সোমনাথ রায়, পুলওয়ামা: বুরহান ওয়ানি। আদিল আহমেদ দার। সাম্প্রতিক অতীতে যে কয়েকজন সন্ত্রাসবাদীকে নিয়ে উত্তাল হয়েছে ভূস্বর্গ, তাদের প্রথম সারিতেই থাকবে এই দুই নাম।
২০১৬ সালের ৮ জুলাই। হিজবুল মুজাহিদিনের পোস্টার বয় বুরহানের মৃত্যুর পর উত্তাল হয় উপত্যকা। একটানা ৫৩দিন জারি থাকে কার্ফু। বুরহানকে অনুকরণ করে কাশ্মীরের প্রচুর যুবক নাম লেখায় বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনে। যাদের মধ্যে অন্যতম আদিল আহমেদ দার। ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। পুলওয়ামার লেথোপারোয়া সিআরপিএফ কনভয়ে হানা দেয় স্থানীয় যুবক আদিল। লাল রংয়ের মারুতিতে রাখা আরডিএক্সের আঘাতে সিআরপিএফ জওয়ানদের রক্তে লাল হয়ে যায় তুষারাবৃত উপত্যকা।
পুলওয়ামা হানার অর্ধবর্ষের আগেই ফের উত্তপ্ত হয় কাশ্মীরের পরিবেশ। না, এবার আর কোনও আতঙ্কি হানায় নয়। সংসদে পাশ হয় জম্মু-কাশ্মীর পুনর্গঠন আইন। বিলুপ্ত হয় জম্মু-কাশ্মীরের বড় অংশের মানুষের অহঙ্কারের ৩৭০ ধারা। হারিয়ে যায় রাজ্যের তকমা। ভেঙে তৈরি হয় নতুন দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। লাদাখ ও জম্মু-কাশ্মীর। এরপর কেটে গিয়েছে পাঁচ-পাঁচটি বছর। দীর্ঘ অপেক্ষার পর স্থানীয়রা সুযোগ পাচ্ছেন নিজেদের বিধায়ক বেছে নেওয়ার। সাধারণত, লোকসভা নির্বাচনে কাশ্মীর সেভাবে অংশ নিত না, তবে বিধানসভা নির্বাচনে ভোটদানের হার থাকত চমকপ্রদভাবে বেশি। অথচ, এবারের লোকসভা নির্বাচনেও ভোটদানের হার ছিল খুবই বেশি। বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা, ৩৭০-এর জবাব দিতে ও বিজেপিকে রুখতে লোকসভা নির্বাচনে বেড়েছিল ভোটের হার। সেই ট্রেন্ড বজায় থাকার কথা বিধানসভাতেও। কাশ্মীরের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে একবার ঢুঁ দিতেই হত এই কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদীর বাড়িতে। সেইমতো প্রথমেই পৌছে যাওয়া পুলওয়ামা ঘাতক আদিলের বাড়ি।
২০১৯-এর পর ২০২৪। কেটে গিয়েছে পাঁচ-পাঁচটা বছর। সময়ের নিয়ম মেনেই বদলেছে অনেক কিছু। শ্রীনগর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে গান্ডিবাগ গ্রামের দোতলা বাড়িটাতেও এসেছে বদল। পাঁচ বছর আগে বাড়ির দেওয়ালে, দরজায়, জানলায় রং না থাকলেও, এখন তাতে রংয়ের ছোঁয়া। একতলার দেওয়ালের কিছুটা জায়গা সবুজ, দরজা-জানলায় বাদামি রং থাকলেও বাকি প্রায় গোটা বাড়ি জুড়েই বিভিন্ন শেডের নীল রং। বাড়িতে ঢুকতেই বেরিয়ে এলেন আদিলের মা, সঙ্গে ছোট ভাইয়ের বউ। আদিলের মা বলছিলেন, “কেয়া বোলু বেটা? কুছ ভি বোলুঙ্গা তো ফির হামে তঙ্গ করনে লগেঙ্গে।” আদিলের ভাইয়ের বউয়ের বক্তব্য, “আমার বিয়ে হয়েছে সেই ঘটনার পরে। তবে মাঝেমধ্যেই বাড়িতে ফোর্সকে এসে পুছতাছ করতে দেখেছি।” কথা বলতে বলতে চোখ মুছতে দেখা গেল আদিলের মাকে। বললেন, “আমার ছেলেটা এমন ছিল না। গ্রামের যে কাউকে জিজ্ঞেস করুন। পড়াশুনোয় ভাল ছিল। ছোট থেকে ওর বাবার সঙ্গে মজুরি করে নিজের পড়ার খরচ তুলে নিত। ১২ ক্লাসের দু’টো পেপারও দিয়েছিল। তারপরই ঘর থেকে পালিয়ে গেল।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আসলে আমার ভাসুরের ছেলে প্রথম এই গ্রামে বিপথে যায়। তার পর আর্মি এসে গ্রামের ছেলেদের তুলে নিয়ে যেত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। সেই থেকেই যেন আদিল একটু একটু বিগড়ে যেতে লাগল। তারপর ওই যখন বুরহান মারা গেল, আদিলের পায়ে গুলি লাগল। সেই বিষটাই যেন ওর মাথায় ছড়িয়ে গেল।”
আদিলের বাড়ি থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে ত্রালের শরিফাবাদ গ্রামে বাড়ি বুরহান ওয়ানির। যাওয়ার পথেই পরে সেই অভিশপ্ত পুলওয়ামা। কেশর, সর্ষে খেত, আপেল, চিনার, আখরোটের জঙ্গল পার করে বুরহানের বাড়ি গিয়ে দেখা তার বাবা মহম্মদ মুজফফর ওয়ানির সঙ্গে। অতীব শিক্ষিত লোক। তেমনই মার্জিত। বিজ্ঞানের শিক্ষক মুজফফর দীর্ঘদিন সামলিয়েছিলেন ত্রাল গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব। অবসরের পরও সরকার তাঁকে মুক্তি দেয়নি। দক্ষিণ কাশ্মীরের জোনাল এডুকেশন অফিসারের পদে বসানো হয় তাঁকে। সেখান থেকে অবসর নিয়েছেন বছর দুয়েক আগে। এদিন আলাপপর্ব মেটার পরই হাতজোড় করে বললেন, “আমি কিন্তু কোনও কথা বলব না। বললে সত্যিটা বলতে হয়। আর সত্যি কথা বললেই যে আমায় তুলে নিয়ে যাবে।” কথায় কথায় বলছিলেন, “ছোটবেলায় বুরহানের ইচ্ছে ছিল ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমিতে যাবে। সেনায় যোগ দেবে। অথচ ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর পরিহাস দেখুন, সেই সেনার হাতেই…”
বেশ কিছুক্ষণ নানা কথা বলে আজানের শব্দ আসতেই নমাজ পড়তে বাড়ি লাগোয়া মসজিদের দিকে রওনা দিলেন বুরহানের বাবা। সেখানে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিবেশিরা যা বললেন, তার নির্যাস – “বুরহান অন্যায় করেছিল, তবে ওঁকে বন্দি করা যেত। ওঁ তো কাউকে হত্যা করেনি, কোনও নাশকতাতেও যুক্ত ছিল না। বুরহান শুধু বেশ কয়েকজন তরুণ, কিশোরকে দলে টেনেছিল। তবু যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায়, ওকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, এটাও দেখতে হবে পড়াশুনোয় তুখোড় একটা ছেলে এত বড় সিদ্ধান্ত নিল কেন? আসলে আমাদের দেশে রাষ্ট্রের দোষ কেউ দেখে না। এই যে ৩৭০ নিয়ে এত প্রচার হচ্ছে। মিথ্যের ফুলঝুড়ি বইছে যে জম্মু-কাশ্মীর শান্ত। শুধু গত সাত-দশদিনেই কতগুলো ঘটনা ঘটেছে বলুন তো? আসলে কাশ্মীর ভালো থাক এটা কেউ চায় না। না ইন্ডিয়া, না পাকিস্তান। মাঝখান থেকে মরছি আমরা।”
আদিল, বুরহানের বাড়ির লোকের কথা শুনে মনে হল নিজেদের এলাকার যুবদের বোঝাতে হয়তো বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে হতভাগ্য পরিবারগুলিকেই। সন্তান বিপথে গেলে তার সবথেকে বড় খেসারত যে দিতে হয় তাঁদেরই। নিরাপত্তাকর্মী ও অন্যান্য এজেন্সির তদন্ত যেমন আছে, তেমনই আছে ঘর খালি হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা। বৃদ্ধ বয়সে সাহারা হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট। তাই আদিলের মা, বাবা, ভাই, বউমা আবার বুরহানের বাবা, মা, দাদুদেরও স্থানীয়দের বোঝাতে হবে তাঁদের বাড়ির ছেলের মত জঘন্য অন্যায় যেন তারাও না করে। আবার নতুন প্রজন্মকেও বুরহান, আদিলদের বয়স্ক মা-বাবাদের দেখে নিজেদের মা-বাবার ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে। অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। বুঝতে হবে যে বা যারা তাদের মাথা চিবোচ্ছে তাদের দেওয়া অর্থে বাড়ির বয়স্কদের সারাজীবন কাটবে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.