশ্নের এভাবেই মোকাবিলা করবেন। কিন্তু শের-এ-কাশ্মীর পার্কের মেন গেটের বাইরে সিগারেটের দোকানের মালিক জাহাঙ্গির আহমেদ থেকে শুরু করে লালচকের বাদশা কেমিস্টের আফজল লোন। ডাল লেকের সোনালি বাঙালি রেস্টুরেন্টের কাঁথির প্রণবেশ জানা বা বাদামবাগের সামনে কাবাব বিক্রেতা ফিরোজ খান। প্রত্যেকেই একবাক্যে বলছেন-মোদি বা বিজেপির কাশ্মীরে কোনও স্থান নেই। হিন্দুত্ববাদ। সার্জিকাল স্ট্রাইকের পর টুরিজমে ধাক্কা। সব মিলিয়ে শ্রীনগর মোদির আবেদন খারিজই করছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.