মণিশঙ্কর চৌধুরী: ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’- নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের এই একটি মাত্র ডাকে হাজার হাজার ভারতবাসী প্রাণ আহুতি দিয়েছিলেন স্বাধীনতার মহাযজ্ঞে। আজ সমস্ত দেশে পালিত হচ্ছে, আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিষ্ঠাতা নেতাজির ১২০তম জন্মবার্ষিকী। তবে স্বাধীনতার পর প্রায় ৭০ বছর পেরিয়ে এলেও রহস্যে আবৃত নেতাজির মৃত্যু। আদৌ কি বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল তাঁর?
অনেকেই বিশ্বাস করেন বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি। কখনও আবার কোনও কোনও নথি সামনে এসে সেই ধারণা বদলে দিয়েছে। তাহলে কী হয়েছিল? ‘ইন্ডিয়াজ বিগেস্ট কভার আপ’ নামে তাঁর বইয়ে রহস্যের আবরণ অনেকটাই খুলে দিয়েছেন বিখ্যাত সাংবাদিক অনুজ ধর। প্রায় ২০০র বেশি গোপন সরকারি নথি-পত্র দেখিয়ে তিনি দাবি করেছেন যে ১৯৪৫ সালে তাইওয়ানে ঘটা বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি। তিনি আরও দাবি করেন, সেই সময়কার কংগ্রেস সরকার আসল সত্য চাপা দিয়েছিল। এই চক্রান্তের অংশীদার ছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, এমনটাও দাবি তাঁর।
অনুজ ধরের বক্তব্য অনুযায়ী, নেতাজির মৃত্যু বিমান দুর্ঘটনায় হয়নি। মিত্রশক্তির কাছে জাপানের আত্মসমর্পণের পর নেতাজি সম্ভবত রাশিয়া চলে যান। তারপর থেকে তাঁর আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। এই বিতর্কের অবসান ঘটাতে ১৯৫৬ সালে শাহ নওয়াজ খান কমিটি ও ১৯৭০ সালে জাস্টিস জি ডি খোসলা কমিশন গঠন করা হয়। তাঁদের রিপোর্টে বলা হয় তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়। যদিও অনুজ ধর দাবি করেন ওই দুটি কমিটির সামনে তখনকার কংগ্রেস সরকার ও আইবি (ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো) সঠিক তথ্য তুলে দেয়নি। এরপর ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর আমলে গঠন করা হয় জাস্টিস এম কে মুখার্জী কমিশন। এই কমিশনের সামনে দেওয়া এক বয়ানে প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন যে, তিনি বিশ্বাস করেন নেতাজি বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। এরপরই ২০০৫ সালে মুখার্জী কমিশন ইউপিএ সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করে। বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যু হয়নি বলে রিপোর্টে বলা হয়। আশ্চর্যজনক ভাবে মুখার্জী কমিশনের রিপোর্ট অগ্রাহ্য করে ইউপিএ সরকার।
অনুজ ধরের বইটিতে আরও বলা হয় যে, জহরলাল নেহেরু প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন, নেতাজির এলগিন রোড ভবনে নজর রাখত কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। নেতাজির বাড়ির সব চিঠিপত্র পড়ে দেখতেন তাঁরা। বাড়ির লোকেদের উপরও কড়া নজর রাখা হত। যদি নেতাজি বিমান দুর্ঘটনায় মারাই গেছেন তবে এত নজরদারি কেন? তবে কি নেহেরু জানতেন নেতাজি জীবিত আছেন?
এই বই থেকেই জানা যাচ্ছে, তাইওয়ান সরকার ইতিমধ্যে জানিয়েছে যে নেতাজিকে বয়ে নিয়ে যাওয়া কোনও বিমান ওই দেশে দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়নি। তিনি আরও দাবি করেন যে, ফৈজাবাদের গুমনামী বাবা, যিনি ১৯৮৫ সালে মারা যান, তাঁর ও নেতাজির মধ্যে অদ্ভুত মিল ছিল। ২০১০ সালে একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া বয়ানে জাস্টিস মুখার্জী গুমনামী বাবার কথা উল্লেখ করেছিলেন।
১৯৭১ সালে উসমান প্যাটেল নামে নেতাজির এক দেহরক্ষী খোসলা কমিশনকে দেওয়া একটি বয়ানে বলেন যে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, মহম্মদ আলী জিন্নাহ ও মৌলানা আজাদ ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিলেন। ওই চুক্তিতে বলা হয়েছিল যে নেতাজি ভারতে ফিরে এলে, তাঁকে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্বর্গীয় রাম রাহুল তাঁর এক বন্ধু রাই সিং যাদবকে বলেছিলেন যে, নেতাজি রাশিয়ায় আছেন। অধ্যাপক রাহুলের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট স্তালিনের বিশ্বস্ত সহকারী বাবাজান গওফ্রাভয়ের সুসম্পর্ক ছিল। সেই সূত্রেই তিনি নেতাজির কথা জানতে পারেন বলে তাঁর দাবি। পরে অধ্যাপক রাহুল মৃত্যুসজ্জায় তাঁর এক বন্ধু রাই সিং যাদবকে এই কথা বলেন। রাই সিং সেই সময় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপ্তরে উচ্চপদে ছিলেন। তিনি অনুজ ধরকে লেখা একটি চিঠিতে বলেন যে, নেতাজি সোভিয়েত ইউনিয়নে আছেন। তিনি সোভিয়েত-মানচুরিয়া সীমান্তের আসেপাশেই কোথাও ছিলেন বলে দাবি করেন রাই সিং। জাপানের রেনকোজি মন্দিরে রাখা অস্থি-ভস্ম নেতাজির নয় বলেও ইঙ্গিত মেলে অনুজ ধরের বইটিতে।
তবে বিতর্ক যতই থাক, নেতাজি আজ ভারতবাসীর হৃদয়ে স্বমহিমায় বিরাজমান। তার মৃত্যু ঘিরে থাকা রহস্যের সমাধান আদৌ সম্ভব হবে কিনা তা সময় বলবে। তবে এটুকু বলাই যায় যে নেতাজি যদি সেই সময় স্বাধীন ভারতের হাল ধরতেন তাহলে ভারত আজ আরও এগিয়ে যেত।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.