অনুরাগ রায়: “হরিয়ানা কে লউন্ডো কো ম্যায়নে সীমা পর খুল্লা ছোড় দিয়া।” স্থান হরিয়ানার সোনিপথ। বক্তা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi)। কেন একথা বলতে হল প্রধানমন্ত্রীকে? কেনই বা হরিয়ানা নিয়ে রক্তচাপ এত বেশি গেরুয়া শিবিরে?
২০১৯ লোকসভা ভোটের সময় দেশে পুলওয়ামা এবং বালাকোটের বিপুল হাওয়া। যে হওয়ায় ভর করে জাতপাতের সমস্ত সমীকরণের ঊর্ধ্বে উঠে হরিয়ানার ১০টি লোকসভা কেন্দ্রই জিতে নেয় বিজেপি। এমনকী নিজের খাসতালুক রোহতকে হেরে যান প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভুপিন্দর সিং হুডার ছেলে দীপেন্দর সিং হুডা। লোকসভার পর বিধানসভাতেও বালাকোট এয়ারস্ট্রাইকের প্রভাব পড়ে। যার হাত ধরে টেনেটুনে বিধানসভার বৈতরণীও পার করে গেরুয়া শিবির। কারণ, হরিয়ানার বহু পরিবারের ছেলে চাকরি করেন সেনায়। মোটামুটিভাবে সেরাজ্যের প্রায় ২০-২৫ শতাংশ পরিবার কোনও না কোনওভাবে সেনার সঙ্গে যুক্ত। সেনার প্রতি ভালোবাসা এবং দেশের প্রতি আবেগ, দুটোই হরিয়ানার মাটিতে মিশে। উনিশে পুলওয়ামা হামলার পর যেভাবে বালাকোটে এয়ারস্ট্রাইকের সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন মোদি সরকার, তাতে সেনায় যুক্ত প্রত্যেকেরই মনে হয়েছিল কেন্দ্রে সাহসী এবং শক্তিশালী সরকার গঠন জরুরি।
কিন্তু গত পাঁচ বছরে সে রাজ্যের পরিস্থিতি অনেক বদলে গিয়েছে। রাজ্যের এবং কেন্দ্রের দুই বিজেপি সরকারেরই বয়স হয়েছে ১০ বছর। দানা বাঁধতে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। সেই সঙ্গে বিজেপি সরকারের একাধিক সিদ্ধান্ত ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে হরিয়ানার রাজনীতিকে। যে সেনার প্রতি আবেগ এতদিন হরিয়ানায় বিজেপির শক্তি ছিল, সেই আবেগই এখন গেরুয়া শিবিরের জন্য শাঁখের করাত। কারণ, কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকারেরই প্রকল্প ‘অগ্নিবীর’। সেনার চাকরি মাত্র চার বছরের! ভাবতেই পারেন না হরিয়ানার জাঠ যুবকরা। আসলে হরিয়ানার ১৮-১৯ বছরের ছেলেমেয়েরা, সেনায় যোগ দেওয়ার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেন। ভোররাতে উঠে শরীরচর্চা, দিনভর চাষের কাজ, রাতে সেনায় যোগ দেওয়ার জন্য পড়াশোনা। এই তাঁদের রুটিন। বছরের পর বছরের পরিশ্রমের পর যদি চাকরি জোটে মাত্র ৪ বছরের জন্য, সেটা যে কারও পক্ষেই মেনে নেওয়া কঠিন। কেন্দ্রের এই ‘চার বছরের নকরি’ তাই একেবারে নাপসন্দ হরিয়ানার। অগ্নিবীর প্রকল্প ঘোষণার পর সবচেয়ে বেশি বিক্ষোভ হয়েছিল এ রাজ্যেই। অগ্নিবীররাই এবার হরিয়ানায় পথের কাঁটা বিজেপির। জাঠ যুবকদের প্রশ্ন, “৭৩ সাল কা বুজরুগ্ আদমি তিসরি বার প্রধানমন্ত্রী বন সকতা হ্যায়, বিশ সাল কা যুবা সির্ফ চার সাল কে নকরি কিউ কারে?”
কংগ্রেসও এবারের নির্বাচনে অগ্নিবীরকেই মূল হাতিয়ার করছে। রাহুল গান্ধী সে রাজ্যে গিয়ে বলে এসেছেন, “ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় এলে অগ্নিবীর প্রকল্প ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলা হবে।” কংগ্রেস যেভাবে অগ্নিপথ নিয়ে মুখর সেটা বেশ চাপে ফেলেছে বিজেপিকে। ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়েই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হাতিয়ার করতে হচ্ছে সেনার শৌর্য। তিনি হরিয়ানার সভায় সভায় গিয়ে বলছেন, হরিয়ানার ছেলেদের সীমান্তে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে পারে তাঁর সরকারই। কোনও জোট সরকার নয়। যদিও প্রশ্ন যেহেতু রুজিরুটির, মোদির সেই আবেগি ভাষণ বিশেষ কাজে লাগছে না। অন্তত তৃণমূল স্তরে অগ্নিবীরের বিরোধটাই বেশি।
এ তো গেল জওয়ানদের কথা, এবার আসা যাক কিষানদের কথায়। গত পাঁচ বছরে মোদি সরকারকে সবচেয়ে বেশি বিব্রত করেছে কৃষক আন্দোলন। হরিয়ানায় যখন ভোট প্রক্রিয়া চলছে তখনও বিভিন্ন প্রান্তে কৃষক বিদ্রোহ অব্যাহত। সেই বিক্ষোভের তীব্রতা এতটাই যে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খাট্টারকে ঘুরতে হচ্ছে জেড ক্যাটেগরির নিরাপত্তা নিয়ে। তাঁর নাকি প্রাণসংশয় কৃষকদের থেকে। বস্তুত কৃষক বিক্ষোভ নিয়ে মোদি সরকারকে আগেও পিছু হঠতে হয়েছে। কৃষকদের কিছু দাবিও মানা হয়েছে। কিন্তু এমএসপির গ্যারান্টি বিজেপি দেয়নি। উলটো দিকে কংগ্রেসের ইস্তেহারে ফলাও করে লেখা হয়েছে, ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় এলে আইন এনে ন্যূনতম সমর্থন মূল্যের গ্যারান্টি দেবে কংগ্রেস। ফলে কৃষকদের আশীর্বাদও এবার পাথেয় হতে পারে হাত শিবিরের। জওয়ান এবং কিষান, হরিয়ানার দুই স্তম্ভই বিজেপির উপর নারাজ। যার প্রভাব যেমন লোকসভার ভোটে পড়তে চলেছে, তেমনই পড়তে চলেছে বিধানসভাতেও।
এমনিতে দেশের অন্য প্রান্তে মহিলাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় মোদি। করোনার (Coronavirus) সময় সরাসরি অ্যাকাউন্টে টাকা, মাসে ৫ কেজি রেশন, ঘরে ঘরে শৌচাগার, উজ্জ্বলা যোজনার গ্যাস মহিলাদের মধ্যে আলাদা জনপ্রিয়তা তৈরি করেছে প্রধানমন্ত্রীর। কিন্তু এই জায়গাটিতেও ব্যতিক্রম হরিয়ানা। কারণ, ব্রিজভূষণকাণ্ড। যেভাবে দিল্লির রাজপথে দিনের পর দিন পড়ে থাকতে হয়েছে হরিয়ানার কুস্তিগিরদের, যেভাবে অলিম্পিকে পদকজয়ী মহিলা কুস্তিগিরদের রাজধানীর রাজপথে ফেলে মেরেছে পুলিশ, তাতে বুক কেঁপেছে হরিয়ানার মায়েদের। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল যার জন্য এত কাণ্ড, সেই ব্রিজভূষণ শরণ সিং এখনও বহাল তবিয়তে ঘুরছেন। তাঁর ‘দবদবা’ এখনও দেখা যাচ্ছে বিজেপিতে। টিকিট পেয়েছেন তাঁর ছেলে। ব্রিজভূষণকে এভাবে আড়াল করাটা যেন মেনে নিতে পারছে না মহিলা সমাজ।
হরিয়ানার রাজনীতি অনেকাংশ নিয়ন্ত্রিত হয় খাপের মাধ্যমে। প্রায় প্রতিদিনই হুঁকার আসরে রাজনীতি নিয়ে পরামর্শ করেন এলাকার বয়স্করা। সেই আসরে কান পাতলেই বোঝা যাবে, এবার দিল্লির সীমানা লাগোয়া রাজ্যটিতে হাওয়া বইছে উলটো সুরে। অধিকাংশ খাপই এবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, ‘ভাজপা আর নয়। ছোড়ো কে সাথ না-ইনসাফি, ছোড়িও কে সাথ ছেড়ছাড়’ তাঁরা মানবেন না। বস্তুত এবার ভোটপ্রচারে হরিয়ানায় হেন কোনও বিজেপি প্রার্থী নেই, যাঁদের গ্রামের দিকে বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়নি।
হরিয়ানার রাজনীতি একটা সময় ছিল পুরোপুরি জাঠ নির্ভর। এমনিতে রাজ্যের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২৪ শতাংশ জাঠ। কিন্তু রাজ্যে তাঁরা এতটাই প্রভাবশালী যে পুরো রাজনীতিটাই নিয়ন্ত্রণ করতেন তাঁরা। হরিয়ানার মাটি থেকে চৌধুরী দেবীলালের মতো সর্বভারতীয় নেতাও এসেছেন। যদিও ২০১৪ সালে জাঠেদের পালটা একটা ন্যারেটিভ তৈরি করে বিজেপি। অজাঠ সব জাতিকে একত্রিত করে। মুখ্যমন্ত্রী করা হয় মনোহরলাল খাট্টারকে। গত ১০ বছর চলছিল অজাঠ সমীকরণেই। অন্যদিকে জাঠ ভোট ভাগ হয়েছে দু’ভাগে। কিছুটা গিয়েছে লোকদলের খাতায়, কিছুটা গিয়েছে কংগ্রেসের খাতায়। ফলে অজাঠ ভোটারদের একত্রিত করে সাফল্য পেয়েছে গেরুয়া শিবির। এবার সেই সমীকরণ কাজ করছে না। কারণ, জাঠেরা এবারের লোকসভায় (Lok Sabha 2024) প্রবল ভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন। ভোট ভাগাভাগির সুযোগ নেই। শেষবেলায় এসে জেজেপির (JJP) সঙ্গে জোট ভেঙে জেজেপিকে দিয়ে জাঠ ভোট ভাঙানোর একটা চেষ্টা গেরুয়া শিবির করেছিল। কিন্তু সেটা সেভাবে তৃণমূল স্তরে প্রভাব ফেলেনি। জাঠেরা এখন হরিয়ানায় কংগ্রেসের মূল পুঁজি। সঙ্গে যোগ হচ্ছে অগ্নিবীর (Agniveer) বিক্ষোভ, কৃষক বিক্ষোভ, এবং কুস্তিগিরদের অসন্তোষ। দলিতদের একটা অংশও সংবিধান বদলে যাওয়ার ভয়ে কংগ্রেসের দিকে ভিড়ছেন। সেই সঙ্গে রয়েছে মুসলিম ভোট। সব মিলিয়ে একটা বেশ শক্তিশালী জাতপাতের সমীকরণ তৈরি হচ্ছে কংগ্রেসের পক্ষে।
ও আরেকজনের কথা বলা হয়নি। গুরমীত রাম রহিম। সদ্য প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খাট্টারের বন্ধু। ধর্ষক বাবার এখনও কয়েক লক্ষ অনুগামী রয়েছে পাঞ্জাব লাগোয়া গ্রামগুলোতে। তাঁরা বাবার একনিষ্ঠ অনুগামী। ভোটটাও সেখানেই দেন, যেখানে গুরমীত রাম রহিম (Gurmeet Ram Rahim) নির্দেশ দেন। কিন্তু খাট্টারকে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরানোয় তিনিও অসন্তুষ্ট। তাঁর অসন্তোষের আরও একটা কারণ আছে। অন্যান্য বছর ভোট এলেই কোনও এক রহস্যজনক অজুহাতে প্যারোল পেয়ে যান রাম রহিম। এবার সেটা তিনি পাননি। তাঁর অনুগামীদের কাছে তাই কোনও বার্তাও পৌছয়নি। বাবার অনুগামীদের সব ভোট এবার বিজেপির বাক্সে পড়বে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
এতক্ষণ পড়ার পর পাঠকদের মনে হতেই পারে, হরিয়ানায় হয়তো কংগ্রেসের ঝড় উঠতে চলেছে। কিন্তু কাহানি মে টুইস্টও আছে। সেই টুইস্টটি হলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। দ্বিতীয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হরিয়ানায় কংগ্রেসে অন্তত গোটা তিনেক গোষ্ঠী। এক, ভুপেন্দ্র সিং হুডার গোষ্ঠী। দুই, রণদীপ সিং সুরজেওয়ালার গোষ্ঠী। তিন, কুমারী শৈলজার গোষ্ঠী। এর বাইরেও একাধিক উপগোষ্ঠী রয়েছে। বলতে গেলে ওই ছোট্ট রাজ্যটিতে কংগ্রেসের অবস্থা কর্কটসম। কোনও নেতার সাফল্যই সহ্য হয় না অন্য নেতাদের। বলা ভালো, এত সম্ভাবনাময় রাজ্যে কংগ্রেসকে পিছু টানছে কংগ্রেসই। এবার আসা যাক প্রথম টুইস্টটিতে। নরেন্দ্র মোদি। এত অসন্তোষ সত্ত্বেও দেশের অন্য প্রান্তের মতো মোদির প্রতি আলাদা আবেগ আছে হরিয়ানাবাসীর। সেটা এবারের লোকসভাতেও ফায়দা দেবে গেরুয়া শিবিরকে।
হরিয়ানার যে খাপগুলির কথা বলা হচ্ছিল, সেই খাপেই এখনও আলোচনা চলছে, প্রতিটি লোকসভা কেন্দ্রে অন্তত দেড় লক্ষ থেকে দুলক্ষ ভোট পড়বে মোদির নামে। তাছাড়া রামমন্দির ফ্যাক্টর পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা যায় না। এখন সেই বাড়তি ভোট প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কতটা কাটিয়ে উঠতে পারবে, সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। তবে একটা জিনিস নিশ্চিত, এবার দশে দশ হচ্ছে না। লড়াইটা পঞ্চাশ-পঞ্চাশ। হয়তো খানিক ঝুঁকে বিরোধীদের দিকেই। বিরোধী বলতে এখানে শুধু কংগ্রেস নয়। আপও। কারণ আপ এবং কংগ্রেস এ রাজ্যে জোট বেঁধেছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.