মনিশংকর চৌধুরি, গুয়াহাটি: সময় যত গড়াচ্ছে, চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জির ফাঁকফোকর ততই প্রকট হচ্ছে। হাতে আসা তথ্য খতিয়ে দেখে চরম বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলছেন অনেকেই। বাদ পড়া ১৯ লক্ষের মধ্যে ১০ লক্ষই হিন্দু বাঙালি। দেশ গড়ার কারিগর বা এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেকেরই নাম ওঠেনি এনআরসি তালিকায়। এবার বিস্ময়ের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল আরও একটি তথ্য। অবিভক্ত ভারতে জন্মকর্ম, তা সত্ত্বেও স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরবর্তী প্রজন্মের কারও নাম নেই নাগরিকপঞ্জিতে।
অসমের শ্রীহট্টে (বর্তমানে বাংলাদেশের সিলেট)বাংলার ১৩১১ সালের ২৬ জ্যৈষ্ঠ জন্ম স্বাধীনতা সংগ্রামী যোগেশ দেবের। পড়াশোনার জন্য চলে আসেন অসমের মূল ভূখণ্ডে। ছাত্রাবস্থাতেই জড়িয়ে পড়েছিলেন দেশ স্বাধীন করার পবিত্র, মহৎ কাজে। ১৯৪২এ গান্ধীজির ডাকে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে সাড়া দিয়ে চলে যোগেশ দেব চলে এসেছিলেন অবিভক্ত মেদিনীপুরে। কাঁথির কর্মসূচিতে তাঁর নেতৃত্বেই স্বদেশিরা নুন তৈরি করেন। স্বাধীনতার পর সংগ্রামীর শংসাপত্র তুলে দেওয়া হয়েছিল যোগেশ দেবের হাতে। তাঁর হাতে লেখা ডায়েরির পড়ে জানা যায়, পরবর্তী সময়ে অসমে ভাষা আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যোগেশ দেব। দিল্লি গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে এনিয়ে দরবার করেছিলেন।
১৯৭১এ ভোটার তালিকায় নাম ছিল তাঁর এবং পরিবারের সদস্যদের। তখন যোগেশ দেবের বয়স ৬৬বছর। এত কিছু ছিল, আর আজ একটা তালিকায় সব নেই হয়ে গিয়েছে।
আপার অসমের গোলাঘাট জেলার বড়পাথারে বর্তমান বাস যোগেশ দেবের পরিবারের। তিন ছেলে জগদীশ, দিলীপ এবং জ্যোতির্ময়ের মধ্যে বড় ছেলে প্রয়াত। রয়েছেন বাকি দুই ছেলে এবং তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম। ৩১ আগস্টের পর থেকে যাঁরা নিজেদের ফের পরাধীন মনে করছেন। গোড়া থেকে অসমের বাসিন্দা, ভারত সরকারের দেওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামের শংসাপত্র, একাত্তরের ভোটার তালিকায় নাম – এসবই একলহমায় মিথ্যে হয়ে গেল। নাগরিকত্বের এতশত প্রমাণ মিথ্যে হয়ে গেল নাগরিকপঞ্জির তালিকায়। সেখানে অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজেও পাওয়া গেল না জ্যোতির্ময় দেব বা দিলীপ কুমার দেবের নাম কিংবা তাঁর ছেলে-নাতি-নাতনিদের নাম। তাঁদের বক্তব্য, ‘আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামীর বংশধর। কিন্তু আজ তো আমরা স্বদেশেই পরাধীন হয়ে গেলাম।’ এও কি সম্ভব? বিস্ময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রশ্নের উত্তর হাতড়েই
বেড়াচ্ছেন তাঁরা।
এদিকে, এনআরসি-র তালিকা নিয়ে ক্ষোভ ক্রমশই বাড়ছে অসমজুড়ে। শুক্রবার রাজ্যজুড়ে ১২ঘণ্টা বনধের ডাক দিয়েছে অল অসম স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (আসু)-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক সংগঠনগুলি। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈর পরামর্শে সাড়া দিয়ে বাঙালি যুব ছাত্র ফেডারেশন ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের বিরোধিতা করেছে। সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি তপোজ্যোতি সেনের কথায়, ‘বাদ পড়া কেউ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে যাবেন না। কারণ, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশমতো এনআরসি প্রক্রিয়া চলাকালীন সমস্ত নথিপত্র জমা দিয়েছি, যথাসাধ্য সহযোগিতা করেছি। তারপরও নাম ওঠেনি। তাহলে অপরাধীর মতো কেন ফের ট্রাইব্যুনালে যাবেন?’
প্রকাশিত নাগরিকপঞ্জির তালিকা এখনও হাতে পায়নি রাজ্য সরকার। এনিয়ে এনআরসি কো-অর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলাকে বৈঠকে ডেকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়াল। সূত্রের খবর, তিনি বৈঠকে যাবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। আসলে ৭ তারিখ আরও একটি আপডেটেড তালিকা প্রকাশিত হবে। সেখানে কয়েকজনের নাম উঠবে বলে আশা। তারপরই হাজেলা বিস্তারিত তালিকা সরকারের হাতে তুলে দিতে পারেন হাজেলা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.