সোমনাথ রায়, নয়াদিল্লি: সেনাবাহিনীর ব্যাগ পাইপাররা তখন তুলেছেন ‘অ্যায় মেরে বতন কে লোগোঁ’র সুর। সাউন্ড সিস্টেম থেকে ভেসে আসা সেই সুরে গায়ে যখন কাঁটা দিচ্ছে, তখনই হাইওয়ের উপর থেকে কানে এল সেনা কর্ডনের কর্কশ চিৎকারের সতর্কবার্তা। বৃহস্পতি ও শুক্রবার কার্গিল যুদ্ধ স্মারকের সামনে থেকে যাওয়া শ্রীনগর-লে হাইওয়েতে দাঁড় করানো যাবে না কোনও গাড়ি। খোলা যাবে না কোনও দোকান। মেমোরিয়ালে ঢুকতে না পারার হতাশা নিয়ে বাইরে থেকে ফিরে যেতে হচ্ছে সাধারণ দর্শকদের।
২৪ থেকে ২৬ জুলাই। প্রতি বছরই এই তিনদিন যুদ্ধ স্মারকে সাধারণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকে। কিন্তু অন্যবারের থেকে এবারের ছবিটা অনেকটাই আলাদা। অন্যবার স্মারকের উলটোদিকের দোকানপাট খোলায় কোনও নিষেধাজ্ঞা থাকে না। এবার আছে। কেন? আসলে এবার বিজয় দিবসের রজতজয়ন্তী। আর গর্বের এই দিনকে আরও মহিমান্বিত করতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। গত ২৫ বছরে যা কখনও হয়নি। পাঁচ বছর আগে বিজয় দিবসের দুই দশক পূর্তির অনুষ্ঠানে থাকার কথা ছিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের। তবে আবহাওয়ার কারণে জম্মুর রাজভবন সংলগ্ন হেলিপ্যাড থেকে তাঁকে নিয়ে উড়তেই পারেনি সেনাবাহিনীর চপার। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় যাতে কোনও ফাঁক না থাকে, তাই মঙ্গলবার থেকেই এলাকার দখল নিয়ে নিয়েছে এসপিজি। তাদের নির্দেশেই ২৫ ও ২৬ জুলাই যুদ্ধ স্মারকের সামনে কার্যত কারফিউ পরিস্থিতি। যা নিয়ে বেশ বিরক্তি প্রকাশ করতেও দেখা গেল স্থানীয়দের।
মেমোরিয়ালের উলটোদিকের এক চায়ের দোকানি ইরশাদ বলছিলেন, “দুটো দিন কোনও আয় হবে না। কোনও মানে হয়? এই দিনগুলোয় আপনাদের মতো সাংবাদিকদের পাশাপাশি অনেকে এখানে ভিড় করেন। বিক্রিবাট্টা ভালোই হয়। এবার সব গেল।” পাশে বসা আবিদ আবার প্রধানমন্ত্রীর আগমন নিয়ে কিছুটা আশাবাদী। বললেন, “এখানে এসে যদি আমাদের দুর্দশার কথা মাথায় ঢোকে প্রধানমন্ত্রীর! বছরের একটা বড় সময় বরফে ঢাকা থাকায় আমাদের যে কী ভোগান্তি হয়, বলে বোঝাতে পারব না।” একই সঙ্গে বললেন, “অবশ্য তিন বছর আগেও তো দীপাবলির সময় এসেছিলেন। কী আর লাভ হল?”
স্থানীয়দের ভোগান্তি নিয়ে অবশ্য বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই এসপিজির। হয়তো তা স্বাভাবিকও। একে তো প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা, তাও আবার সেই এলাকায়, যেখানে আজ থেকে ২৫ বছর আগে তিন মাস ধরে শ্বেতশুভ্র পর্বতরাজি রক্তে রাঙা হয়ে গিয়েছিল। নিয়ন্ত্রণরেখার কাছাকাছি কার্গিল, দ্রাস জুড়ে তাই বজ্রআঁটুনি। গোটা এলাকাকে ঘোষণা করা হয়েছে ‘নো ড্রোন জোন’ হিসাবে। কিছুক্ষণ বাদে বাদেই কানে তালা লাগিয়ে আকাশপথে চলছে বায়ুসেনার নজরদারি।
শুক্র সকালে দ্রাস ব্রিগেড হেলিপ্যাডে নামবেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে তাঁকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত থাকবেন লাদাখের উপরাজ্যপাল অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার বি ডি মিশ্র। প্রথমেই শহিদ সৌধে মালা দিয়ে শহিদদের শ্রদ্ধা জানাবেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর যাবেন বীরস্থলে। যেখানে কার্গিল যুদ্ধের প্রত্যেক শহিদের নামাঙ্কিত স্মারক রয়েছে। দেখা করবেন বীর নারী অর্থাৎ শহিদদের স্ত্রী, মায়েদের সঙ্গে। এরপর যুদ্ধ স্মারক থেকে জাতির উদ্দেশে দেবেন ভাষণ। বিজয় দিবসের রজত জয়ন্তীর সাক্ষী থাকবেন, কারগিল যুদ্ধে লড়াই করা দেশের বীর সৈনিকরা। সূত্রের খবর, আরও একবার দেশবাসীকে তাঁরা শোনাবেন কীভাবে সেবার পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিলেন ভারতীয় বীরেরা। ফের ওই ধরনের দুঃসাহসিকতা দেখালে পাকিস্তানের ভূগোল বদলে দেওয়ার বার্তাও দিতে পারেন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল বেদ প্রকাশ মালিকরা।
কারগিল বীর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উপস্থিত হচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা জওয়ান, তাঁদের পরিবার। এসেছে স্থানীয় বেশ কয়েকটি ব্যাটালিয়নের এনসিসি ক্যাডেটরাও। গোটা কারগিল যুদ্ধ স্মারক জুড়ে চলছে শেষ তুলির টান। বীর পথের দুধারে থাকা শহিদদের স্থায়ী মূর্তি ছাড়াও লাগানো হচ্ছে শহিদ বিক্রম বাত্রা, গণেশ যাদব, মনোজকুমার পাণ্ডে, অনুজ নায়ারদের ছবি। প্রধান ফটকের ঠিক উল্টোদিকে বসেছে নতুন ভাস্কর্য। সব মিলিয়ে চিরশত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হওয়া শেষ যুদ্ধের রজত জয়ন্তী বর্ষে সেই গৌরবগাথা দেশবাসীকে আরও একবার মনে করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারেও তাচ্ছিল্যের বার্তা পৌঁছিয়ে দেওয়ার কাজও চলছে পুরোদমে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.