চন্দ্রচূড় ঘোষ, নেতাজি গবেষক: গত কয়েক বছরে ভারতীয় রাজনীতিতে নেতাজি (Netaji Subhas Chandra Bose) চর্চা বেশ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, এটা অনস্বীকার্য। এর সূত্রপাত ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ ও কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা নেতাজি সংক্রান্ত ফাইল ডিক্লাসিফিকেশন দিয়ে। তারপর হয়েছে লাল কেল্লায় নেতাজি মিউজিয়াম, ঘটা করে নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকী, ২৩ ও ২৬ জানুয়ারি একযোগে উদযাপন, আন্দামান দ্বীপের পুনর্নামকরণ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ– দিল্লির প্রাণকেন্দ্রে নেতাজির বিশাল মূর্তি স্থাপন। ২১ অক্টোবর আজাদ হিন্দ প্রতিষ্ঠা দিবসও ইদানীং পালন করা হয়। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বা শিক্ষার জগতে– তা স্কুলই হোক বা গবেষণাভিত্তিক উচ্চশিক্ষাই হোক– এখনও গান্ধী, নেহরু, আম্বেদকর বা মার্কসের ধারেকাছেও সুভাষচর্চা পৌঁছয়নি।
সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় চিন্তাভাবনা নিয়ে মৌলিক গবেষণার অভাব অত্যন্ত দৃষ্টিকটূ। চিন্তাবিদ হিসাবে তাঁর সঠিক মূল্যায়ন এখনও হল না। ফলে সুভাষ আজও বিপ্লবী যোদ্ধার ভূমিকাতেই বছরে চারদিনের হুজুগ ও রাজনীতির মঞ্চে গরম তর্কে সীমিত থেকে গেলেন। সুভাষচন্দ্রের জীবন ও মনন নিয়ে চর্চা যেমন অকিঞ্চিৎকর, তেমনই তাঁর অন্তর্ধান নিয়ে প্রশ্নগুলোও সরকারিভাবে জিইয়ে রাখা হয়েছে। এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারি যে, কেন্দ্রীয় সরকার যদি চায় তবে একমাসের মধ্যে সত্য উদ্ঘাটন করতে পারে।
দেশের যাঁরা শীর্ষ নেতা-নেত্রী, সত্যটা তাঁদের অজানা নয়; পূর্ণ সত্য জানা না থাকলেও অনেকেরই পরিষ্কার একটা ধারণা আছে। প্রশ্ন হল, তাহলে সত্যটা কেউ সামনে আনছেন না কেন? তার কয়েকটা কারণ আছে। রহস্যটা জিইয়ে রেখে বিতর্কটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তাতে রাজনৈতিক ফায়দা তোলা যায়। সম্পূর্ণ সত্যটাকে প্রকাশ করে দিলে কারওই আর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের উপর সে-নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। জনমত বা জনরোষ কত তীব্র হবে বা কোনদিকে মোড় নেবে তা কেউ জানে না। সব সরকারই এই অনিশ্চয়তাকে ভয় পেয়ে এড়িয়ে যেতে চায়। তারা ভাবে, খাল কেটে কুমির আনার কী প্রয়োজন?
যেমন চলছে চলুক না। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের একটা বিশেষ ভূমিকা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রায় সব বাঙালিই নিজেকে সুভাষচন্দ্রের অনুরাগী বলে ঘোষণা করে থাকেন। কিন্তু অনেকে এও বলে থাকেন যে সেটা যদি সত্যিই হত, তাহলে এত বড় একটা রহস্যের কিনারা অনেকদিন আগেই হয়ে যেত। সত্যিটার অবস্থান এর মাঝখানে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সাধারণ বাঙালিদের (আমি বুদ্ধিজীবীদের এর মধ্যে ধরছি না) সুভাষচন্দ্রের প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা অকৃত্রিম ও অপরিসীম।
কিন্তু এটাও বোঝার প্রয়োজন আছে যে সুপ্ত প্রেমের লাজুক চাউনি দিয়ে কিছু হবে না। সুভাষচন্দ্রকে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দিতে গেলে ও তাঁর অন্তর্ধান রহস্যের সত্যটাকে জানতে হলে ভালবাসার মধ্যে একটু আগ্রাসন দেখাতে হবে। সুভাষকে বুকের গভীর থেকে বের করে অন্তত জিভের ডগায় আনতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি যে, এ রাজ্যের ৪২ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে যদি ৫ জনও সংসদ চত্বরে অনশনে বসেন, তাহলে কোনও সরকারই তাঁদের দাবি অগ্রাহ্য করতে পারবে না।
ভোটাররা তাঁদের এলাকার জনপ্রতিনিধিদের কাছে বা ভোটপ্রার্থীদের কাছে দাবি করুন যে তাঁরা যেন সংসদে ও বিধানসভায় নেতাজির বিষয় উত্থাপন করেন। অন্যথায় ভোট নয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার রেজোলিউশন পাস করাক যাতে কেন্দ্রীয় সরকার নেতাজিকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর ও ব্রিটিশ রাজের পলায়নের জন্য তাঁর মুখ্য ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেয়। এর পর ধরনায় বসতে হলে যেন বাঙালি নেতারা সুভাষ-মূর্তির নিচে বসেন। অন্য কথায়, প্রতিটি বাঙালি সুভাষচন্দ্রকে বুক থেকে বের করে জনসমক্ষে নিয়ে এসে তাঁর জন্য লড়াই করুন। বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনীও পাওয়া যায় না। শুধু কথাই বাড়ে।
অনেকেই প্রশ্ন করবেন যে, একমাসের মধ্যে কেমন করে নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য ভেদ সম্ভব? আসলে ব্যাপারটা যতটা জটিল ভাবছেন, আদতে তা নয়। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছার। কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করুক একটি নিরপেক্ষ, মাল্টিডিসিপ্লিনারি টাস্ক ফোর্স, যা কাজ করবে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে। সংসদে আইন পাস করে নেতাজি-সংক্রান্ত সব নথি ওই টাস্ক ফোর্সকে দেখানো হোক এবং জনসমক্ষে আনা হোক। কোনও সরকারি সংস্থাকেই যেন এর বাইরে রাখা না হয়, তা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোই হোক, বা RAW বা মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সই হোক, অথবা হোক রাজ্য সরকারগুলির অধীনে থাকা সিআইডি বা স্পেশাল ব্রাঞ্চ।
প্রত্যেক সরকারি কর্মচারী ও উচ্চপদে থাকা বর্তমান ও প্রাক্তন রাজনীতিককে নেতাজি বিষয়ে তাঁদের পদের গোপনীয়তার শপথ থেকে মুক্ত করা হোক। প্রয়োজনীয় ফরেনসিক পরীক্ষা করা হোক নিরপেক্ষ বেসরকারি পরীক্ষাগারে একটি মনিটরিং কমিটির তত্ত্বাবধানে, যাতে কোনও গোলমাল কেউ করতে না পারেন। তারপর দেখুন কতদিন সময় লাগে। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা করানোর জন্য কি পশ্চিমবঙ্গ নেতৃত্ব দেবে?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.