‘হাসি-কান্না হিরা-পান্না’য় শেষ হচ্ছে আরও একটা বছর। শেষ হতে চলা ২০২৪ সালে শিরোনামে কখনও উঠে এসেছে বেদনাদায়ক ঘটনা কখনও বা সুখস্মৃতি। তবে বেদনার স্মৃতিই তো মনে স্থায়ী ছাপ রেখে যায়। যেমন আর জি কর হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের নৃশংস ঘটনা থেকে প্যারিস অলিম্পিকে ভিনেশ ফোগাটের পদক হারানোর ধাক্কা – কত ঘটনায় চোখের জলে ভেসে গিয়েছি আমরা। বছর শেষে সেসব দিনই ফিরে দেখল সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল।
‘অভয়া’ বৃত্তান্ত: এক অতল অন্ধকূপ
৯ আগস্ট, ২০২৪- অত্যন্ত বেদনাদায়ক দিন। আর জি কর হাসপাতালের কনফারেন্স রুমে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডাক্তার ছাত্রীর ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় উত্তাল হয় দেশ। ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’ স্লোগান ওঠে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেও। তদন্তে নেমে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ মূল অভিযুক্ত হিসেবে সঞ্জয় রায় নামে সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেপ্তার করে। পরে সিবিআই তদন্তভার গ্রহণ করে পুলিশের হাতে ধৃত সঞ্জয়ের বিরুদ্ধেই চার্জশিট পেশ করে। বর্তমানে শিয়ালদহ আদালতে সেই মামলা চলছে। খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত হাসপাতালের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ও অন্যতম তদন্তকারী পুলিশ অফিসার অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করা হলেও পরে জামিনে মুক্ত হন।
এমন একটা নৃশংস ঘটনায় দেশের শীর্ষ আদালত স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে মামলা গ্রহণ করে। এদিকে সহকর্মীর সুবিচারের দাবিতে জুনিয়র চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ প্রায় একমাস কর্মবিরতি পালন করে। চলে অনশনও। শেষমেশ মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে কাজে ফেরেন আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা। তবে আন্দোলন পুরোপুরি নিভে যায়নি। বছরশেষেও বিচারের আশায় দিন গুনছেন ‘অভয়া’র বাবা-মা।
জয়নগর-জঙ্গিপুরে নাবালিকা ধর্ষণ ও বিচার
একদিকে অভয়ার বিচার চেয়ে যখন কলকাতারা রাজপথে একের পর দ্রোহের ছবি, তখনও কিন্তু এ রাজ্যের প্রান্তিক এলাকায় নারী নির্যাতন থেমে থাকেনি। কোনও জেলায় নাবালিকার উপর যৌন লালসা মেটানোর পর তাকে খুন, কোথাও আবার প্রেমিকাকেই গণধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা সামনে এসেছে। সেই সংখ্যাও গুনে শেষ করা যায় না। তবে আশার কথা একটাই, বিচারের বাণী এক্ষেত্রে নীরবে, নিভৃতে কাঁদেনি। নারী সুরক্ষার স্বার্থে এসব রুখতে অত্যন্ত সক্রিয় হয়েছে এ রাজ্যের পুলিশ। জয়নগরে নাবালিকা ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় মাত্র ৬২ দিনে বিচার মিলেছে। দোষীকে ফাঁসির সাজা শুনিয়েছে আদালত। আবার জঙ্গিপুরের ঘটনায়ও একই। সেখানে দোষী দুজনের মধ্যে একজনের মৃত্যুদণ্ড, অপরজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে আদালতের বিচারে। আর জি কর থেকে শিক্ষা নিয়ে নারী নির্যাতন রুখতে ‘অপরাজিতা বিল’ পাশ করিয়ে তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়েছে রাজ্যের তরফে।
জাতি সংঘর্ষে জ্বলছে মণিপুর
জাতি সংঘর্ষ ঘিরে গত বছর থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বের ছবির মতো সুন্দর রাজ্য মণিপুরে যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, তা পুরোপুরি নিভল না ২০২৪ সালেও। নানা ছোটখাটো অশান্তি, হানাহানির মাঝে বছরের শেষদিকে জিরিবাম প্রদেশের এক দৃশ্য কার্যত স্তব্ধ করে দিয়েছিল গোটা দেশকে। কুকি সম্প্রদায়ের এক মহিলাকে ধর্ষণের পর আগুনে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে সশস্ত্র একদল দুষ্কৃতীর বিরুদ্ধে। তার বদলা নিতে এক মেতেই পরিবারের মহিলা, শিশু-সহ ৬ সদস্যকে অপহরণ করে নৃশংসভাবে খুনের ঘটনা ঘটে। আর তা ফের কুকি-মেতেই সংঘর্ষে ঘি ঢালে। যার পরিণামে পুলিশের গুলিতে আরও ১০ জনের প্রাণহানি ঘটে। তারা সকলে সশস্ত্র জঙ্গি বলে দাবি করে পুলিশ। এলাকা ক্রমশ উত্তপ্ত হতে থাকায় আইনশৃঙ্খলা বজায়ের স্বার্থে নতুন করে কারফিউ জারি হয়। সবমিলিয়ে, উত্তর-পূর্বে অশান্তির আগুন ২০২৪-এও জ্বলছে ধিকিধিকি করে।
প্রকৃতির মার, বন্যাবিধ্বস্ত ওয়ানড়
প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা থেকে মানুষ যে এখনও বহু যোজন দূরে, তা বারবার প্রমাণিত হয় বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এবছরও কেরলের ওয়ানড়ের বন্যা আরও একবার সেই শিক্ষা দিয়ে গেল। দিনটা জুলাইয়ে ৩০। প্রবল বৃষ্টি থেকে বন্যা আর পার্বত্য এলাকায় ভূমিধসে ওয়ানড় জেলার প্রায় তিন, চারটি গ্রাম কার্যত মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। প্রায় তিনশো মানুষের প্রাণহানি, চারশোজন জখম এবং শতাধিক নিখোঁজের পর থেমেছিল প্রকৃতির ধ্বংসলীলা। বৃষ্টিস্নাত কেরলের ওয়ানড়ে যে পর্যটকরা সেসময় সেখানে গিয়েছিলেন, তাঁরা বেড়ানোর বিভীষিকা ভুলতে পারবেন না আজীবন। তবে এমন ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় সামলাতে ভারতীয় সেনার অবদান মনে রাখার মতো। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার মানুষকে তাঁরা কার্যত নবজীবন দান করেছেন। পরবর্তীতে অবশ্য ওয়ানড় পুনর্গঠনের কাজ হয়েছে। ফের নিজের রূপে ফিরছে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার এই দর্শনীয় স্থান।
জতুগৃহ লখনউয়ের হাসপাতাল, আগুনের গ্রাসে শিশুরা
যেখানে মানুষ যায় সুস্থ হতে, সেই জায়গাই যদি হয়ে ওঠে সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরী, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক কিছু আর হতে পারে না। চলতি বছরের নভেম্বরে লখনউতে ঘটে গেল তেমনই ঘটনা। এক রাতে ঝাঁসির মেডিক্যাল কলেজের শিশু বিভাগে জ্বলে উঠল দাউদাউ আগুন। চোখের সামনে ঝলসে মৃত্যু হল ১০ ফুটফুটে শিশুর। শর্ট সার্কিট থেকে আচমকা এই অগ্নিকাণ্ড বলে প্রাথমিক রিপোর্টে জানা গেলেও উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের দাবি, নিম্নমানের অক্সিজেন কনসেনট্রেটরের কারণে আগুন লেগেছে। প্রকৃত তদন্তের দাবি তুলেছেন তিনি। তবে সব অমঙ্গলের মধ্যেই তো মঙ্গল-বীজ লুকিয়ে থাকে। সেভাবেই এই বিপদের দিনে মানুষ হিসেবে নিজেকে চিনিয়েছিলেন ইয়াকুব মনসুরি নামে এক যুবক। নিজের সন্তানদের হারানোর বেদনা নিয়েই আগুনের সঙ্গে লড়াই করে সাত শিশুর প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন ইয়াকুব। দেখিয়েছিলেন জীবনের আলো।
পদকহারা ভিনেশ, হতাশ ভারতবাসী
দক্ষতা, মনোযোগ, পরিশ্রম- এই তিনের যথোপযুক্ত মেলবন্ধনই নাকি সাফল্যের চাবিকাঠি। কিন্তু এসবের পরও ভাগ্যদেবী সহায় না থাকলে যে সাফল্যের সিঁড়ি থেকে যে কোনও মুহূর্তে ছিটকে যাওয়া যেতে পারে, তা বোঝা গিয়েছিল প্যারিস অলিম্পিকে। সোনা জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছেও সুযোগ হাতছাড়া হয় ভারতীয় কুস্তিগির ভিনেশ ফোগাটের। ৫০ কেজি ফ্রি স্টাইল কুস্তির ফাইনালে উঠে সোনার পদকের লড়াইয়ে নামার আগেই স্বপ্নভঙ্গ। কারণ নির্দিষ্ট ওজনের চেয়ে ১০০ গ্রাম বেশি ওজন ছিল ভিনেশের। নিয়মভঙ্গের দায়ে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে যান তিনি। যদিও ক্রীড়া আদালতের কাছে তাঁর আবেদন ছিল, নিয়ম মেনে ফাইনালে ওঠায় অন্তত রুপোর পদক দেওয়া হোক। কিন্তু সেই আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ায় প্যারিস অলিম্পিক থেকে খালি হাতেই ফিরতে হয় লড়াকু কুস্তিগিরকে। সোশাল মিডিয়ায় দুচোখে অসীম শূন্যতা নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ভিনেশের ছবি দেখে আপামর ভারতবাসীও অনুভব করেছেন সেই শূন্যতা, শুনতে পেয়েছেন তাঁর হৃদয় ভাঙার শব্দ।
ভারতীয় ফুটবলের যুগাবসান, অবসরে সুনীল ছেত্রী
৬ জুন, ২০২৪ তারিখটা এদেশের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত মনখারাপের দিন। ভারতীয় ফুটবলকে নতুন স্বপ্ন দেখানো তারকা আচমকাই অবসর ঘোষণা করেছিলেন চল্লিশ বছরের ‘তরতাজা যুবক’ সুনীল ছেত্রী। ৬ জুন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে শেষবারের মতো তাঁকে জাতীয় দলের অধিনায়কের জার্সিতে দেখা গিয়েছিল। চল্লিশেও মাঠজুড়ে দাপট দেখিয়ে বেড়ালেন তারকা স্ট্রাইকার। ভারতের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা, আন্তর্জাতিক স্তরে তৃতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা, দেশের হয়ে সর্বাধিক ম্যাচ খেলা – সুনীলের ঝুলিতে রয়েছে এসব ঈর্ষণীয় রেকর্ড। জাতীয় দলের হয়ে মোট ১৫১ টি ম্যাচে তাঁর গোলের সংখ্যা ৯৪। পরিসংখ্যান বলছে, ভারতীয় ফুটবলার হিসেবে বাইচুং ভুটিয়ার পর শতাধিক আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার রেকর্ডধারী সুনীলই। ছুঁয়েছেন জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থানও। এহেন খেলোয়াড়ের বিদায়বেলার বেদনা ছুঁয়ে রইল ২০২৪-কে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.