ফাইল ফটো
দেবাশিস কর্মকার: সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কিংবা এনআরসি ইস্যু নয়। বরং ঝাড়খণ্ডে বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য স্থানীয় ইস্যুকেই দায়ী করছে বিজেপি। এর পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বেরও প্রভাব রয়েছে বলে তারা মনে করছে। দলেরই একাংশ ভরাডুবির জন্য মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাসের নেতৃত্বকে দায়ী করতে শুরু করেছেন। যদিও, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এই ভোটের একদিকে বিজেপির ‘একলা চলো নীতি’ এবং বিপরীতে কংগ্রেস, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা এবং রাষ্ট্রীয় জনতা দলের ‘শক্তিশালী’ জোটকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। তাছাড়া, আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্যটিতে একজন অআদিবাসী ‘মুখ’কে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরে নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়টিকে গেরুয়া শিবিরের বড় ‘ভুল’ হিসেবেও দেখছেন তাঁরা।
এবার ঝাড়খণ্ডে বিধানসভা ভোট হয়েছে পাঁচ দফায়। ৩০ নভেম্বর ও ৭, ১২, ১৬, ২০ ডিসেম্বর। এর মধ্যে ১০ ও ১১ ডিসেম্বর যথাক্রমে লোকসভা ও রাজ্যসভায় পাশ হয়েছে বহু বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। এরপরই সেই বিলের বিরোধিতায় সারা দেশ উত্তাল হয়। এর মধ্যেই রাষ্ট্রপতি বিলটিতে সম্মতি দেওয়ায় তা আইনেও পরিণত হয়েছে। ঝাড়খণ্ডের বাকি তিন দফার ভোট চলতে চলতে জাতীয় রাজনীতিতে ঝড় বয়ে গিয়েছে মাত্র দু’টি শব্দতে- ‘সিএএ’ এবং ‘এনআরসি’। সে কারণে ঝাড়খণ্ড ছোট রাজ্য হলেও, সারা দেশের রাজনৈতিক মহলের নজর ছিল সেখানকার বিধানসভা নির্বাচনে এর ফল কী হতে পারে তার উপর।
ভোটের ফলে দেখা যাচ্ছে সেখানে বিজেপি জোট ক্ষমতায় ফিরতে পারল না। ১২ আসন হারিয়ে তাদের হাতে ২৫টি আসন রইল। কিছু অংশ থেকে এর জন্য সিএএ এবং এনআরসিকে দায়ী করতে শুরু করছে। কিন্তু, ঝাড়খণ্ডের ফল নিয়ে চটজলদি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে না। এদিন রাত পর্যন্ত ফলাফলের যে গতিবিধি, তাতে প্রমাণ হচ্ছে না বিজেপির পরাজয়ে CAA বা এনআরসির ভূমিকা রয়েছে। প্রথম দু’টি পর্যায়ে ৩৩ আসনের ভোটে বিজেপির যে ফল, সিএএর পর হওয়া শেষ তিন পর্যায়ে হওয়া ৪৮ আসনের ফল তার থেকে অনেক ভাল। দেখা যাচ্ছে প্রথম পর্যায়ের ৩৩ আসনের মধ্যে এবার বিজেপির ঝুলিতে ছ’টি আসন। ২০১৪ সালে এই আসনগুলির মধ্যে বিজেপি দখল করেছিল ১৪টি আসন। অর্থাৎ, আসন হারিয়ে বা নতুন আসন পেলেও বিজেপির ক্ষতি আটটি আসন। অন্যদিকে সিএএ পরবর্তী ৪৮ আসনের মধ্যে বিজেপি ২০টি আসনে এবার জিতেছে। এই সংখ্যাটা ২০১৪ সালে ছিল ২৩। অর্থাৎ, জেতা আসন হারিয়ে বা নতুন আসন জিতে তাদের ক্ষতি মাত্র তিন।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঝাড়খণ্ডে ভোটপ্রচারে গিয়ে স্থানীয় ইস্যু বাদ দিয়ে বারবার অযোধ্যায় রামমন্দির, জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল এবং এনআরসি করে অনুপ্রবেশকারীদের দেশছাড়া করার কথা বলেছেন। ঝাড়খণ্ডের জনগণ তাতে সন্তুষ্ট হননি। তাই বিজেপির ক্ষমতায় ফেরা হল না। কিন্তু, ভোটের ফল অন্য কথা বলছে। সিএএর পর হওয়া ভোটে বিজেপি সিমারিয়া, হাতিয়া, সারাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলি নতুন করে জিতেছে।
২০১৪ সালের বিধানসভা নির্বাচন বা ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে এবারের ভোটের ফল মেলালে চলবে না। মনে রাখতে হবে আগের ভোটগুলি বিজেপি লড়েছিল অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়নের (আজসু) সঙ্গে জোট করে। গত বিধানসভায় বিজেপি একা পেয়েছিল ৩৭টি আসন, আজসু পেয়েছিল পাঁচটি আসন এবং আরেক শরিক জেভিএমপি পেয়েছিল ছ’টি আসন। তবে ওই দলের সব বিধায়ক পরে বিজেপিতে যোগ দেয়। বিজেপি এবার একা লড়াই করায় এবং বিরোধীরা জোট করায় তার একটা সুস্পষ্ট প্রভাব ভোটের ফলে পড়লেও, গেরুয়া দল কিন্তু হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দিয়েছে।
বিজেপির মুখপাত্র জিভিএল নরসিংহ রাও বলেন, কেন পরাজয় তার কারণ মূল্যায়ন করবে দল। তবে সমন্বয়ের অভাব এবং বিরোধী জোট ঐক্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটা বড় অংশও স্থানীয় ইস্যু এবং প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়াকে এই ফলাফলের জন্য দায়ী করছেন। ভোটে অর্থনৈতিক মন্দা যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে জামশেদপুর, বোকারো, ধানবাদের মতো শিল্পাঞ্চলগুলিতে। এখানকার জামশেদপুরের আদিত্যপুর অঞ্চলে কারখানা বন্ধের ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক। টেলকোর তত্ত্বাবধানে এখানে প্রায় ১৪০০টি শিল্প চলে। সম্প্রতি, টেলকোতে এমন অনেক দিন যাচ্ছে যখন এখানকার কাজ বন্ধ থাকছে। এর সব চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কারখানার উপর নির্ভরশীল শ্রমিকদের জীবন। স্পষ্টতই, ওই শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এর জন্যেই বিজেপি ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে। এটাও বিজেপির পরাজয়ের বড় কারণ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.