গ্রাফিক্স: অর্ঘ্য চৌধুরী
শুভজিৎ মণ্ডল: ধর্ম এবং জিরাফের যেমন কোনও সম্পর্ক নেই, তেমনি ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিরও কোনও যোগাযোগ থাকার কথা নয়। দুঃখের বিষয় এ পোড়া দেশে ঠিক এর উলটোটাই মেনে চলা হয়। এ দেশে ধর্ম আর রাজনীতি অভিন্নহৃদয়। এ দেশে ধর্ম শুধু রাজনীতির অংশ নয়, বরং আজকের দিনে রাজনীতিই বৃহৎ ধর্মীয় আন্দোলনের অঙ্গ। অথচ ভারত যখন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেল, তখন রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের যোগাযোগ যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়ারই চেষ্টা হয়েছিল।
ধর্ম আর রাজনীতি মিশে গেলে সমস্যা অনেক। রাজনৈতিক মহলের মতে, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির মিশেল বিপজ্জনক, কারণ এতে করে সরকার নিজের মূল দায়িত্ব থেকে নজর ঘুরিয়ে অব্যাহতি পেয়ে যায়। রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের মিশেল বিপজ্জনক কারণ, আমজনতার চোখে ধর্মের চশমা পরিয়ে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের মূল দাবি থেকে বিভ্রান্ত করে দেওয়া যায়। যাই হোক, সেটা আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। মূল প্রশ্ন হল, আজকের ভারতে ধর্ম যে রাজনীতির ‘পার্ট’ থেকে ‘হার্টে’ পরিণত হয়েছে সেটার জন্য দায়ী কারা? এর দায় কি শুধুই অধুনা ভারতের শাসকদল বিজেপির? নাকি এর জন্য ভারতের পূর্ববর্তী রাজনীতিবিদরাও দায়ী?
আসলে ভারতের সমস্যাটা মূলেই। যে দেশের জন্মই হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে, সে দেশে ধর্ম যে রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে অধিষ্ঠিত হবে, সেটাই বোধ হয় প্রত্যাশিত। অথচ দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির ছোঁয়াচ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতেন। নেহরু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন ভারতকে সর্বতভাবে অগ্রগতির রাস্তায় এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এ দেশের বহুত্ববাদকে সম্মান করতে হবে। ধর্মের বেড়াজালে আটকে থাকা চলবে না। পণ্ডিতজি নিজে ভীষণ ধার্মিক লোক ছিলেন। অথচ সরকার, প্রশাসন এবং ধর্মকে কখনও মিশিয়ে ফেলতেন না। তিনিই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদকে সোমনাথ মন্দিরের উদ্বোধনে বাধা দেন। আবার তাঁর বিরুদ্ধেই অভিযোগ ওঠে, স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে মুসলমানদের উপযুক্ত নিরাপত্তা না দিতে পারার। সমালোচকরা বলেন, আদর্শগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হলেও নেহরুর সমস্যা, তাঁর নরমপন্থী মনোভাব। ধর্মের নামে হানাহানি বা রাজনীতিতে সুকৌশলে ধর্মীয় সুড়সুড়ি দেওয়ার অপচেষ্টা তিনি রুখতে পারেননি। আবার পণ্ডিতজি নিজেও মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিতেন, নিজে ব্যক্তিগতভাবে ইফতার পার্টি আয়োজন করতেন। আরও একটা সমস্যা হল, এ পোড়া দেশে মানুষ বড় ধর্মভীরু। সেসময় নেহরুভক্তদের একটা বড় অংশ তাঁর ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কেই নিজেদের ‘ধর্ম’ বানিয়ে ফেলেছিলেন। আবার আরেকটা অংশ নেহরুর এই অতিমাত্রায় ধর্মনিরপেক্ষতাকে ‘মুসলিম তোষণ’ হিসাবে দেখা শুরু করেন। সেখানেই সম্ভবত সমস্যার সূত্রপাত।
তবে ধর্ম আর রাজনীতির মিশেল মূলত শুরু হল নেহরু পরবর্তী সময়ে। আসলে নেহরুর পরিবারেই হোক, বা দিল্লির মসনদে, পণ্ডিতজির পরে যাঁরাই এসেছেন, তাঁদের কেউই আদর্শগত ভাবে নেহরুর মতো ‘খাঁটি’ ছিলেন না। নেহরু পরবর্তী সময়ে লালবাবাদুর শাস্ত্রী সামান্য সময় দিল্লির মসনদে বসেন। তাঁর গো ভক্তি সেসময় বেশ শিরোনামে থাকত। তবে সেটা কখনও বিপজ্জনক রূপ নেয়নি। যেটা হল ইন্দিরার আমলে। আসলে ইন্দিরা গান্ধী দিল্লির মসনদে বসতে বসতে আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো সংগঠনগুলি নিজেদের মতো করে ডালপালা বিস্তার শুরু করে দিয়েছে। আবার বেশ কিছু মুসলিম সংগঠনও সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা শুরু করে দিল। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ইন্দিরার আশঙ্কা ছিল, এই ধর্মীয় সংগঠনগুলিকে এখনই দমন না করলে দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদ বাড়তে থাকবে। সে কারণেই তিনি রাজনীতিতে ধর্মীয় অনুপ্রবেশকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া শুরু করলেন। তাঁর আমলেই সরকারি ভাবে আয়োজিত হওয়া শুরু করল ইফতার পার্টি। সাতের দশকে ঘটা করে রাষ্ট্রপতি ভবনে ইফতার পার্টি হত। ইন্দিরা নিজেও ইফতার পার্টির আয়োজন করতেন জাঁকজমক করেই। মুসলিম সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, মুসলিম বুদ্ধিজীবী এবং মুসলিম সমাজের প্রভাবশালী নেতাদের ডাকা হত ইফতারে। আবার সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা প্রকল্পও শুরু করেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল, মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক অটুট রেখে বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমূলে বিনাশ করা।
উলটো দিকে হিন্দুদের সঙ্গে রাখারও চেষ্টা করেছেন ইন্দিরা। তাঁর আমলেই সরকারি দপ্তরগুলিতে হিন্দু সন্ত, মোহন্তদের যাতায়াত বাড়তে শুরু করে। হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনগুলিতেও প্রভাব বাড়ানো শুরু করে কংগ্রেস। যার প্রভাব সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে পড়েনি। ইন্দিরার আমলেই সাধারণ হিন্দুদের প্রথম মনে হওয়া শুরু করে, সরকার তথা কংগ্রেস সংখ্যালঘুদের তোষণ করছে। সেই ধারণা আরও উসকে যায় জরুরি অবস্থা চলাকালীন জনসংঘ এবং আরএসএসের সহস্রাধিক নেতা গ্রেপ্তার হওয়ায়। সাতের দশকের শেষ, এবং আটের দশকের গোঁড়ার দিকেই প্রভাব বাড়তে থাকে আরএসএসের। এতদিন যে জনসংঘ দেশে রাজনৈতিক জমি খোঁজার চেষ্টা করছিল, সেই জনসংঘ বুঝতে পারে সরকারের প্রতি যে সুপ্ত ক্ষোভ তৈরি হয়েছে সেটাকে হিন্দুদের ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে কাজে লাগানো যায়।
এর মধ্যে সংঘের অন্দরেও পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। আরএসএসের প্রথম সরসঙ্ঘপ্রধান হেডগেওয়ার সেভাবে রাজনীতিতে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, হিন্দুরা শতাব্দীর পর শতাব্দী শোষিত এবং অত্যাচারিত শুধু ঐক্যের অভাবে। তাই তাঁর প্রথম লক্ষ্য ছিল, গোটা দেশের হিন্দুসমাজকে একত্রিত করা। আরএসএসের দ্বিতীয় সংঘপ্রধান গোলওয়ালকর হিন্দুত্বের আদর্শকে সংঘের অন্দরে সুপ্রতিষ্ঠিত করে সেটার প্রচার শুরু করেন বটে। কিন্তু রাজনীতি ছিল তাঁরও দুর্বলতা। সংঘের তৃতীয় প্রধান বালাসাহেব দেওরাস প্রথম রাজনীতিতে সংঘের সক্রিয় অংশগ্রহণে আগ্রহ দেখান। তিনিই প্রথম বুঝতে পারেন, মর্যাদা পুরুষোত্তম রামের নামে আন্দোলন শুরু করলে গোটা বিশ্বের হিন্দু সমাজকে একত্রিত করা সম্ভব। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দলের মাধ্যমে সেই কাজটিই শুরু করলেন তিনি।
একদিকে ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণের অসন্তোষ, সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ, অন্যদিকে হিন্দুত্বের বাড়ন্ত প্রচার এবং রামের নামে হিন্দুদের এক ছাতার তলায় আনার চেষ্টা। এসবের মধ্যে আবার ক্রমশ আরও একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। সেটা হল সাংগঠনিক ভাবে কংগ্রেসের দুর্বল হওয়া। আসলে ইন্দিরা গান্ধী দলের সংগঠনের ঊর্ধ্বে উঠে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির সূচনা করেছিলেন। যা কংগ্রেসের সংগঠনকে ক্রমশ গুরুত্বহীন এবং ক্ষয়িষ্ণু করে তোলে। আর কংগ্রেসের সাংগঠনিক দুর্বলতার শূন্যস্থান দখল করা শুরু করে উগ্র মৌলবাদী ধর্মীয় সংগঠনগুলি। ফলে আটের দশকের গোঁড়ার দিকে ভারতীয় রাজনীতির ধর্মনিরপেক্ষ ‘বদনাম’ অনেকটাই ঘুচে যায়।
ইন্দিরা পরবর্তী সময়ে রাজীব গান্ধীর আমলে বেশ কয়েকটি ঘটনা ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশকে তরান্বিত করে। রাজীবের আমলের সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনা শাহ বানো মামলা। ১৯৮৫ সালে শাহ বানো মামলায় সুপ্রিম কোর্ট মুসলিম মুসলিম মহিলার ক্ষেত্রেও ১২৫ ধারায় খোরপোশের অধিকারে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু রাজীব গান্ধীর সরকার সেই রায় বদলে দিয়ে ১৯৮৬ সালে মুসলিম মহিলাদের জন্যে পৃথক আইন বা মুসলিম উইমেন (প্রটেকশন অফ রাইটস অন ডিভোর্স) অ্যাক্ট সংসদে পাশ করায়। ফলে নেহেরু, ইন্দিরাদের বিরুদ্ধে যে মুসলিম তোষণের অভিযোগ উঠত, সেটা আরও প্রবলভাবে সেঁটে যায় রাজীবের গায়ে। কিন্তু ততদিনে রাজীব বুঝে গিয়েছেন, মুসলিম তোষণের অভিযোগ ঘোচাতে না পারলে কংগ্রেস শক্তি হারাবে। সম্ভবত সেকারণেই রাম মন্দির আন্দোলন সেভাবে দমন করার চেষ্টা করেননি তিনি। উলটে তাঁর আমলেই প্রথম রাম মন্দিরের মূল ফটক খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বস্তুত রাম মন্দির আন্দোলন তরান্বিত হয় তাঁর আমলেই।
এর পরবর্তী ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। কিন্তু কারও অজানা নয়। জনসংঘ ভেঙে বিজেপি তৈরি। এবং ১৯৯০-এ আডবানীর রথযাত্রা গোটা দেশে যেন হিন্দুত্বের ঢেউ বইয়ে দিল। আডবানীর রথযাত্রার আগে যে জনসংঘ মাত্র দুটি আসন পেয়েছিল ৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, সেই সংঘই আডবানীর যাত্রা পরবর্তী সময়ে বিজেপির প্রতীক নিয়ে ১৯৯১ সালে প্রায় ২১ শতাংশ ভোট এবং ১২০টি আসন জিতে যায়। হিন্দুত্বের সেই ঢেউ ১৯৯২ সালে আছড়ে পড়ে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের উপর। প্রকাশ্যে ভেঙে দেওয়া হল বাবরি। অনেকে বাবরি ভেঙে পড়ার সেই মুহূর্তকে দেশের সংখ্যাগুরু পরাশক্তির নির্লজ্জ আস্ফালন হিসাবে বর্ণনা করেন। সেই পেশিশক্তির আস্ফালনই পরবর্তী কালে ভারতীয় রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়াল। এর পর ১৯৯৬-এ প্রথমবার বাজপেয়ী সরকার। ১৯৯৯-এ বাজপেয়ীর পূর্ণ সময়ের সরকার গঠন। এবং পরবর্তীকালে ২০১৪ সালে মোদি সরকারের প্রতিষ্ঠা। সবটাই হয় হিন্দু আর সংখ্যাগুরুর আস্ফালনের উপর ভর করে।
২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার দৌলতে মোদি হিন্দু হৃদয় সম্রাট অবতারে প্রতিষ্ঠিত হয়েই ছিলেন। কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর তিনি নিজের ভাবমূর্তির সঙ্গে যোগ করলেন জাতীয়তাবাদকেও। এই যুগলবন্দি যেন অভেদ্য। আরও তাৎপর্যপূর্ণভাবে মোদি জমানায় ধর্ম আর রাজনীতির মধ্যে সুক্ষ প্রভেদটাও মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল। ধর্মকেই যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলেন তিনি। তাঁর আমলে তিন তালাক বাতিল হল সংসদে আইন পাশ করিয়ে। তাঁর আমলে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠিত হল সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। তাঁর আমলে অভিন্ন দেওয়ানি বিধিও কার্যকর হচ্ছে বিভিন্ন রাজ্যে আইন পাশ করিয়ে। একে একে আরএসএস এবং সংঘের সব এজেন্ডাই পূরণ করছেন মোদি। কিন্তু কোনওটা করার জন্যই কোনও ধর্মীয় বা জঙ্গি আন্দোলনের সাহায্য নিতে হচ্ছে না তাঁকে। সবটাই হচ্ছে সরকারিভাবে, এবং নিয়ম মেনে। বিশেষ করে রামমন্দির উদ্বোধনের মঞ্চকে যেভাবে তিনি সরকারি অনুষ্ঠানে পরিণত করলেন, তাতে হয়তো অতি বড় হিন্দুত্ব বাদীর মনেও খটকা লাগে। ইন্দিরা, রাজীবদের সঙ্গে এটাই মোদির পার্থক্য। আজকের ভারতে ধর্ম আর রাজনীতির পার্ট নয়, আজকের ভারতে ধর্ম রাজনীতির হার্টে। সেটাই ভোটের মূল হাতিয়ার। সেটাই মোদির মূল হাতিয়ার।
এটা হয়তো হওয়াটাই স্বাভাবিক। যে দেশে ১২টি ধর্ম, ৩০০ জাতি, ৪ হাজার উপজাতি, ১০০ প্রধান ভাষা, ৩০০ উপভাষার মানুষ বাস করেন, সেই দেশকে একসূত্রে বাঁধতে যে মহানতার প্রয়োজন হয়, তা কজনেরই বা থাকে। তার চেয়ে ধর্মীয় উসকানি দিয়ে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে এক ছাতার তলায় আনা অনেক সহজ। সেটাই করছেন মোদি, আর সেটাই বিজেপির সবচেয়ে বড় ট্রাম্পকার্ড।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.