অনির্বাণ চৌধুরী: জগন্নাথ মন্দিরে বলি বললে একটু বিতর্ক অবশ্য মাথাচাড়া দিতে পারে! যে ভক্তপ্রাণ বৈষ্ণবরা একসময় এই বলিপ্রথার বিরোধিতা করেছিলেন, মারমুখী হয়ে উঠতে পারেন তাঁরা!
ও দিকে, জগন্নাথ মন্দিরে বলি বললে পুরোপুরি সত্যের অপলাপও হয় না। বলি যখন প্রদত্ত হচ্ছে জগন্নাথ মন্দির প্রাঙ্গণে, তখন হিসেবমতো ভুল কিছু নেই! শুধু এটুকু উল্লেখ না করলেই নয়, সেই বলি নীলমাধবের উদ্দেশে প্রদত্ত হয় না। সেই বলি প্রদত্ত হয় নীলাচলবাসিনী দেবী বিমলার উদ্দেশে।
বৈষ্ণবক্ষেত্রে বলির এই শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাসের ঐতিহ্য বুঝতে হলে আগে চোখ রাখতে হবে দেবী বিমলার স্বরূপে। পুরাণ এবং তন্ত্র মতে তিনিই সাক্ষাৎ মহিষমর্দিনী। এবং, জগন্নাথধামের সর্বময়ী কর্ত্রীও। তাঁর পূজা না হলে জগন্নাথের পূজা শুরু করার নিয়ম নেই। লোকবিশ্বাস বলে, দেবী বিমলা অনুমতি দিয়েছিলেন বলেই এই মন্দিরে দুই স্ত্রী লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং দুই ভাইবোন বলভদ্র, সুভদ্রাকে নিয়ে বাস করতে পারেন নীলমাধব। বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, শ্রীক্ষেত্রে জগন্নাথের মন্দির স্থাপিত হওয়ার বহু পূর্ব থেকেই প্রতিষ্ঠিত ছিল দেবী বিমলার মন্দির। নগরের প্রাণকেন্দ্রে ছিল তাঁর অবস্থান। পরে এই মন্দিরকে বেষ্টন করেই গড়ে ওঠে জগন্নাথধাম। সেই জন্যেই দেবী বিমলার কাছে জগন্নাথের এই অনুমতি গ্রহণের কাহিনিটি প্রচলিত হয়েছে।
দেবী বিমলার মন্দিরটি জগন্নাথ মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত। যে ওড়িশি মন্দির-ভাস্কর্যের রীতি মেনে তৈরি হয়েছে জগন্নাথদেবের মন্দির, সেই আদলেই তৈরি হয়েছে খ্রিস্টিয় নবম শতাব্দীতে বিমলার এই বেলেপাথরের মন্দির। বিমান, জগমোহন, নাটমণ্ডপ এবং ভোগমণ্ডপবিশিষ্ট এই মন্দির একান্নটি শক্তিপীঠের অন্যতম। কোনও পুরাণ বলে এখানে সতীর নাভিদেশ পতিত হয়েছিল, কোনও পুরাণ বলে পাদদেশ! কালিকা পুরাণ সমগ্র ভারতের চারটি দিকে তন্ত্রসাধনার যে চারটি মহাক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে, তাদের মধ্যে পশ্চিমদিকে রয়েছে উড্ডীয়নদেশ অর্থাৎ আজকের ওড়িশা। এই শক্তিপীঠের দেবী কাত্যায়নী (বিমলা), ভৈরব জগন্নাথ। হেবজ্র তন্ত্রও এই মতে সায় দিয়েছে।
তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থের পীঠনির্ণয় বা মহাপীঠনির্ণয় অংশে উৎকলের (বর্তমান ওড়িশা) বিরজা ক্ষেত্রকে শক্তিপীঠ বলা হয়েছে। এই পীঠের প্রধান দেবী বিমলা ও ভৈরব জগন্নাথ। আবার, এই বইটির অন্য একটি অংশে এই পীঠকে একটি উপপীঠ বা অপ্রধান পীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই মত বলছে, এখানে সতীর উচ্ছিষ্ট বা খাদ্যের অবশিষ্টাংশ পড়েছিল। মন্দিরটির অবস্থান হিসেবে নীলাচল নামটির উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, নীলাচল হল জগন্নাথ মন্দির চত্বরের প্রথাগত নাম। শিবচরিত গ্রন্থেও নীলাচল বা নীলপর্বতকে উপপীঠ এবং এই পীঠের দেবী বিমলা ও ভৈরব জগন্নাথ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তন্ত্রগ্রন্থ কুব্জিকাতন্ত্র মতে, বিমলা ৪২টি সিদ্ধপীঠের একটি। এখানে সাধনা করলে সিদ্ধি নামে একধরনের অলৌকিক ক্ষমতা লাভ করা যায় বলে তান্ত্রিকরা বিশ্বাস করেন। দেবীভাগবত পুরাণ, প্রাণতোষিণী তন্ত্র ও বৃহন্নীলতন্ত্র বিমলা মন্দিরকে ১০৮ পীঠের অন্যতম বলে উল্লেখ করেছে। মৎস্য পুরাণ গ্রন্থে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের বিমলাকে পীঠশক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বামন পুরাণ মতে, এটি একটি পবিত্র তীর্থ। মহাপীঠ নিরুপণ গ্রন্থেও বিমলা ও জগন্নাথকে পীঠদেবতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দেবীর ১০৮টি পৌরাণিক নামের তালিকা নামাষ্টোত্তরশত গ্রন্থেও পুরুষোত্তমের বিমলার নাম পাওয়া যায়। দেবী পুরাণ মতে, এই পীঠে সতীর পা পড়েছিল।
এতগুলো প্রাচীন গ্রন্থের মতামত উদ্ধৃত করার প্রয়োজন একটাই কারণে। যখনই বলছি শক্তিপীঠ এবং তা তন্ত্রসম্মত, তখন দেবী বিমলার পূজাও তন্ত্রমতে হতে বাধ্য। অর্থাৎ পঞ্চ ম-কার মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন সহযোগে। সেই জন্যেই এই বলি প্রথা! না হলে দেবীকে মাংস এবং মৎস্য উৎসর্গ করা হবে কী করে?
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, বছরের সবকটা দিন কিন্তু দেবী বিমলাকে বলি উৎসর্গ করা হয় না। তার কারণ দেবীর বিচিত্র খাদ্যাভ্যাস। সাধারণত বিমলার জন্য আলাদা ভোগ রান্না করা হয় না। তিনি জগন্নাথের উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ করেন। যা কি না নিরামিষ! এবং, সেই উচ্ছিষ্ট ভোগ দেবী বিমলা গ্রহণ করার পরেই তা মহাপ্রসাদের মর্যাদা পায়! অর্থাৎ, বছরের অন্য দিনগুলো বিমলা নিরামিষ আহারই ভক্ষণ করেন। যার পিছনেও নিহিত এক লোককাহিনি। সেই কাহিনি বলে, শিব একবার বৈকুণ্ঠে গিয়েছিলেন বিষ্ণুদর্শনে। সদ্য তখন আহার সমাপ্ত হয়েছে শ্রীভগবানের। কিছু উচ্ছিষ্ট পড়ে রয়েছে মাটিতে। সেই ঐশ্বর্যময় ভোগকণা দেখে শিব আর লোভ সংবরণ করতে পারলেন না। মেঝে থেকে তুলে নিয়ে ভক্ষণ করলেন সেই আহারকণা। মুছে ফেললেন মুখ। একটি অন্ন যদিও লেগে রইল তাঁর দাড়িতে। শিব যখন কৈলাসে ফিরলেন, তখন সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন নারদ। তিনি সেই অন্নকণা দর্শনমাত্র তা মহাবিষ্ণুর প্রসাদ বলে চিনতে পারলেন। এবং তড়িৎগতিতে ভক্ষণ করলেন তা!
ঘটনায় রীতিমতো ক্রুদ্ধ হলেন দেবী পার্বতী। প্রথা অনুযায়ী, শিবের ভাগে তাঁরই অধিকার, নারদের নয়। তিনি বৈকুণ্ঠে গিয়ে নালিশ জানালেন বিষ্ণুকে। পার্বতীর প্রীতিসম্পাদনের জন্য তখন কথা দেন বিষ্ণু, কলিযুগে তিনি নীলমাধব রূপে অবস্থান করবেন শ্রীক্ষেত্রে। পার্বতীও তখন বিমলা রূপে অবস্থান করবেন সেই মন্দির-প্রাঙ্গণে। এবং, প্রতি দিন তাঁকে উৎসর্গ করা হবে জগন্নাথের উচ্ছিষ্ট ভোগ! সেই প্রতিশ্রুতিমতো দেবী বিমলা বছরের অন্য দিনগুলো নিরামিষ ভোগেই তুষ্টা থাকেন!
কিন্তু, এই নবরাত্রির সময় চতুর্ভুজা, জপমালা-অমৃতকুম্ভ-নাগপাশ-বরদমুদ্রাধারিণী বিমলা পূজিতা হন উগ্রা মহিষমর্দিনীরূপে। তাঁর ক্রোধ প্রশমিত করতেই এই কয়েক দিন তাঁকে আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। পবিত্র মার্কণ্ড কুণ্ডের মাছ দেওয়া হয় ভোগে। আর দুর্গাষ্টমী এবং দুর্গানবমীর দিন উৎসর্গ করা হয় একটি পুরুষ পশু। আগে মহিষ বলি দেওয়া হত, এখন মূলত ছাগল বলি দেওয়া হয়।
এই বলিদানেরও রয়েছে কিছু নিজস্ব প্রথা। বৈষ্ণব মন্দিরে বলির জন্য পশুটিকে সরাসরি নিয়ে আসা হয় না। তাতে বৈষ্ণব লোকাচার ক্ষুণ্ণ হবে বলে! তাই ভোররাত্রে মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে একটি ভারা বাঁধা হয়। সেই ভারায় উঠে বলির পশুটিকে নামিয়ে দেওয়া হয় মন্দিরের ভিতরে। অতঃপর, বলিদান! সেই বলিদানও সেরে ফেলতে হয় জগন্নাথের ঘুম থেকে ওঠার আগে। ভোরের প্রথম আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে খুলে যায় জগন্নাথের গর্ভগৃহের দরজা, শুরু হয় প্রভাত-আরতি। তার আগেই অন্ধকারে সম্পন্ন করতে হয় এই বলিদানপ্রথা।
শতাব্দী ধরে এই প্রথা চলছে। আজ দুর্গাষ্টমীর দিনেও বলি হয়েছে জগন্নাথ মন্দিরে বিমলার উদ্দেশে। কাল, মহানবমীতেও হবে। এভাবেই শাক্ত আর বৈষ্ণব মতের সমণ্বয়ে পরিচালিত হবে নীলাচলধামের দেবজীবন। তুষ্টা হবেন দেবী বিমলা, প্রসন্ন থাকবেন তাঁর ভৈরব জগন্নাথও!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.