Advertisement
Advertisement
Gangaridai

বাংলার গঙ্গাহৃদি জনপদের শক্তি দেখে থমকে গিয়েছিলেন আলেকজান্ডারও! জানেন এর ইতিহাস?

কীভাবে ধ্বংস হয়েছিল এই আদিম জনপদ?

Interesting facts of Gangaridai। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:June 17, 2022 5:47 pm
  • Updated:June 17, 2022 5:54 pm  

বিশ্বদীপ দে: ”বাঙ্গালার ইতিহাস নাই, যাহা আছে, তাহা ইতিহাস নহে, … কতক উপন্যাস, কতক আমার পড়পীড়কদের জীবনচরিত মাত্র।” এই আক্ষেপ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। তবে সেই সময়ের পরে দীনেশচন্দ্র সেন, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্য়ায়, নীহাররঞ্জন রায়দের হাতে পড়ে বাঙালির ইতিহাসের একটা বিস্তৃত পরিকাঠামো তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তবুও আশ্চর্যজনক কুয়াশা জড়িয়ে থেকেছে এক প্রাচীন জনপদকে ঘিরে, যার নাম গঙ্গারিডাই (Gangaridai)। আরও নানা নাম রয়েছে। গঙ্গাহৃদি, গঙ্গাঋদ্ধি, গঙ্গারাঢ়ী ইত্যাদি। বঙ্কিমচন্দ্র ব্যবহার করেছিলেন ‘গঙ্গারাষ্ট্র’ শব্দটি। আজও এই সাম্রাজ্য সম্পর্কে খুব বিশদে কিছুই জানা যায়নি। তার কারণ দেশীয় ইতিহাসবিদদের উদাসীনতা। যদিও গ্রিক ও লাতিন ইতিহাসবিদ, পর্যটকরা তাঁদের কলমে বারবারই উল্লেখ করেছেন গঙ্গারিডির কথা। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকেও কিছুটা হদিশ মেলে বটে। তা সত্ত্বেও গঙ্গাহৃদিকে ঘিরে কুয়াশা থেকেই গিয়েছে। এই লেখায় আমরা অল্প করে ছুঁয়ে যাব সেই কুয়াশামাখা বিস্মৃত ইতিহাসকে।

গঙ্গাহৃদির সবচেয়ে পুরনো উল্লেখ আমরা পাই ‘বিবলোথেকা হিস্টোরিকা’ নামের এক বইয়ে। খ্রিস্টপূর্ব ১ সালে গ্রিক লেখক দিওদোরাস সিকিউলাসের লেখা এই বই ছাড়াও আরেক গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস তাঁর বিখ্যাত ‘ইন্ডিকা’ নামের বইয়েও উল্লেখ করেছিলেন এই জনপদের। বলা যায়, তাঁর বর্ণনাতেই গঙ্গাহৃদি সম্পর্কে সবথেকে বেশি তথ্য পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও টলেমি, প্লুটার্কের মতো গ্রিক লেখক এবং ভার্জিল, কার্টিয়াস রুফাস ও প্লিনির মতো রোমান লেখকদের বর্ণনাতেও জানা গিয়েছে গঙ্গাহৃদির কথা।

Advertisement
Map of ancient Bengal
‘গঙ্গারিডি ও বঙ্গভূমি’ বই থেকে প্রাপ্ত প্রাচীন প্রাচ্যদেশের ম্যাপ

[আরও পড়ুন: চারদিন ধরে ‘নিখোঁজ’ নূপুর শর্মা, মহারাষ্ট্র সরকারের দাবিতে চাঞ্চল্য]

এযাবৎ প্রাপ্ত সমস্ত তথ্য থেকে যতটুকু জানা যায়, তাতে গঙ্গাহৃদির বিলুপ্তির সময়কাল সেভাবে চিহ্নিত না করা গেলেও ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দই যে এই সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ, তা স্পষ্ট। আলেকজান্ডার ঠিক সেই সময়ই ভারত আক্রমণ করেছিলেন। ইতিহাসবিদদের দাবি, গঙ্গাহৃদি আক্রমণ করতে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। রাশ টেনেছিলেন ভারতজয়ের স্বপ্নে। এমনই প্রতাপ ছিল গঙ্গাহৃদির। তবে এই দাবি কেবল মাত্র বিদেশি ঐতিহাসিকদেরই।

Indika
মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকা’তেও উল্লেখ রয়েছে গঙ্গারিডি তথা গঙ্গাহৃদির

মেগাস্থিনিসের বর্ণনা থেকে জানা যায়, গঙ্গার সবচেয়ে পশ্চিম ও সবচেয়ে পূর্ব নদীমুখ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই জনপদ। যার রাজধানী ছিল চন্দ্রকেতুগড়। আজকের উত্তর ২৪ পরগনার এই ধ্বংসাবশেষ বহন করে চলেছে ইতিহাসের সেই সোনালি দিনের জলছাপ। মনে করা হয়, এটিই হল ইতিহাসবিদদের বর্ণনার ‘গাঙ্গে’। এখানেই থাকতেন প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ খনা ও মিহির। তাঁদের দুর্গের ধ্বংসাবশেষের দেখা আজও মেলে চন্দ্রকেতুগড়ে।
গঙ্গাহৃদির পাশেই ছিল আরেক জনপদ প্রাসি। মহাপদ্মনন্দ ছিলেন এই প্রাসির রাজা। পরবর্তী সময়ে গঙ্গাহৃদিও দখল করে নেন তিনি। এই দুই জনপদকে নিয়েই তৈরি হয়েছিল প্রাসি-গঙ্গাহৃদি যুক্তরাষ্ট্র। সব মিলিয়ে ১ হাজার অশ্বারোহী, ৬০ হাজার পদাতিক সৈন্য থাকলেও গঙ্গাহৃদির ৭০০ হাতির বিরাট বাহিনী ছিল শত্রুর কাছে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের কারণ। আগেই বলা হয়েছে ‘আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটে’র পিছিয়ে আসার কথা। তার পিছনে গঙ্গাহৃদি ও তার হস্তিবাহিনীই ছিল বিরাট ফ্যাক্টর।

Alexander
আলেকজান্ডা দ্য গ্রেট

[আরও পড়ুন: রাষ্ট্রসংঘে ফের চিনা প্রাচীর, পাক জঙ্গিকে নিষিদ্ধ করার ভারতের চেষ্টায় জল ঢালল বেজিং]

গঙ্গাহৃদি তথা গঙ্গারিডির অধিবাসীদের বলা হত গঙ্গারিডাই। কারা এই গঙ্গারিডাই? এ নিয়ে বিভিন্ন মত থাকলেও প্রভাতকুমার ঘোষের ‘গঙ্গারিডি ও বঙ্গভূমি’তে বলা হয়েছে ‘গঙ্গারিডির ইতিহাস প্রাচীন বাঙ্গালীর ইতিবৃত্ত ব্যতীত আর কিছুই নয়।’ এদিকে নীহাররঞ্জন রায়ের বিখ্যাত ‘বাঙ্গালির ইতিহাস’ বইে বলা হয়েছে, “গঙ্গারিডাই-রা যে গাঙ্গেয় প্রদেশের লোক এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই, কারণ গ্রিক লাতিন লেখকরা এ সম্বন্ধে একমত।” অর্থাৎ এই গৌরব বাঙালিরই গৌরব বলে মনে করা হয়।

মহাপদ্মনন্দও কি বাঙালি ছিলেন? তেমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেন না ইতিহাসবিদরা। নন্দবংশীয়দের বাঙালি বলেই মনে করা হয় পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে। তবে সেই দাবি সংশয়াতীত নিশ্চয়ই নয়। প্রভাতকুমার জানাচ্ছেন, ”এই শক্তিমান নরপতির গঙ্গারিডি তথা বাঙ্গালী হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল।… নন্দবংশীয়দের বিভিন্ন দিক থেকেই বাঙ্গালী বলে অভিহিত করা হয়েছে।” তবে এই বিষয়টি ”ইতিহাসগতভাবে বিশদ পরীক্ষার দাবি করে” বলে মনে করছেন তিনি। কুয়াশা এইভাবেই জড়িয়ে রয়েছে।

Wari-Boteshwar
প্রাচীন গঙ্গাহৃদি সাম্রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত ছিল আজকের বাংলাদেশেও

যাই হোক, এই অপ্রতিরোধ্য গঙ্গারিডি সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি লোভ দেখাত সাম্রাজ্যবাদীদের। কিন্তু আলেকজান্ডারের মতো বাকিরাও বারবার পিছিয়ে এসেছে। মিশর থেকে চিন, নানা দেশই বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল গঙ্গাহৃদির সঙ্গে। ‘গঙ্গারিডি ও বঙ্গভূমি’ থেকে জানা যাচ্ছে, ”প্রাচীনকালে সামুদ্রিক জাতি হিসেবে গঙ্গারিডিদের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি দুইই ছিল।” কিন্তু পরবর্তী সময়ে বঙ্গদেশ ভারতের পশ্চাদভূমিতে পরিণত হওয়ার ফলেই সমুদ্র সম্পর্কে ক্রমেই বিমুখ হয়ে পড়ে তারা। আর তার ফলেই গঙ্গারিডির আর্থিক পতনের সম্ভাবনা আরও দ্রুত হয়। মনে করা হয় এর ফলেই ক্রমে বিলীন হয়ে যায় এক বর্ধিষ্ণু জনপদ।

কিন্তু কেন এই ইতিহাস সম্পর্কে এমন নীরবতা? ভাবলে সত্য়িই অবাক লাগে। যেখানে মেগাস্থিনিস, ভার্জিল, টলেমিরা তাঁদের লেখায় উল্লেখ করেছেন প্রাচীন ভারতের এই শক্তিশালী সাম্রাজ্যের কথা, সেখানে ভারতের অধিকাংশ ইতিহাসবিদই নীরব। তবে রাখালদাসের মতো ঐতিহাসিকরা কিন্তু লিখেছেন। কাজেই সবদিক বিচার করলে গঙ্গাহৃদিকে কোনও গল্পকথা বলে দাবি করা অর্থহীনই। হয়তো ভবিষ্য়তে এর গায়ে লেগে থাকা কুয়াশাকে সরিয়ে দিতে পারা সম্ভব হবে। ঝকঝকে রোদে শানিত হয়ে উঠবে বঙ্গদেশের ইতিহাসের এক আশ্চর্য অধ্যায়।

২০২৪ এর পূজা সংক্রান্ত সমস্ত খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের দেবীপক্ষ -এর পাতায়।

চোখ রাখুন
Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement