সোম রায়, জম্মু: কত বিজ্ঞাপন দেখা যায় ইতিউতি। দু’মাসে ইংরেজি শিখুন, ছ’মাসে কম্পিউটার কোর্স। আমিও সেই বিজ্ঞাপনদাতা হলে লিখতাম ‘মাত্র পাঁচ সপ্তাহে উপলব্ধি পালটান’। অন্তত আমার ক্ষেত্রে ঘটল সেইরকমই। কাশ্মীরে কাটিয়ে আসার পর পাঁচ হপ্তা পেরোতেই ফের আসতে হল জম্মু। এবং বুঝলাম, জম্মু ও কাশ্মীরের চরিত্রগত দূরত্ব কতটা!
ভেবেছিলাম, অনেকে ভাবিয়েও ছিলেন কাশ্মীরের মতো জম্মুতেও থাকবে আতঙ্কের থমথমে পরিবেশ! মানুষজনের ভিতর সন্দেহ, দুমদাম চেকিং, টহল, একটা রুদ্ধশ্বাস পরিবেশ। ‘রক্তচরিত্র’ যাকে বলে। যেখানে ক’টা দিন ঘাড় গুঁজে কাটিয়ে ফেলতে হবে। যাঁরা এখানে আগে আসেননি, ঠিক তাঁদের মতোই এই বুদবুদমার্কা ধারণাকে বোর্ডিং পাসের সঙ্গে মনে করে পকেটে গুঁজে রওনা দিয়েছিলাম জম্মুর উদ্দেশে। সেই টেনশনে আর কাজের চাপে প্রথমদিনটা কেটে গেল ঝড়ের মতো। রাতে ডিনার করতে করতে সারাদিনের ফ্ল্যাশব্যাক করতে করতে মনে হল, কাশ্মীর আর জম্মুর মাঝে এতটা পার্থক্য!
নিরাপত্তার জন্য জম্মু বিমানবন্দরে গাড়ি ঢোকানোয় ‘নো এন্ট্রি‘। সুতরাং, লাগেজ নিয়ে বেরিয়েছিলাম ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে। বাউন্ডারির ভিতরে স্বাভাবিক নিয়মেই অ্যাসল্ট রাইফেল হাতে আধা সামরিক বাহিনীর টহল। কিন্তু, বিশ্বাস করুন, বাইরে এসবের নামমাত্রও নেই।লোকাল ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের সামনে জটলা। পাশ দিয়ে নিজের মতো করে কান ঝালাপালা করে হর্ন বাজাতে বাজাতে চলেছে গাড়ি। অনেকটা দুর্গাপুর, কাঁথি গোছের ছোট শহরগুলোর ছবি।
হোটেলে যাওয়ার পথে নিরাপত্তার জুজু কোথাও চোখে পড়েনি। বারি ব্রহ্মণার সামনে হঠাৎ একটা সাঁজোয়া গাড়ি দেখা গেল। ড্রাইভার অজয় মহাজন হেসে বললেন, ‘রাজা কা সওয়ারি আ গায়া।’ পাঁচ সপ্তাহ আগে যে সাঁজোয়া গাড়ি দেখলে ভ্রু-কোঁচকাতে দেখেছি কাশ্মীরের আবালবৃদ্ধবনিতাকে, তার একবারে উলটপুরাণ দেখব জম্মুতে তা কল্পনাও করতে পারিনি। তারপর থেকে এখনও অবধি যা দেখলাম ও শুনলাম, তাতে নিজের চোখ-কানকে বিশ্বাস করাতেই পারছিলাম না। কাশ্মীরের নাম জম্মুর সঙ্গেই বরাবর উচ্চারিত হয়! কিন্তু নিজের যমজ ভাইয়ের জন্য এতটা বিষ জমা হয়ে আছে জম্মুর মনে?
কাশ্মীরি পণ্ডিত নিগ্রহ। সেখান থেকে সন্ত্রাস করে হিন্দুদের তাড়িয়ে দেওয়া। জম্মুবাসীদের মনে জমে থাকা অতীতের এই কালো দিনগুলির ক্ষতে আরও খোঁচা দিয়েছে ‘পুলওয়ামা কাণ্ড‘। তারপর থেকে জম্মুর কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে কাশ্মীর। ১৪ ফেব্রুয়ারির পরপরই অল্পের জন্য দাঙ্গা লাগেনি জম্মুতে। কয়েকজন কাশ্মীরিকে যেভাবে ঘিরে ফেলে মারধর করা শুরু করেছিলেন জম্মুর নাগরিকরা, যে কোনও মুহূর্তে একটা বড়সড় অঘটন ঘটেই যেতে পারত। ‘৪৪-এ’ জাতীয় সড়কের রায়া মোড়ের সামনের চা বিক্রেতা বলছিলেন, “মোদিকে আবার আসতে দিন শুধু। ওদের সোজা করে দেবে একেবারে।” পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠলেন, “এত ঝামেলার কী আছে? এর থেকে ওদের আলাদাই করে দিক। ঝামেলা মিটবে। শান্তিতে থাকা যাবে। জম্মুতে শিল্প হবে। ঘরের ছেলেমেয়েরা ঘরেই থাকবে। আমাদের পকেট কেটেই তো চলছে ওদের। একটা টাকা তো ট্যাক্স দেয় না। ইলেকট্রিক, জল সব ফ্রি।”
দুটো শব্দ উচ্চারণের মাঝে স্তব্ধতায় খবর এল দুশো কিলোমিটার দূরে, কিশতোওয়ারে আবার হয়েছে জঙ্গিহানা। আবার টার্গেট আরএসএস। বাড়তে থাকল উত্তেজনার পারদ। সকালে এলাম জম্মু জেনারেল বাসস্ট্যান্ডে। এই সেই বাসস্ট্যান্ড, যেখানে একমাস আগে হয়েছিল জঙ্গিহানা। কাশ্মীর এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে পরিচিত হলেও জম্মুর লোকেরা অনভ্যস্ত। তাই মাত্র ১১ দিনের মাথায় পুলওয়ামা গিয়ে সেখানকার স্থানীয়দের যতটা ভয়ার্ত দেখেছিলাম- সেই ঘটনার তুলনায় নস্যির মতো হানাতেও অনেক বেশি ভয়ার্ত লাগল এখানকার ব্যবসায়ীদের। বছর কুড়ির ফল বিক্রেতা প্রভাকর বলছিলেন, “আমি কখনও এসব দেখিনি। অন্যদিনের মতো সেদিনও দোকান করছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে বিকট আওয়াজ। প্রথমে বুঝতে পারিনি। একটু পরে দোকানের নিচেই লুকিয়ে পড়ি। সে কী বীভৎস অবস্থা!”
জম্মু ও কাশ্মীর, দু’টি শহর একেবারেই দুটো আলাদা পৃথিবী। কিন্তু কেন? শুধুই কি জঙ্গিহানা? অতীতের দগদগে ঘা? না কি অদৃশ্য সিরিঞ্জের মাধ্যমে দুই যমজ ভাইয়ের শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ইংরেজদের সেই জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণের বিভেদ। যার থেকে পরিত্রাণের উপায় কবে, কোন পথে বা কী উপায়ে? তা বাতলে দেওয়া কোনও ভোটের সাধ্যি নয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.