বিশ্বদীপ দে: ইতিহাস মানেই পুরনো দিনের কথা। কিন্তু তা ‘ফুরনো’ কথা নয় মোটেই। বর্তমানের শরীরের ভিতরে সে ফিরে আসে নতুন নতুন চেহারায়। এই মুহূর্তে জাতীয় রাজনীতিতে সর্বাধিক আলোচ্য বিষয় নিঃসন্দেহে রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজের বিষয়টি। সুরাটের আদালতে ২ বছরের জেলের রায়ের পরই সংসদের সদস্যপদও খোয়াতে হয়েছে কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতিকে। আর এই পরিস্থিতিতে উঠে আসছে রাহুলের ঠাকুমা ইন্দিরা গান্ধীর কথা। তাঁরও যে সাংসদ পদ খারিজ হয়েছিল। গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন তিনি। এত কিছুর পরও অবশ্য ফের স্বমহিমায় ফিরেও এসেছিলেন মসনদে। রাহুলের (Rahul Gandhi) পরিস্থিতি কী হবে, সেকথা ভবিষ্যৎ বলবে। তবে আপাতত বলাই যায়, রাহুলের বর্তমান পরিস্থিতি ইন্দিরার সেই ইতিহাসকে ফিরিয়ে এনেছে নতুন করে। এই লেখায় আমরাও সংক্ষেপে একবার দেখে নেব কয়েক দশক পিছনে ফেলে আসা দিনগুলি।
১৯৭৫ সালে সাংসদ পদ খারিজ হয় ইন্দিরার (Indira Gandhi)। মামলাটি অবশ্য দায়ের হয়েছিল বছর চারেক আগে, ১৯৭১ সালে। সেই বছর লোকসভা নির্বাচনে হারের পর এলাহাবাদ হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন সংযুক্ত সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা রাজ নারায়ণ। রায়বরেলি কেন্দ্রে তিনিই ছিলেন ইন্দিরার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর অভিযোগ ছিল, ভোটে জিততে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন ইন্দিরা। ভেঙেছেন জনপ্রতিনিধিত্ব আইন। তাই বাতিল করতে হবে ইন্দিরার নির্বাচনকে। খারিজ করতে হবে তাঁর সাংসদ পদ। ১৯৭৫ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহন লাল সিনহা রায় দেন ইন্দিরার প্রতিকূলেই। খারিজ করে দেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রধানমন্ত্রীর সাংসদ পদ। নির্বাচনে লড়তে পারবেন না পরবর্তী ৬ বছর।
ইন্দিরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। ১২ দিন পরে রায় দেয় শীর্ষ আদালত। হাই কোর্টের রায়ে শর্তাধীন স্থগিতাদেশ দেন বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণ। ফলে ইন্দিরার প্রধানমন্ত্রিত্ব অক্ষত রইল। কিন্তু চূড়ান্ত রায় না দেওয়া পর্যন্ত কোনও ধরনের সংসদীয় ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের অধিকার কেড়ে নেওযা হল। এমনকী সাংসদ হিসেবে বেতনও নিতে পারবেন না তিনি। স্বাভাবিক ভাবেই এই পরিস্থিতিতে ইন্দিরা বুঝে যান, পরিস্থিতি তাঁর অনুকূলে যাচ্ছে না। পরদিনই তিনি জারি করেন জরুরি অবস্থা।
২৫ জুন, ১৯৭৫। ভারতের জনতার যখন ঘুম ভাঙল, জারি হয়ে গিয়েছে জরুরি অবস্থা। এরপরই উচ্চারিত হয়েছিল সেই বাক্য, যা সেই সময়ের পরিস্থিতিকে জলের মতো স্বচ্ছ করে তোলে। ১৯৭৬ সালের গুয়াহাটি কনক্লেভে নেত্রীর উদ্দেশে দেবকান্ত বড়ুয়া বলে ওঠেন, ”ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা অ্যান্ড ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া।” ভারতই ইন্দিরা, ইন্দিরাই ভারত। তৎকালীন কংগ্রেসের জাতীয় সভাপতির এই স্তূতিবাক্য মিথ হতে সময় নেয়নি। কে ভাবতে পেরেছিল পরের বছরই গ্রেপ্তার হতে হবে ইন্দিরাকে।
এপ্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা দরকার। জরুরি অবস্থা কেবলই ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি বাঁচাতে মরিয়া ইন্দিরার বাধ্যত পদক্ষেপ মাত্র নয়। দীর্ঘদিন ইন্দিরার ব্যক্তিগত সচিব থাকা পি এন ধর তাঁর ‘ইন্দিরা গান্ধী, দ্য এমার্জেন্সি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ডেমোক্রেসি’ বইয়ে এমনই দাবি করেছেন। তাঁর মতে, দুর্নীতি ও ইন্দিরার নেতৃত্বের সমালোচনায় মুখর জয়প্রকাশ নারায়ণ ছিলেন এই বিষয়ে খুব বড় একটা ফ্যাক্টর। তাঁর নেতৃত্বে চলতে থাকা আন্দোলনে নাকি দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ার জোগাড় হয়েছিল। হিংসা বাড়ছিল। তাই জরুরি অবস্থায় হাঁটা ছাড়া নাকি ইন্দিরার উপায় ছিল না।
স্বাধীনতার পর গত সাড়ে সাত দশকের ইতিহাসে জরুরি অবস্থা যে কত বড় অধ্যায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একে নিয়ে ব্যাখ্যাও নানা রকম থাকবে তা বলাই বাহুল্য। তবে কারণ যাই হোক, এই সিদ্ধান্ত যে ইন্দিরাকে ব্যাকফুটেই ঠেলে দিয়েছিল, এবিষয়ে ওয়াকিবহাল মহল মোটামুটি একমতই। ১৯৭৫ সালের জুন থেকে শুরু হওয়া জরুরি অবস্থা শেষ হয় ১৯৭৭ সালের মার্চে। এরপর হওয়া সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসকে কার্যত উড়িয়ে দিয়ে দেশের প্রথম অ-কংগ্রেসি সরকার গঠন করেছিল জনতা পার্টি। নিজের কেন্দ্রটিও হারান ইন্দিরা। মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে গঠিত হয় নতুন সরকার।
এই পরিস্থিতির সঙ্গেই সকলে মিল পাচ্ছেন বর্তমানের। সেদিনের ক্ষমতা হারানো ইন্দিরার সঙ্গে আজকের সাংসদ পদ খারিজ হওয়া রাহুলকে নিশ্চিত ভাবেই একাসনে বসানো যায় না। ইন্দিরার সর্বময় কর্তৃত্বের ধারে কাছেও নেই রাহুল। চার বছর আগে নিজেই ছেড়েছেন দলের জাতীয় সভাপতিত্বের পদ। বারবার অনুরোধ করেও তাঁকে রাজি করানো যায়নি নতুন করে সভাপতি হতে। জাতীয় রাজনীতিতে ঘোর মোদি জমানায় রাহুল বিরাট কোনও ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেননি। তবে ভারত জোড়ো যাত্রায় তাঁর অংশগ্রহণকে অনেকেই রাহুলের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই হিসেবে দেখছিলেন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতেই তাঁকে পড়তে হল বিপাকে। যেখান থেকে তাঁর একটা উত্থান হতে পারত বলে অনেক কংগ্রেস সমর্থকেরই ধারণা। সেই আলোচনা থাক। কিন্তু ইন্দিরার সঙ্গে রাহুলের সাংসদ পদ খারিজের বিষয়টির সাযুজ্য আলোচনায় উঠে আসাটাও বোধহয় স্বাভাবিকই।
ইন্দিরা কিন্তু দুরন্ত প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছিলেন। সাতাত্তরের ভরাডুবির পরে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে তাঁকে জেলেও পুরতে চেয়েছিল জনতা সরকার। গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ইন্দিরা ও তাঁর ক্যাবিনেটের চার সদস্যকে। তাঁর এই গ্রেপ্তারি স্থায়ী হয়েছিল ১৬ ঘণ্টা। গ্রেপ্তারির পরদিনই ম্যাজিস্ট্রেট আদালত জানায়, ইন্দিরার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সাপেক্ষে কোনও প্রমাণই নেই।
আপাত ভাবে মনে হতে পারে ইন্দিরার গ্রেপ্তারি হয়তো তাঁর ভাবমূর্তির চূড়ান্ত ক্ষতি করে দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবটা ছিল একেবারেই উলটো। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইন্দিরাকে গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত জনতা পার্টির জন্য ‘বুমেরাং’ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৮০ সালে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে মসনদে প্রত্যাবর্তন করেন ‘লৌহমানবী’। আসলে নিজের গ্রেপ্তারির ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে জনতার সহানুভূতি আদায় করে হারানো অক্সিজেন ফিরে পাওয়ার রণকৌশলটি দারুণ ভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন ইন্দিরা। রাহুলের গ্রেপ্তার হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই মনে করা হচ্ছে। কিন্তু গ্রেপ্তার না হোন, সাংসদ বাতিলের সিদ্ধান্তকে কাজে লাগিয়ে তিনি কি পারবেন পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে? উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে। তবে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ঠাকুমার সঙ্গে তাঁর যতই ফারাক থাকুক, সমাপতনের নিরিখে ইতিহাস আচমকাই এক ব্র্যাকেটে বসিয়ে দিয়েছে তাঁদের।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.