অনুরাগ রায়: প্যারাস্যুট ল্যান্ডিং যাকে বলে, ওড়িশার রাজনীতিতে সেটাই হয়েছে নবীন পট্টনায়েকের সঙ্গে। ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনীতিতে বিশেষ আগ্রহী না হলেও বাবার মৃত্যুর পর একপ্রকার বাধ্য হন ওড়িশার রাজনীতিতে অবতীর্ণ হতে। সাংসদ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, তার পরই ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীর কুরসি। সেভাবে কোনওদিন বিরোধী রাজনীতি করতে হয়নি নবীনকে। তা বলে রাজনৈতিকভাবে লড়াই একেবারে করতে হয়নি, তেমনও নয়। বাবার মৃত্যুর পর জনতা দল থেকে বেরিয়ে নতুন দল প্রতিষ্ঠা, সেই দলকে ওড়িশার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করা, এবং ক্ষমতা দখল করা, সবটাই নবীন করেছেন কার্যত একার হাতে।
সেই লড়াই ডিভিডেন্ট দিয়েছে। টানা পাঁচবার ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীর কুরসিতে বসেছেন তিনি। আপাতত ইতিহাসের দোরগোড়ায়। ক্ষমতায় ফিরলেই নবীন পট্টনায়েক দেশের সবচেয়ে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা মুখ্যমন্ত্রীদের তালিকায় পয়লা নম্বরে চলে আসবেন বিজেডি সুপ্রিমো। আপাতত সেই স্থান পবন চামলিংয়ের দখলে। পবন মুখ্যমন্ত্রীর পদে ছিলেন ২৪ বছর ১৬৫ দিন। আর নবীন ওই পদে আছেন ২৪ বছর ৮৫ দিন। আর দিন কয়েক মুখ্যমন্ত্রিত্ব করতে পারলেই ইতিহাসে নাম লেখাবেন তিনি। কিন্তু সেটার জন্য তাঁকে ক্ষমতায় ফিরতে হবে। কাজটা মোটেই সহজ নয়।
২০২৪ সালে সম্ভবত নিজের রাজনৈতিক কেরিয়ারের সবচেয়ে কঠিন নির্বাচনের সম্মুখীন হতে হয়েছে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীকে। একে তাঁর নিজের বয়স হয়েছে, অশক্ত শরীর, নিজে সেভাবে প্রচার করতে পারেন না। তার উপরে টানা প্রায় ২৫ বছর ক্ষমতায় থাকায় দলে অসন্তোষ দানা বেঁধেছে। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কিছুটা হলেও জাঁকিয়ে বসেছে কলিঙ্গভূমের আমজনতার মধ্যে। তাছাড়া এবারের প্রতিপক্ষ ‘দুর্বল’ ‘দিশাহীন’ কংগ্রেস নয়, বরং প্রবল প্রতাপশালী বিজেপি। যারা এতদিন বিজেডির ‘স্বাভাবিক মিত্র’ ছিল, ভোটের ময়দানে তাঁদের শত্রুতাই ‘অস্বাভাবিক’ জায়গায়। এতদিন নিন্দুকেরা বলতেন, বিজেপি আর বিজেডির মধ্যে পার্থক্য শুধু শেষ শব্দটায়। বাকি সব একই। আসলে যেভাবে এতদিন সময়ে-অসময়ে বিজু জনতা দল কেন্দ্রের বিজেপি (BJP) সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে এসেছে, তাতে এটা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।
বিজেপি ওড়িশায় প্রধান বিরোধী হিসাবে উঠে আসে ২০১৯ সালে। সেবার লোকসভায় রাজ্যে ৯ আসন যায় গেরুয়া শিবিরের দখলে। বিধানসভায় অবশ্য ব্যাপক জয় পান নবীন পট্টনায়েক (Naveen Patnaik)। কিন্তু এবার তাঁর চ্যালেঞ্জ আরও কড়া। বিজেপি আরও আক্রমণাত্মক। হাতেগরম ইস্যুও রয়েছে বহু। গেরুয়া শিবির সুকৌশলে ওড়িয়া অস্মিতা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। জগন্নাথ মন্দিরের রত্নভাণ্ডারের চাবি হারানো নিয়ে খোঁচা দেওয়াই হোক, শেষেবেলায় খোদ নবীনের অসুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হোক, সবটাই করা হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi) ওড়িশায় এসে বারবার বলে খুঁচিয়ে তুলেছেন জগন্নাথ মন্দিরের চাবি ইস্যু। তাছাড়া বারবার আক্রমণ করা হচ্ছে বিজেডি সুপ্রিমোর ডানহাত ভি কার্তিকেয়ান পান্ডিয়ানকে। আইএএস অফিসার থেকে রাজনীতির মঞ্চে যাঁর অনায়াস অবতরণ, সেই আমলাকেই মূলত ভিলেন বানাতে চাইছে বিজেপি।
গেরুয়া শিবির সুকৌশলে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, নবীনের পরে ওড়িশার কুরসি দখল করবেন ওই তামিল ভদ্রলোক, কোনও ওড়িয়া নেতা নন। তাছাড়া নবীনের অসুস্থতার নেপথ্যেও নাকি রয়েছেন পান্ডিয়ানই। বিজেপির এই প্রচার তৃণমূল স্তরে সাড়া ফেলছে। তাছাড়া গেরুয়া শিবির ওড়িশার মহিলা ভোট পেতে সুভদ্রা যোজনার মতো প্রকল্প ঘোষণা করেছে। ২৫ বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ ওড়িশার উন্নতি কই? সে প্রশ্নও তুলছেন মোদি। রয়েছে ভাষা অস্মিতা, আলাদা রাজ্যের দাবির মতো ইস্যুও।
বস্তুত, ওড়িশায় বিজেপির সঙ্গে ‘মোমেন্টাম’ রয়েছে, মোদির ভাবমূর্তি রয়েছে, কেন্দ্রের মেশিনারি রয়েছে। এত কিছু সত্ত্বেও তাঁদের লড়াই কঠিন। কারণ প্রতিপক্ষের ভদ্রলোকের নাম নবীন পট্টনায়েক। বস্তুত ওড়িয়া রাজনীতিতে নবীন নিজেকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে তুলে ফেলেছেন। তাঁর অবস্থান ‘ঈশ্বর সম’। তিনি বেশি হাসেন না, কথা বলেন কম, এমনকী বেশি ঘুমোন পর্যন্ত না। নীরবে নাকি নিজের কাজটা করে যান। সেটাই ২৫ বছর ধরে নবীনের সাফল্যের মূলমন্ত্র। এবার প্রতিপক্ষ যতই কঠিন হোক, নবীনের ওই ভাবমূর্তিকে আদৌ টলানো যাবে কি? সংশয় রয়েছে বিজেপির (BJP) অন্দরেও। অস্তুত নবীনের ২৫ বছরের জনসেবা, এবং ভাবমূর্তিই এবারের নির্বাচনে বিজেডির মূল পুঁজি। এখন ‘বহিরাগত’ ‘ওড়িয়া অস্মিতা’ খুঁচিয়ে নবীনবাবুর সেই ঈশ্বর সম ভাবমূর্তিকে টলানো যাবে কি? এই প্রশ্নের উত্তরই ঠিক করে দেবে নবীন আরও একবার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ইতিহাস গড়বেন, নাকি ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়ে বিদায় নেবেন?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.