ফাইল ছবি।
বুদ্ধদেব সেনগুপ্ত, ইন্দোর: একঝলকে ভ্রম হয় যেন বঙ্গ বিজেপির মধ্যপ্রদেশীয় সংস্করণ! আদি বিজেপি (BJP), নব্য বিজেপি ও তৎকাল বিজেপি। এই তিনের তাল ঠোকাঠুকিতে বাংলায় বিজেপি জর্জরিত। মধ্যপ্রদেশেও (Madhya Pradesh) বিজেপি দলটা খাবি খাচ্ছে তিন রাজ-রোগে। শিবরাজ। মহারাজ। বিক্ষুব্ধ রাজ।
ব্যাধি সংখ্যায় বঙ্গ বিজেপিকে টপকাতে না পারলেও গোষ্ঠীবাজির সংখ্যায় মধ্যপ্রদেশ বিজেপি ছাপিয়ে গিয়েছে দেশের বহু রাজ্যকেই। একটা-দুটো নয়, এ রাজ্যে শাসক দল এখন পাঁচ-পাঁচটি শিবিরে বিভক্ত। পাঁচ শিবিরের নেতা পাঁচ হেভিওয়েট–শিবরাজ সিং চৌহান, নরেন্দ্র সিং তোমর, কৈলাস বিজয়বর্গীয়, প্রহ্লাদ প্যাটেল ও জে্যাতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। এঁদের মধ্যে শিবরাজ বনাম কৈলাসের লড়াই বহু পুরনো। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া কংগ্রেস ছেড়ে আসার পরে তাঁর নেতৃত্বে তিন নম্বর গোষ্ঠীর জন্ম। তবে নিজভূমে প্রভাব বজায় রাখতে নিজস্ব গোষ্ঠী তৈরি করলেও রাজ্য রাজনীতির বদলে দিল্লি নিয়েই পড়ে থাকতেন সিন্ধিয়া ও বিজয়বর্গীয়। বাকি দু’জন, নরেন্দ্র সিং তোমর ও প্রহ্লাদ প্যাটেলও রাজ্য-রাজনীতি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতেন না। তাঁরাও বেশি উৎসাহী ছিলেন রাজধানী দিল্লির রাজনীতিতে। কিন্তু বিধানসভা ভোটের মুখে সর্বভারতীয় নেতৃত্বের কাছে শিবরাজের দরের পতন হতেই চর্চায় নয়া মুখ্যমন্ত্রীর সম্ভাব্য নাম। আর কুর্সির সেই রসালো গন্ধ পেতেই দিল্লি ভুলে ভোপালে রাজপাট বিস্তারে ব্যস্ত হয়েছেন দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, তোমর ও প্যাটেল।
২০০৮ থেকে মাঝের সওয়া একবছর বাদ দিলে টানা প্রায় পনেরো বছর ভোপালের তখতে আসীন গেরুয়া শিবির। নাগপুরের ‘গুডবুকে’ থাকা শিবরাজ সিং চৌহানের মুখ্যমন্ত্রিত্ব নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু গত ক’বছর ধরে মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে ঘরে-বাইরে ক্ষোভ চরমে উঠেছে। যা নজর এড়ায়নি মোদি-শাহদের। দিল্লির নেতারা যে তাঁকে আর মুখ্যমন্ত্রী দেখতে চান না তা প্রার্থী তালিকা প্রকাশের সময়ই প্রকাশ্যে চলে আসে। চতুর্থ তালিকায় জায়গা পান শিবরাজ। কিন্তু তার আগেই তোমর ও কৈলাসের নাম প্রকাশ করে দিল্লি। তাহলে কি মুখ্যমন্ত্রী মুখ বদল করতে চাইছে গেরুয়া শিবির? শুরু হয় আলোচনা।
মুখবদল নিয়ে জল্পনা শুরু হতেই প্রথমেই ভেসে ওঠে রাজ্য রাজনীতিতে শিবরাজের ‘ফার্স্ট রাইভাল’ কৈলাস বিজয়বর্গীয়র নাম। কৈলাসের হোম গ্রাউন্ড ইন্দোরে গেরুয়া কার্যকর্তাদের মধ্যে প্রবল উৎসাহ দেখা দেয়। কিন্তু সেই আশায় কিছুটা জল পড়ে কৈলাসপুত্র আকাশকে প্রার্থী না করা। তখনই ভেসে ওঠে সিন্ধিয়া, তোমর, প্যাটেলদের নামগুলো।
যদিও তাঁর সম্পর্কে এসব ‘রটনা’-য় প্রকাশ্যে অন্তত উৎসাহ দেখাচ্ছেন না বিজয়বর্গীয়। ইন্দোরের বড় গণপতি এলাকায় নির্বাচনী কার্যলয়ে বসে শহরের প্রাক্তন মেয়র তথা দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দাবি করছেন, তাঁর তো প্রার্থী হওয়ার কোনও ‘ইচ্ছে’-ই ছিল না। যে জন্য প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর তিনি নাড্ডাজির সঙ্গে কথাও নাকি বলেন! কিন্তু মোদি ও শাহদের ওপর কলম চালাতে নাড্ডাজি রাজি হননি বলে জানান, দাবি কৈলাসের। তাহলে দল ক্ষমতায় এলে তো আপনিই মুখ্যমন্ত্রী?
প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসি বিজয়বর্গীয়র। সরাসরি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ জবাব না দিয়ে বলেন, “আমি সবসময় দিল্লিতে কাজ করতে বেশি উৎসাহী।” প্রশ্নকর্তা তারপরও অবশ্য নাছোড়! যদি দল মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসার নির্দেশ দেয় তখন কী করবেন? কথাটা শুনেই হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কৈলাস। বললেন, “দলে অনেকেই আছেন যাঁদের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে।” কোনও মতে শব্দগুলো ছুড়ে দিয়েই তড়িঘড়ি দুধসাদা এসইউভি চেপে রওনা দিলেন ভোট প্রচারে।
মুখে কেউ কিছু স্বীকার করুন বা না করুন, ভোটের দিন যতই এগোচ্ছে, গেরুয়া শিবিরের কোন্দল ততই রাস্তায় নেমে আসছে। যেমনটা বৃহস্পতিবার দেখা গেল গোয়ালিয়র শহরের উপকণ্ঠে। সেদিন গোয়ালিয়র গ্রামীণ কেন্দ্রে জনসভা ছিল রাজপরিবারের সদস্য জে্যাতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার। তার আগেই রাজ্যের কোনও নেতাকে গোয়ালিয়রে প্রচারে আসার প্রয়োজন নেই বলে জানিয়ে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় অসামরিক পরিবহণমন্ত্রী সিন্ধিয়া। কিন্তু সে নিষেধ না মেনে আচমকাই এসে জনসভার মঞ্চে উঠে পড়েন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই মঞ্চ থেকে নেমে যান জ্যোতিরাদিত্য। যদিও সংবাদমাধ্যমের সামনে এ নিয়ে দলের মুখপাত্র আশিস আগরওয়ালের কৈফিয়ত, “অন্য জায়গায় প্রচারে যাওয়ার ছিল। তাই সিন্ধিয়াজি চলে গিয়েছিলেন।”
’২১ সালে বাংলা দখলে একগুচ্ছ হেভিওয়েটকে ভোট ময়দানে নামায় গেরুয়া শিবির। লকেট চট্টোপাধ্যায়, জগন্নাথ সরকার, নিশীথ প্রামাণিকদের মতো সাংসদরা ছাড়াও তালিকায় ছিলেন মুকুল রায়, স্বপন দাশগুপ্ত, অর্নিবাণ গঙ্গোপাধ্যায়, রাহুল সিনহাদের মতো ভারী ভারী নাম। কিন্তু তাতে ফল উলটে ‘অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট’ হয়েছিল। ৭৭ আসনেই থেমে গিয়েছিল ‘ইসবার দো শো পার’-এর হুঙ্কার তোলা মোদি-শাহ বাহিনী।
২০২১-এ বাংলায় ভোটের দায়িত্বে ছিলেন এই কৈলাস বিজয়বর্গীয়ই। পরাজয়ের দায় তাই তাঁরও কিছুটা বটেই! মধ্যপ্রদেশেও ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না তো? প্রশ্ন শুনে চোখ কুঁচকে হাসলেন যেন। তারপর বললেন, “৩ ডিসেম্বর ভাজপা ফির সত্তা পে আ রহা হ্যায় এমপি-মে।” সামনের আসনের কাচ নামিয়ে বলা কথাটা শেষ হওয়ার আগেই ধুলো উড়িয়ে রওনা দিল দুধসাদা এসইউভি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.