অনুরাগ রায়, পাটনা: পাটনা কলেজ। বিহারের সবচেয়ে পুরনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির একটি। অধুনা বিহারের রাজনীতির দুই প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব লালুপ্রসাদ যাদব এবং নীতীশ কুমারের রাজনীতিতে হাতেখড়ি এই কলেজ থেকেই। বলা হয়, বিহারের আগামী প্রজন্মের রাজনৈতিক চিন্তাধারার আগাম আন্দাজ পাওয়া যায় এখান থেকেই। ক্যান্টিনে জনাকয়েক পড়ুয়াকে পাওয়া গেল। এবার লোকসভা ভোটের ইস্যু কী? জবাবে প্রায় সকলেই বললেন, ‘রোজগার’, মেহেঙ্গাই’। কোন নেতা পছন্দ? এবার অধিকাংশের জবাব, তেজস্বী যাদব। রাহুল গান্ধীর নামও বললেন জনা দুই। একজন বললেন চিরাগ পাসওয়ান, একজন নীতীশ কুমারের নামও নিলেন। মোদির নাম শোনা গেল বটে, তবে সংখ্যাটা কম।
ওই জনা কয়েকের কথা শুধু নয়, গোটা বিহার ঘুরলেই বোঝা যাবে, এই মুহূর্তে বিহারের যুবসমাজের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম তেজস্বী যাদব। কেন? আসলে তেজস্বী ভোটপ্রচারে গিয়ে বারবার সরকারি চাকরির কথা বলছেন, প্রশ্নফাঁসের কথা বলছেন, মূল্যবৃদ্ধির কথা বলছেন। আর শুধু বলা নয়, তিনি করেও দেখিয়েছেন। নীতীশ কুমারের সঙ্গে ১৭ মাস উপমুখ্যমন্ত্রী হিসাবে সরকার চালিয়েছেন লালুপুত্র। হিসাব বলছে, ওই ১৭ মাসেই কয়েক লক্ষ সরকারি চাকরি দিয়েছে বিহার সরকার। প্রশ্ন ফাঁসে লাগাম লাগানো গিয়েছে। ফলস্বরূপ যুব সমাজের একটা বড় অংশ তাঁকে বিশ্বাস করা শুরু করেছে। মানুষের ভরসা হচ্ছে শুধু মুখে বলা নয়, চাকরির প্রতিশ্রুতি পূরণও করতে পারবেন তেজস্বী।
তেজস্বী নিজেও খাটছেন চরম। দিনে ১০-১১ টা সভা করছেন। পিঠের অসহ্য ব্যাথা উপেক্ষা করেও বিহারের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। সভায় সভায় গিয়ে বলছেন, “জুমলাবাজি অনেক হল, এবার শিক্ষার কথা হোক, স্বাস্থ্যের কথা হোক, রোজগারের কথা হোক।” জনতাও যেন তাঁর পিছনে উন্মত্ত। সভায় সভায় হাজার হাজার মানুষের ভিড়। মঞ্চ থেকে তেজস্বী যখন নীতীশ কুমারকে নিশানা করে বলছেন, ‘হামারে চাচা জি তো পলট গেয়ে।’ জনতা উদ্বেলিত হচ্ছে। তেজস্বীর এই জনসভাগুলি দেখলে যৌবনের লালু যাদবের কথা মনে পড়তে বাধ্য। কিন্তু লালুর সভার ভিড় আর তেজস্বীর সভার ভিড়ের একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। লালুর সভায় ভিড় হত মূলত যাদব এবং মুসলমানদের। আর তেজস্বী জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে সামগ্রিক যুবসমাজের আলাদা একটা সমর্থককুল তৈরি করতে পেরেছেন। সভার ভিড়ের সামনের দিকে থাকছে তারাই।
কিন্তু প্রশ্ন হল, তেজস্বীর এই বিপুল জনপ্রিয়তা কি লোকসভা ভোটে ইন্ডিয়া জোটকে ডিভিডেন্ট দেবে? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন। পাটনার সঞ্জয় গান্ধী জুওলজিক্যাল পার্কে সকাল-সকাল স্থানীয়রা ভিড় জমান। সেখানে কয়েকজনকে পাওয়া গেল। এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারি বললেন, ‘এটা দেশের ভোট, বিহারের ভোট হলে তেজস্বীর জনপ্রিয়তা বিরাট ফ্যাক্টর হত বটে। কিন্তু দেশের নেতা হিসাবে আমরা এখনও মোদিকেই দেখি।” পাশ থেকে আরেকজন আবার বললেন, “ইসবার মহল এক তরফা নেহি হ্যায়। লড়াই কাঁটে কা হ্যায়।” এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক আবার বললেন, “রোজগার, মেহেঙ্গাই মুদ্দা হ্যায়। মোদি এসব বাত নেহি করতে। সির্ফ লোগো কো বাটনে কি বাত করতা হ্যায়। একতরফা নেহি মিলেগা।”
২০১৯-এ বিহারের ৪০ আসনের মধ্যে ৩৯ আসন জিতেছিল এনডিএ। উলটো দিকে কোনওক্রমে কিষানগঞ্জ আসনটি জিতেছিল কংগ্রেস। ৪০ আসনের মধ্যে বিজেপি লড়েছিল ১৭টি, নীতীশ কুমারের জেডিইউ ১৭টি, রামবিলাস পাসওয়ানের এলজেপি লড়েছিল ৬ আসনে। একটি মাত্র আসন যেটা এনডিএ হেরেছিল, সেটা ছিল জেডিইউয়ের ভাগে। এবার ১৭টি আসনেই লড়ছে বিজেপি, নীতীশের দল লড়ছে ১৬টিতে, চিরাগ পাসওয়ানের এলজেপি লড়ছে ৫ আসনে, একটি করে আসনে লড়ছেন উপেন্দ্র কুশওয়াহার আরএলএসপি এবং জিতন রাম মাঝির হাম। আগের বার এনডিএ শিবিরে ছিল ৩ দল, এবার সেটা হয়েছে ৫ দল। খাতায় কলমে অন্তত শক্তি বেড়েছে এনডিএর। উলটোদিকে মহাজোটের লড়াই পুরোটাই তেজস্বী নির্ভর। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিহারে চমকপ্রদ উথান হয়েছে বামেদের। এবারে আরজেডি-কংগ্রেসের জোটে রয়েছে বাম দলগুলিও। সঙ্গে আবার যোগ দিয়েছে মুকেশ সাহানির বিকাশশীল ইনসান পার্টি। বিরোধী মহাজোটের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা কংগ্রেস এবং বিকাশশীল ইনসান পার্টি। খাতায়কলমে অন্তত এনডিএ জোট ইন্ডিয়া জোটের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তবে দুর্বলতা এনডিএ শিবিরেও রয়েছে। নীতীশ কুমার বারবার শিবির বদলানোয় তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে। বিজেপির ভোটাররাও নীতীশকে ভোট দিতে ভরসা পাচ্ছেন না।
বিহারে ভোট হবে আর জাতপাতের অঙ্ক থাকবে না, সেটা তো হয় না। যতই রোজগারের কথা হোক, মূল্যবৃদ্ধির কথা হোক, জাতপাত এখনও বিহারের ইস্যু। বিজেপির উচ্চবর্ণের হিন্দু ভোট, নীতীশের কুর্মি ভোট, চিরাগ পাসওয়ানের দলিত এবং পাসওয়ান ভোট, মাঝির মহাদলিত ভোট, কুশওয়াহার দলিত ভোটের একাংশের সমর্থন রয়েছে। সেই সমীকরণ কাজ করলে সেটার অ্যান্টিডোট পাওয়া মুশকিল। কিন্তু সেই মুশকিল কাজের চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করেছেন তিরিশের কোটায় পা রাখা তেজস্বী। বাবার প্রথাগত যাদব-মুসলিম ভোটব্যাঙ্ককে ভিত্তি করে নতুন তত্ত্বের প্রচার করছেন তিনি। মাই-বাপ। ইংরেজিতে MY-BAAP। MY অর্থাৎ মুসলিম-যাদবের পাশাপাশি BAAP অর্থাৎ বহুজন, আগড়া (উচ্চবর্ণ), আধি আবাদি (মহিলা) এবং পুওর (গরিব)। অর্থাৎ তেজস্বী শুধু মুসলিম-যাদব ভোটব্যাঙ্কের বাইরে বেরিয়ে উচ্চবর্ণ, মহিলা, দলিত, গরিব সবাইকে নিয়ে জোট তৈরি করতে চাইছেন। তাঁর সভাগুলিতে জনজোয়ার বলছে, তিনি সে কাজে অনেকটা সফলও।
কিন্তু এত কিছুর পরও কি মোদি-নীতীশের যুগলবন্দিকে হারিয়ে বিহারে বিজেপির অভেদ্য দুর্গ ভেদ করতে পারবেন তেজস্বী? বুক ঠুকে সেই দাবি করতে পারছে না ইন্ডিয়া শিবিরও। আসলে সদ্য প্রকাশিত সরকারি সমীক্ষা বলছে বিহারের ৩০ শতাংশ মানুষ এখনও মাসে ৬ হাজার টাকার কম রোজগার করেন। তাতেই দিন গুজরান হয়। মোদি জমানায় মাসে পাঁচ কেজি রেশন বিনামূল্যে পেয়েছেন তাঁরাও। উজ্বলার গ্যাস পেয়েছেন মহিলারা। করোনার সময় সরাসরি অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকেছে। অন্তত খাওয়া-পরার আশ্বাসটুকু মোদি জমানায় পেয়েছেন তাঁরা। সেই সুবিধাভোগী ভোটাররা সহজে মোদির বিপক্ষে যেতে চাইবেন কি? তাছাড়া মহিলা ভোটারদের মধ্যে নীতীশ কুমার এবং মোদি দুজনেই জনপ্রিয়। সেটাও ফ্যাক্টর। জাতপাতের সমীকরণেও এগিয়ে এনডিএ। এসব ছাপিয়েও ফ্যাক্টর কেন্দ্রে ‘মজবুত’ সরকার গড়ার অঙ্গীকার এবং মোদির ভাবমূর্তি। এত কিছু কি একা সামলাতে পারবেন তেজস্বী?
পাটনার অদূরে একটি সবজি হাটে আশেপাশের জেলাগুলি থেকে বহু গরিব মানুষ আসেন প্রতিদিন। সেখানে পথচলতি মানুষের সাথে কথা বলে বোঝা গেল, আম আদমির তেজস্বীর প্রতি সমর্থন থাকলেও মোদির প্রতি ক্ষোভ বিশেষ নেই। এক মহিলা বলছিলেন, “মেহেঙ্গাই আসমান ছু রাহা হ্যায়। সরকার কো কুছ দিখতা হি নেহি।’ এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, তেজস্বী উপমুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনই শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছেন তাঁর ছেলে। তাঁর ভোট এবার তেজস্বীকে। বিজেপি সংবিধান বদলে দিতে পারে, রাহুল গান্ধীর এই অভিযোগেও সাড়া পড়েছে। আবার অনেকেই বললেন, দিল্লির জন্য মোদিজিই ঠিক আছে। বোঝা গেল, এবারের ভোটে কোনও জ্বলন্ত ইস্যু নেই, নেই হাওয়াও। কিন্তু সামাজিক সমীকরণ এবং জোটের পাটিগণিত এগিয়ে রাখছে মোদি-নীতীশকেই। তেজস্বীর মাই-বাপ হয়তো চ্যালেঞ্জ করবে বিজেপিকে, হারাতে পারবে কি? সংশয় রয়েছে। তবে বিজেপির জোটসঙ্গীদের দখলে থাকা আসনগুলি জিতিয়ে আনা এবার সত্যিই চ্যালেঞ্জ মোদির জন্য। কিষানগঞ্জ, পুর্নিয়া, কাটিহার, মুজফফরনগর, ভাগলপুর, আরারিয়া, সিওয়ান, সাসারাম, জেহানাবাদ, সারণ, পাটলিপুত্র, মহারাজগঞ্জের মতো আসনে সমানে সমানে টক্কর হচ্ছে ইন্ডিয়া জোট আর এনডিএর। এর মধ্যে লালুর দুই মেয়ে মীসা ভারতী এবং রোহিণী আচার্যও লড়াইয়ে আছেন। সব মিলিয়ে বিহারের হাওয়ায় এবার শোনা যাচ্ছে, ‘এক তরফা নেহি মিলেগা। টক্কর কাঁটে কা হ্যায়।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.