মণিশংকর চৌধুরি, হোজাই: বাংলাদেশি! অনুপ্রবেশকারী! শুনে বিষম চমকেছেন পার্থ দইমারি। গোয়ালপাড়ার বোড়ো জনগোষ্ঠীর মধ্যবয়সী মানুষটি ভেবেই পাচ্ছেন না তিনি কী করে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী হতে পারেন। কিন্তু শিবঠাকুরের আপন দেশে আইনকানুন যে সর্বনেশে তা তিনি কী করে জানবেন! এতএব এনআরসি-র গেরোয় পড়ে তাঁকেও এখন অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত হতে হচ্ছে।
[ শুধু সংখ্যালঘু নয়, কতটা ক্ষতিগ্রস্ত অসমের হিন্দু বাঙালিরা? ]
গোয়ালপাড়ার বাসিন্দা পার্থ। বোড়ো জনগোষ্ঠীর মানুষদের এই এলাকায় সাত পুরুষের বাস বলা যায়। কোনওদিন ভাবেননি যে তাঁদের এক লহমায় বাংলাদেশি হয়ে যেতে হবে। যত হ্যাপা অনুপ্রবেশকারীদের, এই ভেবে একরকম নিশ্চিন্তেই ছিলেন। বস্তুত কেন্দ্রের সরকারও বারবার বলছে যাঁরা বৈধ নাগরিক তাঁদের সমস্যা হওয়ার কোনও কারণই নেই। কথাও নয়। কিন্তু কোথায় কী! কথায় কাজে যে আসমান-জমিন ফারাক তা হাড়েহাড়ে বুঝছেন পার্থ দইমারি। গত সোমবার নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশ হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে তাঁর নামই নেই তালিকায়। নাম নেই তাঁর এক ভাইয়েরও। অথচ পরিবারের অন্য অনেকেরই নাম আছে। এই বিচিত্র বিচারে রীতিমতো তাজ্জব পার্থবাবুর মতো বোড়ো জনগোষ্ঠীর আরও অনেকে। একটা তালিকার জোর যে তাঁদের কোনওদিন বাংলাদেশি বানিয়ে দেবে তা তাঁরা কল্পনাও করতে পারেননি। বরং বাংলাদেশি অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে তাঁদেরও দীর্ঘদিনের সংগ্রাম। এই বোড়ো জনগোষ্ঠীর মানুষরাই বোড়োল্যান্ডের দাবিতে আন্দোলন চালিয়েছেন। জঙ্গিগোষ্ঠী এনডিএফআর একসময় মুসলিমদের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। গোয়ালপাড়া, কোগড়াঝাড়, ধুবড়িতে সে সময় অশান্ত পরিবেশ। মূল ক্ষোভ অবশ্য ছিল বাংলাদেশ অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধেই। এখন এনআরসি সেই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গেই একাসনে বসিয়ে দিয়েছে পার্থ দইমারিদেরও।
কিন্তু উপজাতিরাও কী করে বাদ গেলেন এই তালিকা থেকে? কাঠগড়ায় উঠছে এনআরসি-র তত্ত্বাবধানে থাকা স্টেট কো-অর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলার ভূমিকা। বিজেপির একাংশের অভিযোগ, হাজেলাকে নিয়োগ করেছিল তরুণ গগৈ সরকার। হাজেলার জ্ঞাতসারেই বিভিন্ন এলাকায় ডিটিপি অপারেটর হিসেবে সংখ্যালঘুদের নিযুক্ত করা হয়েছিল। এই ডেটা অপারেটরদের অনেকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাতিল করে দিয়েছে উপজাতি মানুষদের নামও। শুধু বোড়ো নয়, কোচ রাজবংশী এমনকী মিসিং জনগোষ্ঠীরও বহু মানুষেরই নাম আসেনি। রাতারাতি ভূমিপুত্র থেকে বাংলাদেশি হয়ে উঠেছেন তাঁরা। অনেক সময়ই প্লাবনের কারণে এঁদের উপযুক্ত নথি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সেক্ষেত্রে পঞ্চায়েতের শংসাপত্রই ছিল ভরসা। তবে এনআরসি-র ক্ষেত্রে সে শংসাপত্রকে মান্যতা দেওয়া হয়নি। ফলে উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও, সাত পুরুষের ভিটে থাকা সত্ত্বেও রাতারাতি ঘরছাড়া হওয়ার নিয়তি তাড়া করে বেড়াচ্ছে পার্থ দইমারিদের। গোটা এনআরসি খসড়ার যৌক্তিকতাই তাই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিতকরণের যে প্রক্রিয়ার সাফাই দিল্লিতে দেওয়া হচ্ছে, আদতে কি তাই-ই হয়েছে? উঠছে সে প্রশ্নও। স্থানিক অঞ্চলে কাজ করেছে জাতিবিদ্বেষের বিচিত্র সমীকরণ। ফলে বহু বৈধ নাগরিককেও রাতারাতি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত হতে হয়েছে। অর্থাৎ দিল্লিতে নেতারা যতই অসম অ্যাকর্ডের দোহাই দিন না কেন, বাস্তব বলছে অন্য কথা। সেখানে স্বাধীনতার আগে আসা মানুষকেও যেমন অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তেমন বিপাকে পড়েছেন উপজাতি কিংবা ভূমিপুত্ররাও।
[ ‘ছেলেটাকে কি পুলিশ তুলে নিয়ে যাবে?’, অসমে আতঙ্কে কাঁটা একরত্তির মা-বাবা ]
হাজেলার ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ গোপন রাখেননি অসম প্রদেশ বিজেপির মুখপাত্র রামকৃষ্ণ ঘোষ। তাঁর বক্তব্য, সিস্টেমের একটা অংশে পচন ধরেছে। তার ফলেই বৈধ নাগরিকরাও সুবিচার পাননি। তাঁর দাবি, এনআরসি প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যাঁরা এ কাজ করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া উচিত। যথাযোগ্য শাস্তি হওয়ায় দরকার। এদিকে নাগরিকপঞ্জির অসঙ্গতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হোজাইয়ের বিজেপি বিধায়ক শিলাদিত্য দেবও। তিনি বলেন, “২০১৫ সালে তরুণ গগৈ এনআরসি প্রক্রিয়া শুরু করেন ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, শিলচর করিমগঞ্জের মতো সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায়। সেখানে সংখ্যালঘু অফিসারদেরই নিয়োগ করা হয়। তাঁরাই যে সব হিন্দু বাঙালির নাগরিকত্ব নিয়ে সংশয় ছিল তাঁদের নাম বাতিল করে দিয়েছে।” এছাড়া পাকিস্তান-আফগানিস্তান-বাংলাদেশ থেকে আসা সংখ্যালঘু অর্থাৎ হিন্দুদের ভারতে জায়গা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু এনআরসি-তে সে প্রতিশ্রুতি তো রাখা হয়েইনি, উলটে ভূমিপুত্রদেরও অনেকের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। পার্থ দইমারিদের বিস্ময় আর হতাশাই তাই বলে দিচ্ছে, এনআরসি কেবল ভুলে ভরা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.