মণিশংকর চৌধুরি, হোজাই: ছিল রুমাল হয়ে গেল বিড়াল! ঠিক একইভাবে ছিল হিন্দু, হয়ে গেল মুসলিম। হ্যাঁ, জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নিয়ে যখন উত্তাল গোটা অসম, তখন এমনই বিস্ফোরক চক্রান্ত ফাঁস হল। হিন্দুরা আবেদনপত্র জমা দিলেন আর নাগরিকপঞ্জিতে নাম এল মুসলিমদের। এমন অদ্ভুত ঘটনায় উত্তাল রাজ্য রাজনীতি। এ বিষয়ে এনআরসি অফিশিয়াল এবং পর্যবেক্ষকদের একহাত নিয়েছেন হোজাইয়ের বিজেপি বিধায়ক শিলাদিত্য দেবও।
নাগরিকপঞ্জি সংক্রান্ত একগুচ্ছ তথ্য সংবাদমাধ্যমকে দেওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের ভর্ৎসনার শিকার হয়েছেন এনআরসি অফিসিয়ালরা। এবার ফের তাঁদের চক্রান্তের পর্দা ফাঁস হল। যেখানে একের পর এক ভূমিপুত্রদের নাম বাদ পড়ছে নাগরিকপঞ্জি থেকে, হিন্দু বঙাল খেদাওয়ের অভিযোগ উঠছে, সেখানে এমন তথ্যে আরও বিপাকে এনআরসি কর্তারা। বিজেপি বিধায়ক শিলাদিত্য দেবের অভিযোগ, “২০১৫ সালে তরুণ গগৈ এনআরসি প্রক্রিয়া শুরু করেন ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, শিলচর করিমগঞ্জের মতো সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায়। সেখানে সংখ্যালঘু অফিসারদেরই নিয়োগ করা হয়। তাঁরাই যে সব হিন্দু বাঙালির নাগরিকত্ব নিয়ে সংশয় ছিল তাঁদের নাম বাতিল করে দিয়েছে।” ইচ্ছাকৃতভাবেই চক্রান্ত করে হিন্দুদের নাম বাদ দিয়ে নাগরিকপঞ্জির তালিকায় মুসলিম নাম অন্তর্ভুক্ত করে চলেছে। সেই কারণেই শিবঠাকুরের আপন দেশে সর্বনেশে আইনকানুনের গেরোয় পড়ছেন ভূমিপুত্ররা। তাঁরাই পরিণত হচ্ছেন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীতে।
বুধবার সংবাদ প্রতিদিন-এর কাছে যেসব নথি এসে পৌঁছেছে তা দেখলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে। ফর্মে স্পষ্ট, হিন্দু আবেদনকারীদের নাম পালটে গিয়ে এসেছে মুসলিমদের নাম। বস্তুত কেন্দ্রের সরকারও বারবার বলছে যাঁরা বৈধ নাগরিক তাঁদের সমস্যা হওয়ার কোনও কারণই নেই। কথাও নয়। কিন্তু কোথায় কী! কথায় আর কাজে যে আসমান-জমিন ফারাক তা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছেন অসম-বাংলাদেশ সীমান্তের হিন্দু পরিবারগুলি। এই বিচিত্র বিচারে বিস্মিত তাঁরা। আমচকা অস্তিত্ব সংকটে ভুগতে শুরু করেছেন তাঁরা। কীভাবে এ সমস্যা মিটবে, তারও কোনও সঠিক উত্তর মিলছে না। পরিসংখ্যান বলছে নাগরিকপঞ্জিতে অসমের ভূমিপূত্রদের নামই বেশি কাটা গিয়েছে। তুলনায় নিরাপদ অবস্থানে রয়েছে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি নাগরিকরা। এটা শুধু ফাঁকা অভিযোগ কিন্তু নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে রীতিমতো প্রমাণও রয়েছে। যেমন, অসম-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার কথায়। বাংলাদেশ থেকে কাঁটাতার পেরিয়ে চলে আসা অনুপ্রবেশকারীদের বেশিরভাগই সীমান্ত এলাকায় আস্তানা তৈরি করে। কিন্তু গত সোমবার জাতীয় নাগরিকপঞ্জির তালিকা প্রকাশ
হতেই দেখা যায় সীমান্ত লাগোয়া এলাকাবাসীর অধিকাংশেরই নাম রয়েছে। কিন্তু বোড়োল্যান্ডের বাসিন্দারা এনআরসির আওতায় আসেননি। বিষয়টি নিয়ে রাজ্যের ভিন্ন প্রান্তে ক্ষোভ ছড়িয়েছিল। পরিসংখ্যান বলছে, অসম-বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চল মরিগাঁওয়ের মাত্র ১৪.৯৬ শতাংশ বাসিন্দার নাম এনআরসি থেকে বাদ পড়েছে। নলবাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে এনআরসি-তে নেই মাত্র পাঁচ শতাংশের নাম। একইভাবে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী অধ্যুষিত ধুবড়ির ৮.৩ শতাংশ বাসিন্দা এনআরসি-র আওতায় আসেননি।
উলটো ছবিটা আরও ভয়াবহ। আপার অসম, অর্থাৎ ভূমিপুত্ররাই যেখানকার বাসিন্দা। সেই তিনসুকিয়া জেলার ১৩.৪ শতাংশ বাসিন্দার নাম কাটা গিয়েছে এনআরসি-তে। একইভাবে কার্বিআংলং জেলার ১৪.৩৩ শতাংশ বাসিন্দারও আজ এনআরসি-র কোপে পরিচয় হারিয়েছেন। শিবসাগরে ৯.৯ শতাংশ মানুষের নাম নেই নাগরিকপঞ্জিতে। পরিসংখ্যান যত বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ক্ষোভের মাত্রা। হতাশায় অনেকেই বাকরুদ্ধ।
ভুলে ভরা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নিয়ে অসন্তোষ যেন দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। নিত্যদিনই নতুন সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে অসমে। এবার কেন বা কীভাবে হিন্দুদের নাম পালটে মুসলিম হয়ে গেল, সে প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া যাচ্ছে না এনআরসি কর্তাদের থেকে। সাধারণ মানুষের চূড়ান্ত সংকটে রাজনীতির খেলায় মেতে উঠেছে শাসক ও বিরোধীরা। কিন্তু সমস্যার কোনও সমাধান হবে কিনা, সে উত্তর এখনও অধরা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.