সংবাদ প্রতিদিন ব্যুরো: ১৯৯১ সালে বলিউডের ‘১০০ ডেজ’-এর সেই দৃশ্য৷
দেওয়ালের প্লাস্টারের সরু ফাটল থেকে বেরিয়ে একটা চুল৷ তাই দেখেই রহস্যভেদ৷ দেওয়াল ভেঙে ‘নায়িকা’ মুনমুন সেনের কংক্রিট দেহ উদ্ধার বোন মাধুরী দীক্ষিতের৷
সিনেমায় খুনিকে সাহায্যকারীর ভূমিকায় ছিলেন অভিনেতা জ্যাকি শ্রফ৷ আর ভোপালে সেই চিত্রনাট্যের হুবহু বাস্তব রূপ৷
প্রেমিকা অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত৷ এই সন্দেহের বশে তাকে খুন করে ট্রাঙ্কে পুরে সিমেণ্ট দিয়ে কংক্রিটের বেদি বানিয়ে দিল প্রেমিক৷ প্রায় পাঁচ ফুট লম্বা সেই ট্রাঙ্ক৷ ব্যবহার করা হয়েছে প্রায় দশ বস্তা সিমেণ্ট৷ এখানেই শেষ নয়৷ বেদি বানিয়ে তার উপর মার্বেল বসিয়ে রীতিমতো পূজার্চনা চলত৷
প্রায় ৬-৭ মাস আগে ঘটনার সূত্রপাত৷ বাঁকুড়ার মেয়ে আকাঙ্ক্ষা শর্মার সঙ্গে ফেসবুকে আলাপ উদয় দাসের৷ উদয়ের বাড়ি ভোপালের সাকেতনগরে৷ বেশ কিছুদিন ফেসবুক-প্রেমের পর উদয়ের টানে ঘর ছাড়েন আকাঙ্ক্ষা৷ বাড়িতে বলে যান আমেরিকায় চাকরির জন্য যাচ্ছেন৷ মাসটা জুলাই-আগস্ট৷ আকাঙ্ক্ষার বাবা বাঁকুড়ার এক ব্যাঙ্কের ম্যানেজার৷ বাবাকে তার পরে বেশ কয়েকবার ফোন করেছিলেন আকাঙ্ক্ষা৷ ফোনে বলেছিলেন আমেরিকায় রয়েছি৷ এই পর্যন্ত সব কিছু ঠিক ছিল৷
সময়টা ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ৷ ফোন আসা বন্ধ হয়ে যায় আকাঙ্ক্ষার৷ শুধুই চলে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, এসএমএস-এ বার্তালাপ৷ সন্দেহ হয় বাবার৷ খবর দেওয়া হয় পুলিশে৷ তদন্ত শুরু হয়৷ উঠে আসতে শুরু করে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য৷
পুলিশ জানিয়েছে, প্রথম প্রথম বাবার সঙ্গে নিয়মিত কথা হত আকাঙ্ক্ষার৷ সে বলেছিল, মোবাইল রোমিংয়ে আছে বেশিক্ষণ কথা বলা সম্ভব নয়৷ কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে বার্তালাপে সন্দেহ হয় বাবার৷ আকাঙ্ক্ষার মোবাইল টাওয়ারের লোকেশন দেখে পুলিশ জানতে পারে আমেরিকায় নয়, তার ফোন রয়েছে ভোপালে৷ সেই মতো যোগাযোগ করা হয় ভোপাল পুলিশের সঙ্গে৷ মোবাইল লোকেশন খুঁজে ভোপালে উদয়ের বাড়ি পৌঁছায় বাঁকুড়া পুলিশ৷ সঙ্গে ভোপাল পুলিশের বিশেষ দল৷ গ্রেফতার করা হয় উদয়কে৷ তাকে জেরা করেই পুলিশ জানতে পারে আকাঙ্ক্ষাকে খুন করেছে সে৷ খুনের পর একটা পাঁচ ফুটের ট্রাঙ্কে ভরা হয় আকাঙ্ক্ষার দেহ৷ তারপর প্রথমে দেহ, তারপর গোটা ট্রাঙ্কে সিমেণ্টের কংক্রিট বেদিতে পরিণত করা হয়৷ বেদির উপর বসানো হয় দামি মার্বেল পাথর৷ এই বেদির উপর নিত্যদিন আসন পেতে ধূপধুনো দিয়ে পুজো করত উদয়৷ এই বেদি তৈরি করা হয়েছিল উদয়ের ভোপালের ফ্ল্যাটের রান্নাঘরের মধ্যেই৷
উদয়কে জেরা করে পুলিশের সন্দেহ মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল উদয়৷ কখনওই একা থাকতে পারত না৷ উদয় গাড়ি চালানোর সময় তার পাশের সিটে কেউ না থাকলে টেডি বেয়ারকে সিটবেল্ট বেঁধে বসিয়ে রাখত৷ তার ভোপালের ফ্ল্যাট থেকে একাধিক দেশের পতাকা উদ্ধার করেছে পুলিশ৷ মাঝেমধ্যেই উদয় ফোনে বিভিন্ন পরিচিতর কাছে দাবি করত সে বিদেশে রয়েছে৷ তদন্ত শুরু করে ভোপাল পুলিশ এবং বাঁকুড়া পুলিশের যৌথ তদন্তকারীদের অনুমান, উদয় একটা গভীর ট্রমার মধ্যে থাকত সবসময়৷ সে মনে করত ‘সেই বিশ্বসেরা’৷ গ্রেফতারের পর উদয় দাবি করেছে, আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একাধিক পুরুষের সম্পর্ক ছিল৷ সেই সন্দেহেই তাকে খুন করে উদয়৷ যদিও পুলিশের কাছে প্রমাণ, একাধিক মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল উদয়ের৷ তার ভোপালের ফ্ল্যাটে নিত্যদিনই সুন্দরী মহিলাদের আনাগোনা লেগে থাকত৷
কিন্তু প্রতিবেশীদের উদয়ের ফ্ল্যাটে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল৷ মহিলা ছাড়া কেউ ফ্ল্যাটে এলেই তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করত উদয়৷ একাধিক মহিলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক জেনে ফেলেন আকাঙ্ক্ষা৷ তাই নিয়ে শুরু হয় আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে উদয়ের অশান্তি৷ পুলিশের ধারণা, এই অশান্তির জেরেই গলা টিপে আকাঙ্ক্ষাকে খুন করে উদয়৷ পুলিশকে ফাঁকি দিতে প্রথমে পাঁচ ফুট বাই তিন ফুট লোহার ট্রাঙ্কে আকাঙ্ক্ষার দেহকে ভরে উদয়৷ এমন করে সিমেণ্ট দিয়ে কংক্রিটে পরিণত করা হয় ট্রাঙ্ক সমেত আকাঙ্ক্ষার দেহ, যাতে ময়না তদন্তের বিষয়টি নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে৷ পুলিশ তিনটি ড্রিল মেশিন দিয়ে প্রায় ঘণ্টা সাতেকের চেষ্টায় আকাঙ্ক্ষার দেহ ‘সিমেণ্টমুক্ত’ করার চেষ্টা করে৷ কিন্তু গোটা দেহ এতটাই বিকৃত করা হয়েছে, যা ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের চিন্তার কারণ৷
বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা জানিয়েছেন, আকাঙ্ক্ষার বাবা পাটনার বাসিন্দা শিবেন্দ্র কুমার শর্মা কর্মসূত্রে পরিবার নিয়ে থাকেন বাঁকুড়ার রবীন্দ্র সরণিতে৷ পুলিশের এক পক্ষের অনুমান, গত জ্জ ডিসেম্বর রাতে খুন হন আকাঙ্ক্ষা৷ যদিও বাঁকুড়া পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা শুক্রবার সকালে সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছেন, ১২-১৩ আগস্ট খুন হন আকাঙ্ক্ষা৷ কিন্ত্ত সন্দেহ এড়াতে আকাঙ্ক্ষার ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপ চালু রাখে উদয়৷ ফলে সন্দেহ দেখা দিয়েছে, আকাঙ্ক্ষার ফোন ব্যবহার করে তার পরিচিত এবং আত্মীয়দের এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপ করত উদয়৷ জেরার মুখে উদয় দাবি করে, নিউ ইয়র্কের তাদের বিয়ে হয়৷ কিন্ত্ত স্বভাব খারাপ ছিল আকাঙ্ক্ষার৷ বাধ্য হয়েই সে খুন করে ওই তরুণীকে৷ পুলিশের অনুমান, আকাঙ্ক্ষার দেহ লোপাটে উদয়কে সাহায্য করেছিল তারই কোনও বন্ধু৷ সেই ‘সহযোগী’র খোঁজ চালাচেছ যৌথ তদন্তকারী দল৷
পুলিশ জানতে পেরেছে, অত্যন্ত ধনী পরিবারের ছেলে উদয়৷ তার বাবা বীরেন্দ্র মেহরা ভেলের প্রাক্তন আধিকারিক৷ ভোপালে একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, রায়পুরে একটি কারখানার মালিক৷ পরিবারের একমাত্র সন্তান উদয় অভিভাবক ছাড়াই মানুষ৷ নিজেকে ফেসবুক প্রোফাইলে দিল্লি আইআইটির ছাত্র বলে নিজেকে দাবি করত সে৷ যদিও তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷ উদয়ের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে আকাঙ্ক্ষার পাসপোর্ট৷ আকাঙ্ক্ষার পড়াশোনা পাটনা ও দিল্লিতে৷ বাঁকুড়ার ভাড়াবাড়িতেও তিনি যাননি কোনওদিন৷ ভিসা পাসপোর্টকে কেন্দ্র করেই উদয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে আকাঙ্ক্ষার৷ কারণ তিনি চাকরি খুঁজছিলেন৷ পুলিশের অনুমান, ফেসবুকে উদয়ের হাই প্রোফাইল পরিচয় পেয়েই প্রেমে পড়ে আকাঙ্ক্ষা৷ ডিসেম্বর মাস থেকেই আকাঙ্ক্ষার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউণ্ট থেকে দফায় দফায় লক্ষাধিক টাকা তোলায় সন্দেহ হয় শর্মা পরিবারের৷ এরপরই করা হয় এফআইআর৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.