প্রথম খসড়ায় তাঁর নাম আসেনি। বিপন্ন বাঙালিদের নিয়ে বরাবরই সরব তিনি। কিন্তু কেন এই প্রশ্ন। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়ায় বাঙালি কেন বিপন্ন হচ্ছে। নেপথ্যের রাজনীতি আসলে কী। অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলাপচারিতায় মণিশংকর চৌধুরি।
এনআরসি প্রক্রিয়াটিকে আপনি কী চোখে দেখছেন?
তপোধীরঃ এনআরসি তো একটি রাষ্ট্রীয় প্রকল্প। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে এই কাজ হচ্ছে। এ কথাগুলো আমরা সকলেই জানি। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হযেছে এটা শুদ্ধ, ন্যায়সঙ্গত প্রক্রিয়া। এই শব্দগুলোই প্রায়শই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭’য় যখন দেখলাম আমাদের নাম এল না, অনেকেরই নাম আসেনি, দেড়শো-দুশো বছর ধরে যাঁরা আছেন, তাঁদেরও নাম আসেনি, তখন আমরা হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, এটা কী হচ্ছে!
আপনি অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য। আপনার মতো গণ্যমান্য মানুষের নাম যখন আসেনি। তখন সাধারণ মানুষের কী হাল হচ্ছে?
তপোধীরঃ আমি কাছাড় জেলার কথাই বলি। প্রথম খসড়ায় সত্তর শতাংশ মানুষেরই নাম বাদ পড়েছিল। এবার দেখলাম কমপক্ষে ২ লক্ষ ২৮ হাজার মানুষের নাম বাদ পড়েছে। এর মধ্যে শিলচরের গুরুত্ব আলাদা। শুধু এখানেই প্রায় ১ লক্ষ ১৫ হাজার মানুষের নাম নেই।
এদের মধ্যে অনেকে তো স্বাধীনতার আগে থেকেও এসেছেন…
তপোধীরঃ হ্যাঁ, তা তো বটেই। একটা কথা এখানে বলে রাখি, এই যে বরাক উপত্যকা, যার সদর শহর শিলচর, সেটা কখনওই অসম বলতে আপনারা যা বোঝেন, তার অঙ্গ ছিল না। ঐতিহাসিকভাবে, সামাজিকভাবে, ভাষিকভাবে এবং সাংষ্কৃতিকভাবেই একথা বলা যায়। যদি নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙালির ইতিহাস- আদিপর্ব’ গ্রন্থটি কেউ পড়েন কিংবা আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা পড়েন, তাহলেই এটি স্পষ্ট হবে। আমাদের যে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক বঙ্গ, যা টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে, তারই অঙ্গ হল এটা। এই উপত্যকার তিন দিকে পাহাড়। মানে প্রকৃতিই সীমা নির্দেশ করে দিয়েছে। সুতরাং যদি প্রশ্ন করেন এখানে কতদিন ধরে আছি, তাহলে বলব, যতদিন উত্তরে বরাই পাহাড় আছে, ততদিন ধরেই আমরা এখানে আছি। এটা নেহাত কাব্য করে বলছি না। অসমের বিখ্যাত ঐতিহাসিকরা যখন অসমের ইতিহাস রচনা করেছেন তখন তাঁরাও বলেছেন, খ্রিস্টীয় পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতক থেকে এখানে মানুষের বাস। আপনি যদি মণিপুর সীমান্তে যান, জানবেন ওখানে ছিল শৈবতীর্থ। সেখানেই ব্রাহ্মণরা প্রথম বসতি করেন। পরে যখন গ্রামের সূচনা হয় তখন অব্রাহ্মণরাও চলে আসেন। আবার যদি পশ্চিমে যান পাবেন কপিল তীর্থ। সেখানেও একইভাবে বসতি গড়ে ওঠে। আবার ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় কামাক্ষ্যা মন্দিরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ব্রাহ্মণ বসতি গড়ে ওঠে। আজকের যা অসম মানে তখনকার প্রাগজ্যোতিষপুরের পশ্চিম প্রান্ত থেকে তাঁরা এসেছিলেন। পরে তাঁদের অনেক বিবর্তন হয়েছে। সুতরাং বাঙালির এখানে সেই তখন থেকেই আছেন।
[ নাগরিকপঞ্জির সিংহভাগ জুড়ে সীমান্ত লাগোয়া বাসিন্দারা, তালিকায় নেই ভূমিপুত্ররাই ]
আজ তাহলে তাঁরা বিপন্ন হচ্ছেন কেন?
তপোধীরঃ আসলে আজ যখন ভূমিপুত্র বলা হচ্ছে তখন অসমের জনগণকে দু’ভাগে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে। যাঁরা সংখ্যাগুরুর ভাষায় কথা বলেন তাঁদের ভূমিপুত্র মানা হচ্ছে। পাশাপাশি একেবারে ভোটের জন্য চা-বাগানে যাঁরা আছেন তাঁদেরও এই তকমা দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের জন্য কোনও কাগজপত্র লাগবে না, কোনও পরীক্ষার বা পরিভাষায় যাকে বলে ভেরিফিকেশন, তার প্রয়োজন নেই। শুধু আমরা যারা অভাগা, তাঁদের জন্য দশটা কাগজ লাগবে। একের পর এক নিয়ম পালটাবে। কিন্তু নিয়ম পরিবর্তনের পর কী দাঁড়াবে কেউ জানে না। তার ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। চল্লিশ লক্ষ মানুষ এনআরসি ছুট হয়েছেন। আবার সংসদে দাঁড়িয়ে অনেক সম্মানীয় ব্যক্তি সকলকে একইভাবে বলে দিচ্ছেন এঁরা এমনআরসি ছুট। আবেগের কথা যদি বাদও দেন, মানবিকতা বলেও একটা ব্যাপার আছে তো।
কিন্তু এতে তো অনেক বিভ্রান্তিও তৈরি হয়েছে।
তপোধীরঃ হ্যাঁ, হয়েছে তো। আমারই উলটোদিকের বাড়িতেই হয়েছে, মা-বাবার নাম আছে। কিন্তু তাঁদের বাড়ির মেয়েটার নাম নেই।
তাহলে ইতিহাসকে বিকৃত করে কোথাও কি নির্দিষ্ট একটা শ্রেণিকে টার্গেট করা হচ্ছে?
তপোধীরঃ তা নাহলে কি এটা কাকতালীয়? এই যে একটা বিশেষ অঞ্চলের মানুষ একটা বিশেষ ভাষাভাষীর মানুষের নাম বেছে বেছে বাদ দেওয়া হল, এটা হচ্ছে কেন? যেমন ধরুন ভট্টাচার্য, চক্রবর্তী, দত্ত, দাস এরকম বেশ কিছু পদবি অহমিয়াদেরও হয়, বাঙালিদেরও হয়। এখন এই চক্করে পড়ে তাঁদের নামও বাদ গিয়েছে। সে কারণেই অহমিয়ারাও বলছেন যে বৈধ হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের নাম নেই। আক্ষেপ করছেন।
এর জন্য কাকে দায়ী করবেন?
তপোধীরঃ দেখুন, একদিনে তো আর পুরো ব্যাপারটা ঘটেনি। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে এই কাজ হচ্ছে। কিন্তু মহামান্য আদালত তো নিজে এসে দেখছে না। তাঁদের হয়ে প্রতীক হাজেলা কাজ করছেন। আবার হাজেলার হয়ে বহু আধিকারিক কাজ করছেন। এখন এত বিভ্রান্তি যখন হচ্ছে, তখন মনে হচ্ছে মহামান্য আদালতই বা প্রতক্ষ্য তত্ত্বাবধান আদৌ করতে পারছেন কোথায়!
হাজেলার বিরুদ্ধেও অনেক অভিযোগ আছে। কিন্তু একটা বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই। যে সরকারই আসুক, এই বাঙালি বা ভাষিকভাবে সংখ্যালঘুদের কপালে কি শুধু বঞ্চনাই জুটছে?
তপোধীরঃ অবশ্যই। দেখুন না আমাদের ভাষা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি দপ্তরে বড় তো দূরের কথা মাঝারি পদেও ক’জন বাঙালি আছেন, তা খতিয়ে দেখুন। এটা কি কাকতালীয় বলে মনে করেন?
সে কারণেই কি অনেকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন?
তপোধীরঃ যাচ্ছেন তো। অনেকদিন থেকেই এক্সোডাস শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রথমত হয়তো শিক্ষার জন্য। উচ্চশিক্ষার জন্য অনেকে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু আর ফিরে আসছেন না। যদি কেউ কোনওদিন সমীক্ষা করেন তো দেখবেন, সমাজতাত্ত্বিক সমীক্ষার একটা জায়গাও বটে, এটা কার্যত একটা বিরাট বৃদ্ধাশ্রম হয়ে উঠছে। যাঁদের মেধা দিয়ে মন দিয়ে কাজ করার কথা ছিল, তাঁরা তো আর ফিরে আসছেন না। সেই একটা শূন্যতা তো তৈরি হয়েছে। যাই হোক নাগরিকপঞ্জি নিয়ে বলি, চোখে পড়ল উত্তরপ্রদেশের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীও বলছেন আট লক্ষ ‘বাংলাদেশি’কে ইউপি সরকার নাকি শনাক্ত করেছে। তাঁদের অপরাধ কী? বাংলা ভাষায় কথা বলেন? এতদিন আমি বলতাম, অসমে কি বাংলা ভাষায় কথা বলা অপরাধ? এখন তো দেখছি, গোটা দেশেই বাংলা ভাষায় কথা বলা অপরাধ। এদিকে সুপ্রিম কোর্ট তো বলছেন, কারও হেনস্তা হবে না। কিন্তু কী হচ্ছে শিলংয়ের রাস্তায়? সেখানে মানুষকে আটকে প্রমাণ চাওয়া হচ্ছে। বাঙালিদের কাছে পারমিট চাওয়া হচ্ছে। কী কাগজ দেখাবে বলুন তো? এনআরসি তো স্রেফ খসড়া মাত্র। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও তাই বলছেন। তারপরেও তাহলে এসব কেন হচ্ছে? এটা কি সুপ্রিম কোর্টকেই অমান্য করা হচ্ছে না? বাঙালি বলেই কি শুধু এই হেনস্তা?
তাহলে এর প্রতিকার কী? আপনার কী মনে হচ্ছে?
তপোধীরঃ উর্দু একটা পংক্তির বাংলা করে বলি, আমার হাজার বলার আছে, তোমার আছে এক না-শোনা। রোম্যান্টিক আঙ্গিক সরিয়েই বলছি, আমি অনেক কথাই বলতে চাইছি। কিন্তু যার শোনার কথা, সে যদি ঠিক করেই রাখে যে শুনবে না, তাহলে আর পালটাবে কে? যে বাঙালি জাতি দেশ গড়তে অন্য অনেকের সঙ্গে মিলেই সবথেকে বেশি স্বার্থত্যাগ করেছে, সেই আমাদের একটাই বার্তা, আমরা আমাদের প্রিয় ভারতবর্ষকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। আমাদের মানচিত্র কেড়ে নিচ্ছে আমাদের হাত থেকে। আমরা ভারতীয় ছিলাম, আছি ও থাকব। সাধারণ অহমিয়া ভাই-বোনের সঙ্গে আমাদের কোনওদিন কোনও ফারাক ছিল না। থাকবেও না। আর এই বাঙালিরা তো সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। সেটাই ইতিহাস বলে। ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি দেশের প্রতিটি রাজ্যেই আছে। তাদের বিদায় দেওয়ার কেন এত উদ্যোগ? আমাদের শুধু একটাই কথা, বাঙালি ভারতবর্ষেরই, আমাদের ভাতরবর্ষ আমাদের ফিরিয়ে দাও।
দেখুন ভিডিও:
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.