অনুরাগ রায়, মান্ডি: ছোট্ট শহরটাকে প্রকৃতি তার সৌন্দর্য দিয়েছে উজাড় করে। একদিকে জঙ্গল ছায়া দিচ্ছে। অন্যদিকে পাহাড়িয়া এলাকায় সুর তুলে বয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট ঝরনা। কথা ছিল, সেই সুরে সুরে এবার বেজে উঠবে কঙ্গনা রে, কঙ্গনা রে…! অথচ ইতিউতি ঘুরে দেখা গেল, বেজে উঠছে বেরোজগার। মান্ডির মন্দিরের গায়ে গায়ে এখনও লেগে আছে মোদি হাওয়া। তবে সেই হাওয়ায় পদ্ম দুলে উঠবে কিনা, তা এক কথায় নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
অর্থাৎ, মান্ডির ভোটের(Mandi Lok Sabha Election 2024) অঙ্কটা আর সরল নেই। যাকে বলে একেবারে, সিঁড়িভাঙা। লড়াইটা হয়ে দাঁড়িয়েছে আত্মপ্রতিষ্ঠা বনাম আত্মরক্ষার। রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বনাম রাজনৈতিক অস্তিত্বরক্ষার। এমনিতে মান্ডিকে অনেকে বলে থাকেন, হিমাচলের বারাণসী। কেউ কেউ বলেন ‘ছোটি কাশী’। বারাণসীতে যেমন পুরনো পাথরের অসংখ্য মন্দির রয়েছে, হিমাচল প্রদেশের মান্ডিতেও তেমন ৮১টি পুরনো পাথরের মন্দির আছে। কুল্লু-মানালির মতো বিশ্বখ্যাত পর্যটন ক্ষেত্রও এই মান্ডি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যেই পড়ে।
তবে ভোটের বাজারে মান্ডি ফোকাস কেড়ে নিয়েছে বলিউডের ‘ক্যুইন’ কঙ্গনার দৌলতে। তিনি ঘোষিত মোদিভক্ত। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেশপ্রেমের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছেন বহুবার। এমনকী বলিউডের আধিপত্যের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করতে দ্বিধা করেননি। কোনও কিছুতেই ছেড়ে কথা বলার পাত্রী নন। অতএব ট্যুইটার তাঁকে ব্যান করুক যার যাই করুক, তিনি সদাসর্বদা রণং দেহি! দেখেশুনেই বিজেপি এবার তাঁকে লোকসভার টিকিট দিয়েছে। তবে বলা যায়, একেবারে ফেলে দিয়েছে সাপলুডোয় সাপের মুখে। কঙ্গনার লক্ষ্য রাজনীতির মই, ওদিকে সামনে স্বয়ং ‘রাজাসাহেব’।
রাজাসাহেবের পরিচয় দেওয়া জরুরি। ইতি বিক্রমাদিত্য সিং (Vikramaditya Singh)। মান্ডির প্রয়াত রাজা বীরভদ্র সিংয়ের পুত্র। বীরভন্দ্র সিং হিমাচলের রাজনীতিতে কিংবদন্তি। বহুবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। হিমাচলে ‘বীরভদ্র মডেল’ বেশ জনপ্রিয়। যার সুফল সবচেয়ে বেশি পেয়েছে মান্ডিই। বিক্রমাদিত্যর বয়স মোটে ৩৩। আপাতত তিনি হিমাচলের সড়ক পরিবহণ এবং পূর্ত দপ্তরের মন্ত্রী। বিক্রমাদিত্যর মা প্রতিভা সিং আবার মান্ডির বিদায়ী সাংসদ এবং হিমাচল প্রদেশ কংগ্রেসের সভানেত্রী।
কঙ্গনার জন্য মান্ডির লড়াই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা পাওয়ার। কিন্তু বিক্রমাদিত্যর জন্য লড়াইটা নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার। আসলে সদ্য হিমাচলে কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ হয়েছে, নিন্দুকরা বলেন, সেই বিদ্রোহের নেপথ্যে নাকি ছিলেন বিক্রমাদিত্যই! সুখবিন্দর সিং সুখুকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সুপ্ত বাসনা রয়েছে তাঁর মনে। কিন্তু দলে বিদ্রোহ করানোর পরও সরকার ফেলতে পারেননি তিনি। উলটে খানিক অপদস্থ হয়ে বেশ কোণঠাসা মান্ডির ‘রাজা’।
বীরভদ্রের আমলে হিমাচল কংগ্রেসে শেষ কথা ছিলেন তিনিই। কিন্তু প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর প্রয়াণের পর কংগ্রেসে গুরুত্ব কমেছে রাজ পরিবারের। দলের অন্দরে হৃতগৌরব ফিরে পেতে হলে বিক্রমাদিত্যকে মান্ডি জিততে হবে। একমাত্র তখনই হিমাচলের রাজনীতিতে বীরভদ্র পরিবারের আধিপত্য আগের মতো প্রতিষ্ঠিত হবে। বিক্রমাদিত্য হারলে তাঁর এবং বীরভদ্র পরিবারের গুরুত্ব দলে আরও কমবে। তাই মান্ডির লড়াইয়ে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ‘রাজা’সাহেব। তাঁর প্লাস পয়েন্ট হল, এই এলাকা তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা। এলাকাবাসীর সুখদুঃখে সবসময় পাশে থেকেছে তাঁর পরিবার। তাছাড়া রাজপরিবারের একটা নিজস্ব প্রভাব রয়েছে আপার মান্ডি এলাকায়। বিক্রমাদিত্য নিজে শিক্ষিত, মার্জিত, ভদ্র ছেলে। চোখা রাজনীতির ভাষায় কথাবার্তা বলেন। রাজ্যের মন্ত্রী হিসাবে তাঁর কাজ প্রশংসিত। একাধিক জ্বলন্ত ইস্যুও রয়েছে তাঁর হাতে।
তবে পলিটিক্সের ‘নেপোটিজমের’ বিরুদ্ধে কঙ্গনাও কম যান না! তাঁর অ্যাডভান্টেজ হল তিনি পরিচিত নাম। সেলিব্রিটি হিসাবে মহিলা এবং যুবসমাজের মধ্যে বাড়তি জনপ্রিয়তা রয়েছে তাঁর। সেই সঙ্গে অবশ্যই রয়েছে ব্র্যান্ড মোদি। এই রাজনৈতিক আবহেই শহরের স্বরে একবার কান পাতা গেল।
মান্ডির ঠিক মাঝামাঝি পাডেল গ্রাউন্ড। গোটা শহর থেকে তো বটেই আশেপাশের এলাকা থেকেও বহু পড়ুয়া এখানে সকাল-বিকাল পড়াশোনা, শরীরচর্চা বা খেলাধুলো করতে আসেন। সেখানেই কয়েকজন যুবক-যুবতীকে ধরা গেল। এবারের ভোটে মূল ইস্যু কী? কে এগিয়ে? বছর উনিশের এক যুবক বললেন, “আমরা ভোটটা দেব প্রার্থী দেখে। কঙ্গনা অভিনেত্রী হিসাবে ভালো, কিন্তু তাঁর যা ইতিহাস জ্ঞান! এদিকে আমাদের রাজাসাহেব স্থানীয় ইস্যু নিয়ে কথা বলছেন। মান্ডির কথা বলছেন।” পাশ থেকে আরেক যুবক বললেন, “আমরা তাঁকেই ভোট দেবে যে রোজগারের কথা বলবেন। এই সরকারে বিশেষ ভরসা নেই।” ওই প্যাডেল গ্রাউন্ডের আর দু’চার জনের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, মান্ডির যুবসমাজের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হল লাইব্রেরি। আশেপাশের বহু ছেলেমেয়ে শহরে আসেন সরকারি চাকরির প্রস্তুতি সারতে। কিন্তু শহরে ভালো সরকারি লাইব্রেরি নেই। জানা গেল বিক্রমাদিত্য নাকি প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন, সাংসদ হলে তাঁর প্রথম কাজ হবে এলাকায় ভালো লাইব্রেরি গড়া।
প্যাডেল গ্রাউন্ডেই কসরত করছিলেন জনাকয়েক তরুণ। সরকারের উপর বেশ খাপ্পা তাঁরাও। কারণ ‘অগ্নিবীর’। এত পরিশ্রমের পর চার বছরের চাকরি না পসন্দ তাঁদেরও। হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরাখণ্ডের মতো হিমাচলেও ভোটের বড় ইস্যু অগ্নিবীর প্রকল্প। যে কোনও তরুণের সঙ্গে কথা বললে একযোগে সকলেই বলছেন, এই প্রকল্প বাতিল হওয়া দরকার। কেউ কেউ বিজেপির সমর্থক, তাঁরাও চান সরকার এই প্রকল্প বন্ধ করুক। কংগ্রেস সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বলে রাখা দরকার, হিমাচলের একটা বড় অংশের মানুষের পেশা সরকারি চাকরি। মোদি (Narendra Modi) জমানায় চাকরির ‘সুখা’ অতিষ্ঠ করছে হিমাচলকেও। তাছাড়া গত বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ‘পুরনো পেনশন প্রকল্প’ চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। সরকার গড়ার পর সেই প্রকল্প চালুও হয়েছে। তাতে খুশি সরকারি চাকরিজীবীরাও। সমস্যা হল মান্ডি যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সুসজ্জিত, তেমনই প্রকৃতির রুদ্র রোষও সহ্য করতে হয় এই ক্ষুদ্র জেলাটিকে। এই তো কয়েক মাস আগেই প্রকৃতির রোষে কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। সেসময় মাটি কামড়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বিক্রমাদিত্য। সে কথা জনতা ভোলেনি।
২০১৪ এবং ২০১৯। গত দুই নির্বাচনেই মোদি হাওয়ায় হিমাচলের চার আসনই দখল করেছিল বিজেপি। এবার সেই হাওয়ার বেগ কমেছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তায় এখনও বিশেষ ভাটা পড়েনি। হিমাচলের বাকি তিন আসনের মতো এখানেও বিজেপির মূল হাতিয়ার সেই মোদি আবেগই। মহিলাদের মধ্যে কঙ্গনার নিজস্ব একটা জনপ্রিয়তা আছে, সেটাও ঘটনা। কিন্তু এই মহিলাদের একটা বড় অংশ এমনিও বিজেপির ভোটার। ফলে অভিনেত্রী হওয়ার বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন না তিনি। উলটে কয়েকটি ডিসঅ্যাডভান্টেজ আছে। এক, কঙ্গনার অতীতের বহু বয়ান এখনও পিছু তাড়া করছে তাঁকে। ‘ইংরেজি বলতে পারতেন না বলে বল্লভভাই প্যাটেল প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি’, ‘মোদি রামের অবতার’, ‘২০১৪ সালে স্বাধীন হয় ভারত’, অভিনেত্রীর এই সব পুরনো মন্তব্য এখন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল। কংগ্রেস প্রশ্ন তুলছে, এই যার বুদ্ধিমত্তা তিনি সাংসদ হয়ে করবেনটা কী! যুব সমাজও বলছে, এক দিকে শিক্ষিত, পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ, অন্যদিকে এক অভিনেত্রী, যাঁর বাস্তববোধ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, দুজনের মধ্যে কাকে বাছা উচিত, বিকল্পটা সবার জানা! তাছাড়া স্থানীয়দের অনেকের ধারণা, ভোটের পর কঙ্গনা ফিরে যাবেন মুম্বইতে। বিপদে-আপদে তাঁর টিকিটি পাওয়া যাবে না। উলটো দিকে রাজাসাহেব সবসময় মানুষের মাঝে থাকেন। এই ‘বহিরাগত অভিনেত্রী’ আর স্থানীয় রাজপরিবারের সদস্যের লড়াইটা পিছিয়ে দিচ্ছে কঙ্গনাকে।
কঙ্গনার (Kangana Ranaut) পথের কাঁটা হচ্ছে আরও একটি পুরনো ভিডিও। অভিনেত্রী নাকি গোমাংস খান। তাঁরই একটু পুরনো ভিডিও ভাইরাল হয়েছে ভোটের বাজারে। দেবভূমির রক্ষণশীলদের তা একেবারেই না পসন্দ। এখন কঙ্গনা প্রচারের লক্ষ্যে যে মন্দিরেই যাচ্ছেন, নিজের সংগঠনকে কাজে লাগিয়ে সেই সব মন্দির শুদ্ধিকরণ করাচ্ছেন বিক্রমাদিত্য। যা সাড়া ফেলছে রক্ষণশীল হিন্দু মনে। তাছাড়া রক্ষণশীল হিন্দুদের একাংশের আপত্তি রয়েছে কঙ্গনার অভিনয় পেশা এবং পোশাকআশাক নিয়ে। মান্ডি তথা হিমাচলে মুসলিম জনসংখ্যা নগণ্য। তাই হিন্দু-মুসলমান কার্ড বিশেষ কাজে লাগে না। উলটে গোমাংস মন্তব্য কঙ্গনাকেই ব্যাকফুটে ফেলে দিচ্ছে।
তবে, এসবের পরও মোক্ষম অস্ত্র রয়েছে তাঁর হাতে। সেটা হল মোদি-হাওয়া। লোকসভা ভোটে বরাবর দেবভূমি গত দুবার ভোট দিয়েছে মোদিকে। কঙ্গনার নিজের ভাবমূর্তি যা-ই হোক, মোদির ভক্ত সংখ্যা এখনও বহু। মহিলাদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা প্রধানমন্ত্রীর। আবার সেনার সঙ্গে যুক্ত অবসরপ্রাপ্তরাও পছন্দ করেন মোদিকে। শেষমেশ সেই হাওয়া লড়াইয়ে রাখছে কঙ্গনাকে। কিন্তু লড়াইয়ে এগিয়ে আছেন কি তিনি? মান্ডি শহরে পুজোর সামগ্রী বিক্রেতারা বলছেন, “ইহা মাহল বরাবর কা হ্যায়। রাজাসাহাব ছোড়নে ওয়ালে নেহি হ্যায়।” বলে রাখা দরকার, এই মান্ডিতে এ পর্যন্ত ১৬ বার লোকসভা ভোট হয়েছে। ১৩ বার জিতেছে কংগ্রেস। ৯ বার বীরভদ্র পরিবারের সদস্যরা। নিজেদের এই গড় কেনই বা সহজে ছাড়বেন রাজাসাহেব? আবার কঙ্গনাও ছাড়বেন কেন? তাঁর হাতে যে রয়েছে মোদি নামের ব্রহ্মাস্ত্র। সেটাই ফুটে উঠেছিল, বিকেলে স্থানীয় মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়া কয়েকজন মহিলার মুখে। বলছিলেন, “কঙ্গনা বিটিয়া সব লে জায়েগি। হম সির্ফ মোদি কো ভোট করতে হ্যায়।” আরেকজন বললেন, “কঙ্গনা কোয়ি নেহি হ্যায়। লড়াই মোদি অউর কংগ্রেস কি হ্যায়।”
অতএব লড়াই কাঁটায়-কাঁটায়। একেবারে কেউ সুবিধা পাবে তা নয়; আবার কেউ যে পুরোপুরি ব্যাকফুটে চলে গিয়েছেন তা-ও নয়। হিমাচলের বারাণসী তো মাণ্ডি সেই কবে থেকেই! কিন্তু রাজনৈতিক মানচিত্রে বারাণসীর মতো সাদৃশ্য কি এবার এখানেও দেখা যাবে? তবে কে না জানে, চাল আর চালকুমড়ো এক নয়! সবার আগে সে কথা সবথেকে ভালো জানেন মান্ডির মানুষই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.