মলয় কুণ্ডু, মুঙ্গের: বেগুসরাই থেকে ট্রেনটা ইংরেজি ইউ আকারের পাক খেয়ে গিয়ে পৌঁছায় মুঙ্গেরে। বিহারের ট্রেনের অচেনা ভিড়ে গা ভাসিয়ে গাদাগাদি করে রয়েছি যখন, তখনই বোধহয় অ-বিহারী মুখ দেখে কী যেন মনে হল এক কিশোরের। দেহাতি ভাষায় পাশের লোককে কী সব বলে চাপাচাপি করে তার পাশে কোনওক্রমে এক চিলতে জায়গা বের করে ইশারায় বসে পড়তে বলল। দু’চার কথায় আলাপ জমার পর নাম বলল, বিকাশ। আমার গন্তব্য আর কার্যকারণ শুনে বলল, “যাচ্ছেন যান। কিন্তু মজাটা পাবেন না। লোকসভা ভোটে আর কী দেখবেন? বিহারের ভোটে বাহুবলী দেখতে গেলে আসতে হবে সামনের বছর। বিধানসভা ইলেকশনে দেখবেন কার শক্তি কত।”
[যুদ্ধজাহাজ বিক্রমাদিত্যে আগুন, মৃত নৌসেনার এক অফিসার]
আর সেই ‘মুঙ্গের মেড’? প্রসঙ্গ তুলতেই কিছুটা চুপ করে গেল বিকাশ। উত্তর শুনে মনে হল, সেটা আছে ঠিকই, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়!
পরের কয়েক ঘণ্টায় এটা বোঝা গেল সেই হাইলি সাশপিশাস বিষয় থেকে বেরিয়ে আসার একটা চেষ্টা চালাতে চাইছে মুঙ্গের। যে শহরে অস্ত্রশিল্প প্রায় কুটির শিল্পের পর্যায়ে গিয়েছিল, সেই ‘ইন্ডাস্ট্রি’ নাকি একটু একটু করে অনেকটাই কমে এসেছে। কারখানা আর জামালপুরের লোকোমোটিভ সারানোর কারখানায় কাজ মিলছে। তাই বন্দুক-পিস্তল তৈরি থেকে বেরিয়ে আসারও একটা চেষ্টা শুরু হয়েছে। সেটাই বোঝাচ্ছিলেন কৃষক বল্লভ চৌরাশিয়া। সঙ্গে পুলিশি কড়াকড়িও নাকি বেড়েছে অনেকটাই। নতুন এক ‘দাবাং’ ধরনের পুলিশ কর্তাকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছে এখানে। তার পর থেকেই মুঙ্গের, জামালপুর, সূর্যগ্রহ, লক্ষ্মীসরাই, বাহর, মোকামায় কমেছে ক্রাইম রেট। তাহলে? প্রশ্নটা শুনে যা জানালেন তিনি, তার সারমর্ম হল, আছে, কিন্তু তা জঙ্গলের দিকের গ্রামগুলোয়। শহরে বসে তার আঁচ পাওয়া মুশকিল।
বরং এসবের মাঝে এখন যেটা আলোচনার তা হল বিহারের পূর্বাঞ্চলের এই জেলায় বাহুবলীর স্ত্রীর প্রার্থী হওয়া। আরজেডি-কংগ্রেসের মহাজোট মুঙ্গেরে প্রার্থী করেছে মোকামার বাহুবলী অনন্ত সিংয়ের স্ত্রী নীলম দেবীকে। কংগ্রেসের টিকিটে প্রার্থী হয়েছেন নীলম। তাঁকে টক্কর দিতে নীতীশ কুমারের জেডিইউ ভোট-ময়দানে নামিয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী রাজীবরঞ্জন সিং ওরফে লালন সিং-কে। এই লালনই গতবার মুঙ্গেরে হেরেছিলেন এলজেপি-র বীণাদেবীর কাছে। এই বীণাদেবী আবার বাহুবলী নেতা সুরজভান সিংয়ের স্ত্রী। তাহলে কি সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে? এ বিষয়ে মুঙ্গেরের আরজেডি নেতা প্রমোদ যাদবের বক্তব্য অবশ্য বেশ স্পষ্ট। “অনন্ত একাধিকবার বিধানসভা ভোটে জিতেছেন। মোকামা, মুঙ্গেরে যথেষ্ট কাজও করেছেন। অনেক আলোচনার পরই দল তাঁর স্ত্রীকে প্রার্থী করেছে। বাহুবলী তকমা লাগিয়ে রাখলে বিরোধীদের সুবিধা হবে, সেই কাজটাই করছে জেডিইউ।”
যদিও অনন্তের অপরাধ জগতের ট্র্যাক রেকর্ডে অন্তত ১৮টি খুন, অপহরণ, তোলা আদায়, এবং অস্ত্র আইনের অভিযোগ রয়েছে। সমর্থকরা তাঁর প্রভাবের জন্য ডাকেন ‘ছোটে সরকার’ নামে। প্রভাব এতটাই যে, ২০১৫ সালে জেলে বসেই বিধানসভায় জিতেছিলেন তিনি। তখনই তাঁর স্ত্রী নীলমকে প্রচার করতে দেখেছিলেন এলাকার লোকজন। এবার তিনি ‘মুঙ্গের কি বহু’ বলে ভোটভিক্ষা করতে নেমেছেন। আর এই সরকার-রাজকে চ্যালেঞ্জ জানাতেই অনেক হিসেবনিকেশ করে নীতীশ মাঠে নামিয়েছেন তাঁর কাছের লোক বলে পরিচিত লালনকে। মাথায় রাখা হয়েছে জাতপাতের অঙ্কও। নীলম ও লালন দু’জনেই ভূমিহার। এই আসনের মধ্যে থাকা বেশ কয়েকটি বিধানসভা কেন্দ্রে ভূমিহারদের দাপট অনেকটাই। সেই ভোটে কার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে, তার উপরই নির্ভর করছে ভোট-ভবিষ্যত।
বিহারের ভোটে বাহুবলীদের রমরমা অবশ্য নতুন কিছু নয়। এবার যাঁরা নিজেরা প্রার্থী হতে পারেননি, তাঁরা স্ত্রী অথবা নিকটাত্মীয়কে প্রার্থী করতে পেরেছেন। এমন অন্তত ছ’জন এবার লোকসভায় বিভিন্ন দলের প্রার্থী হয়েছেন বলে খবর। নওদা থেকে আরজেডি প্রার্থী করেছে রাজবল্লভ যাদবের স্ত্রীকে। এই রাজবল্লভের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। এলজেপি এবার বাহুবলী সুরজভানের স্ত্রী বীণাদেবীকে প্রার্থী না করে সুরজভানের ভাই চন্দনকুমার সিংকে এই আসনে প্রার্থী করেছে। আরজেডির টিকিটে প্রার্থী হয়েছেন হিনা সাহিব। সিওয়ানের মাসলম্যান ও সাজাপ্রাপ্ত মহম্মদ শাহাবুদ্দিনের স্ত্রী হিনা ২০০৯ ও ২০১৪ সালে ভোটে দাঁড়িয়েও হালে খুব একটা পানি পাননি। তাঁর বিরুদ্ধে আবার জেডিইউ প্রার্থী আরেক বাহুবলী অজয় সিংয়ের স্ত্রী কবিতা সিং। আরজেডি প্রাক্তন সাংসদ প্রভুনাথ সিংয়ের পুত্র রণধীর সিংকে প্রার্থী করেছে মহারাজগঞ্জ থেকে। এই প্রভুনাথের বিরুদ্ধেই ২০১৭ সালে খুনের অভিযোগ রয়েছে। শুধুমাত্র বাহুবল, না পিছনে বিপুল জনসমর্থন, জেতার লড়াইয়ে কোনটা কাজে দেয়, সেটাই দেখার মুঙ্গের থেকে নওদায়।
[‘মোদির মুখে ঝামা ঘষে বিজেপি শাসনের অবসান ঘটাবেন মমতা’, হুঁশিয়ারি অভিষেকের]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.