বিশ্বদীপ দে: ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। স্পর্শ করে সময়ের ডালপালা। ঠিক যেমন এবার ফিরে এল। ১২ নভেম্বর দিওয়ালি। ১৯৪৭ সালেও এই দিনই ছিল আলোর উৎসব। অর্থাৎ স্বাধীন ভারতের প্রথম দীপাবলির দিনক্ষণ ২০২৩ সালে ফের স্পর্শ করল মহাকাল। মাঝে কেটে গিয়েছে ৭৬ বছর। কিন্তু সদ্য স্বাধীন দেশের দেশভাগের যন্ত্রণা এত বছর পরও পুরনো ক্ষতর মতো রক্ত ঝরায়। আর সেই ক্ষতচিহ্নের বিপরীতে জেগে ওঠে একটা মুখ। সে মুখ জাতির জনকের। তিনি মহাত্মা গান্ধী। স্বাধীনতার আনন্দ তখন চাপা পড়ে রয়েছে দেশ ভাঙার আর্তনাদের নিচে। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে গান্ধী যা বলেছিলেন, তা আজও অনুরণিত হয়। হবে আগামী দিনেও।
সে বড় সুখের সময় নয়। ব্রিটিশদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা গিয়েছে। এসেছে বহুকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। কিন্তু দেশভাগের দগদগে ঘায়ের বিনিময়ে। ১৯৪৬ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৪৭ সালের এপ্রিল- ৭৭ বছরের এক বৃদ্ধ ঘুরে বেড়িয়েছিলেন প্রায় ১২০ মাইল। গিয়েছিলেন ৪৭টি গ্রামে। এর মধ্যে নোয়াখালিতেই ছিলেন দীর্ঘ সময়। হানাহানি, রক্তারক্তি, দাঙ্গার বিষ বাতাসে হার না মানা জেদে শীর্ণ চেহারার মানুষটির অনমনীয় ছায়া আজও ইতিহাসের পাতায় বেঁচে রয়েছে অবিকল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তাঁর হৃদয় বিষণ্ণতায় ডুবে রয়েছে।
আসলে দেশভাগ যে তিনি একেবারেই চাননি। সমাজতাত্ত্বিক রাজনীতিবিদ রামমনোহর লোহিয়া তাঁর ‘ইন্ডিয়াজ কালপ্রিটস অফ পার্টিশন’ বইয়ে তিনি দাবি করেছিলেন, দেশভাগ চাননি মাত্র চারজন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম মহাত্মা গান্ধী। বাকিরা হলেন লোহিয়া নিজে, জয়প্রকাশ নারায়ণ ও আবদুল গফফুর খান। গান্ধীজি ততদিনে বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন দলে তাঁর নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব আর আগের মতো নেই। ফলে বিষণ্ণ চিত্তে দেশভাগ মেনে নিতে হয়েছিল তাঁকে। সেই সঙ্গে দাঙ্গার ভয়াবহতা। স্বাধীনতার পরও চারপাশে তখনও কেমন এক অবিশ্বাসের বাতাবরণ। ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়তে থাকা মানুষটি স্বাধীন দেশের প্রথম দীপাবলির সময় যে বার্তা দিয়েছিলেন তাতেও শুভবুদ্ধির উদয়ের প্রার্থনাই ফিরে ফিরে এসেছিল।
১৯৪৭ সালের ১২ নভেম্বর। প্রার্থনাসভায় মহাত্মা (Mahatma Gandhi) বললেন, ”আজ দিওয়ালি (Diwali)। আর এই উপলক্ষে সবাইকে অভিনন্দন জানাতে চাই। হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আজ এক মহান দিন। বিক্রম সম্বৎ অনুযায়ী আগামিকাল থেকে শুরু হবে নতুন বছর। আমাদের বুঝতে হবে কেন দিওয়ালি পালন করতে আলোকসজ্জা করা হয়। রাম-রাবণের যুদ্ধে রাম শুভশক্তির প্রতীক। অন্যদিকে রাবণ অশুভ শক্তির প্রতীক। রাম (Rama) রাবণকে পরাস্ত করেছিলেন। এবং এই জয় ভারতে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু হায়! আজ ভারতে রামরাজ্য আর নেই। তাহলে কীভাবে আমরা দীপাবলি পালন করব?”
এখানে বুঝতে হবে সাম্প্রতিক ভারতের প্রেক্ষিতে রামরাজ্যের যে ছবি, গান্ধীর রামরাজ্য তার থেকে আলাদা। সেদিন গান্ধী বলেছিলেন, ”যাঁর বুকের ভিতরে রাম রয়েছেন তাঁরাই এই বিজয় উদযাপন করতে পারবেন। ঈশ্বরই একা পারেন আমাদের আত্মাকে আলোকিত করে তুলতে। আর সেই আলোই প্রকৃত আলো।” এর পরই তাঁকে আমরা বলতে শুনি, ”মানুষ ভিড় করে নকল আলো দেখতে যায়। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন হৃদয়ে প্রেমের আলো। আমাদের ভালোবাসার এই আলোকে জ্বালিয়ে রাখতে হবে। তাহলেই আমরা পরস্পরকে অভিনন্দন জানাতে পারি। আজ হাজার হাজার মানুষ প্রবল কষ্টে রয়েছেন। আপনি, আপনারা সবাই কি পারেন নিজেদের হৃদয়ে হাত ছুঁইয়ে বলতে, যত ভুক্তভোগী রয়েছেন, তিনি হিন্দু হোন বা শিখ বা মুসলিম, তিনি আপনার ভাই বা বোন? এটাই আপনার পরীক্ষা। রাম ও রাবণ শুভ ও অশুভ শক্তির মধ্যে চিরকালীন লড়াইয়ের প্রতীক। সত্যের আলো আমাদের ভিতরেই রয়েছে।”
আরও বহু কথা সেদিন বলেছিলেন গান্ধী। তার মূল সুর ছিল এটাই। ভারত ও পাকিস্তান, দুই দেশের সংখ্যালঘুদের বিপণ্ণতায় তিনি কতটা কষ্টে ছিলেন তা পরিষ্কার ফুটে উঠেছিল তাঁর কণ্ঠস্বরে। দীর্ঘ বক্তৃতায় একসময় তিনি বলে ওঠেন, ”ভয়ে পালিয়ে আসা সমস্ত মুসলমানকে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত দীপাবলি উদযাপন করা যাবে না। একই ভাবে সেখান থেকে পালিয়ে আসা হিন্দু ও শিখদের সঙ্গেও তেমন না করলে পাকিস্তানও বাঁচবে না।”
দেখতে দেখতে সাড়ে সাত দশক পেরিয়ে গিয়েছে। আজও দেশভাগ ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হিসেবে জীবন্ত। আসলে কিছু কিছু ঘটনা সব কিছুকে চিরকালের জন্য বদলে দেয়ে। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তেমনই ভারতের স্বাধীনতা ও দেশভাগের অধ্যায়। পাঞ্জাব ও এই বঙ্গদেশ টুকরো হওয়ার পর সবই বদলে যায়। গান্ধীর সেদিনের আকুতি তাই আজও যেন ফিরে ফিরে আসে। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাস পাঁচেকের মাথাতেই নাথুরাম গডসের বুলেটবিদ্ধ হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে যান গান্ধী। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সংখ্যালঘুদের সমস্ত বিপণ্ণতা থেকে দূরে রাখতে তাঁর অমোঘ বাণী আজও একই ভাবে জীবন্ত।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.