লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে নানা কিসসা-কাহিনি পর্বে পর্বে সংবাদ প্রতিদিন ডট ইনে। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর ‘মৃত্যুরহস্য’ থেকে ইন্দিরা গান্ধীর ‘জেলযাত্রা’, জ্যোতি বসুর ‘ঐতিহাসিক ভুল’ থেকে মোদির ‘রাজধর্ম পালন’- ফিরে দেখা হারানো সময়। লিখছেন বিশ্বদীপ দে।
অন্ধকার রাত। থেকে থেকে বিদ্যুৎরেখায় ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে আকাশ। টানা বৃষ্টিতে নদীনালা পরিপূর্ণ। আপাতত থামলেও যখন তখন ফের শুরু হতে পারে বৃষ্টি। চারপাশ কাদায় থিকথিক করছে। এমন দুর্যোগের আবহে হেঁটে চলেছে একটি হাতি। আর সেই হাতির পিঠে যিনি বসে রয়েছেন তাঁকে কেবল আসমুদ্র হিমাচলই চেনে না, একডাকে চেনে বহির্বিশ্বও। তিনি ইন্দিরা গান্ধী। বছরখানেক আগেই যাঁর উদ্দেশে দেবকান্ত বড়ুয়া বলে উঠেছিলেন, ”ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা অ্যান্ড ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া।” কিন্তু সেই দিন যেন এখন কোন সুদূর অতীত। ভোটে হেরে মসনদ খুইয়ে তিনি আর ‘মাদার ইন্ডিয়া’ নন। বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা এক নেত্রী মাত্র। কিন্তু ১৯৭৭ সালের আগস্টে সেদিন রাতের অন্ধকারে কোথায় যাচ্ছিলেন ইন্দিরা?
আগেই পর্বেই আমরা আলোচনা করেছি ইন্দিরার (Indira Gandhi) গ্রেপ্তারি নিয়ে। যদিও সেই গ্রেপ্তারি স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ১৬ ঘণ্টা। তবু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইন্দিরাকে গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত জনতা পার্টির জন্য ‘বুমেরাং’ হয়ে গিয়েছিল। যাকে কাজে লাগিয়ে জনতার সহানুভূতি আদায় করে নিতে পেরেছিলেন ইন্দিরা। কিন্তু কেবল সেটাই ফ্যাক্টর ছিল না। নিজের ভেঙে পড়া ভাবমূর্তি নতুন করে গড়েছিলেন ‘লৌহমানবী’। আসলে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর কন্যা হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক কেরিয়ারে বাবাকে অনুসরণ করেননি তিনি। বরং নিজেই নিজের জন্য তৈরি করেছেন সরণি। একসময় ‘গুঙ্গি গুড়িয়া’ অর্থাৎ ‘নির্বাক পুতুল’ তকমা জুটলেও মাত্র কয়েক বছর পরই মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর দৃঢ় ভঙ্গিমা গোটা দেশের মন জয় করেছিল। আবার সেই তিনিই পরবর্তী কয়েক বছরে জনপ্রিয়তা হারিয়েছিলেন দ্রুত। সেই হারানো জনপ্রিয়তা ফিরে পাওয়ার লড়াই-ই শুরু হয়েছিল ১৯৭৭ সালের সেই ঘনঘোর বর্ষার রাতে। ‘ব্র্যান্ড ইন্দিরা’ ছিল প্রিয়দর্শিনীর সুচিন্তিত এক নির্মাণ। যাতে তিনি কখনও ব্যর্থ হয়েছেন। আবার সেই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পৌঁছেছেন সাফল্যের শিখরেও।
১৯৮০ সালে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ফের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ইন্দিরা। কিন্তু সেই প্রত্যাবর্তনের রূপরেখা চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল তিন বছর আগেই। ক্ষমতায় তখন সদ্য এসেছে জনতা দল। আচমকাই খবর এল জাতপাতের দ্বন্দ্বে রক্তাক্ত বিহারের (Bihar) বেলচি। বিহার শরিফ অঞ্চলের ওই গ্রামে দলিত মানুষদের হত্যা করছেন তথাকথিত উঁচু জাতির প্রতিনিধিরা! পুড়িয়ে মারা হয়েছিল ১১ জনকে! যাদের মধ্যে ছিল এক চোদ্দো বছরের ছেলেও। যে দগ্ধ অবস্থায় আগুন থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে, তাকে পিটিয়ে ফের ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল আগুনে! এমন নির্মম ঘটনায় শাসক দল বিশেষ ভ্রূক্ষেপ করেনি। আর এখানেই ইন্দিরার দূরদর্শিতা। তিনি যেন ‘গন্ধ’ পেলেন। এমনকী অন্য বিরোধীরাও যখন দ্বিধান্বিত, ইন্দিরা সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি যাবেন ওই এলাকায়। প্রথমে ট্রেন, পরে জিপ, আর তার পর… কাদায় ভরা জলাজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, হাতির পিঠে চেপে ইন্দিরার সেই যাত্রা আজও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। অথচ ওই এলাকায় ডাকাতের ভয়ও কম ছিল না। ঝুঁকি আছে জেনেও ইন্দিরা সেদিন পিছপা হননি। তাঁর মাথায় ছিল সামনেই বিহারের বিধানসভা নির্বাচন।
কিন্তু তাঁর সঙ্গীরা সতর্ক করেছিলেন। এমন প্রতিকূল রাস্তায় যাওয়াটা কি ঠিক হবে? কোনও কোনও জায়গায় নাকি এমনই কাদা, হাঁটু ছাড়িয়ে যাবে, এমনকী কোমরও! কিন্তু ইন্দিরা বললেন, ”আমরা হেঁটে যাব। যদি সারা রাতও লাগে, হেঁটেই চলব।” আশঙ্কা অচিরেই সত্যি হয়। বৃষ্টিস্নাত বিহারের সেই অজ পাড়া গাঁয়ে কাদায় আটকে গেল জিপ। সত্যি কাদা থেকে বাঁচতে শাড়ি ঈষৎ তুলে হাঁটতে শুরু করলেন ইন্দিরা! বাকিরা হতভম্ব। বাধ্যতই তাঁরা সঙ্গ দিচ্ছিলেন ৬০ বছরের নেত্রীকে। কিন্তু খানিক দূর যেতে না যেতেই পরিষ্কার হয়ে যায়, হেঁটে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। অতএব হাতি। কিন্তু প্রৌঢ়া ইন্দিরার পক্ষে হাতিতে করে যাওয়া সম্ভব হবে কি? সব সংশয় দূর করে খোদ নেত্রীই বলে উঠলেন,”এই প্রথম হাতিতে উঠছি নাকি? অনেক দিন পরে হাতির পিঠে চড়ব।” মোতি নামের এক হাতি সেদিন ইন্দিরাকে নিয়ে যায় গন্তব্যে। তাঁকে দেখে দলে দলে ছুটে এসেছিল সাধারণ মানুষ। দেখেছিল, তাদের সমস্যায় যেখানে অন্য কোনও দলের টিকিটাও দেখা যায়নি, সেখানে কদিন আগেও দেশের মসনদে বসে থাকা মানুষটা জলকাদা পেরিয়ে এসে উপস্থিত হয়েছেন তাদের মাঝে। ইন্দিরা সেদিন জানিয়ে দিয়েছিলেন, কোনও বক্তৃতা দিতে তিনি আসেননি। এসেছেন কেবল সমবেদনা জানাতে। বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, ”আমি তোমাদেরই লোক।” সাগরিকা ঘোষের ‘ইন্দিরা: ইন্ডিয়া’জ মোস্ট পাওয়ারফুল প্রাইম মিনিস্টার’ বইয়ে এ সম্পর্কে বিশদে বলা আছে।
সেদিন ইন্দিরার হাতির পিঠে চড়ে এগিয়ে যাওয়া যেন সত্যিই ছিল প্রতীকী। ওই প্রতিকূল পথে হাতির পিঠে বসে থাকতে থাকতে মাঝে মাঝেই যেন হারাচ্ছিল ব্যালান্স। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে ঠায় বসেছিলেন ইন্দিরা। ঠিক তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারের মতো। যতই প্রতিকূলতা আসুক, যতই ব্যালান্স হারানোর পরিস্থিতি হোক আমি ফিরে আসবই। জিপ থেকে নামার পর গন্তব্যে পৌঁছতে লেগেছিল তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। সেই দীর্ঘ যাত্রা ছিল ইন্দিরার দূরদর্শিতার এক অসামান্য নিদর্শন। অন্ধকার রাতে হাতে টর্চ নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল বহু মানুষ। ইন্দিরাকে চোখের সামনে দেখে যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না তাদের। সেই আঁধারে তৈরি হচ্ছিল ইন্দিরার ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ভাবমূর্তি।
আসলে ইন্দিরার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়কালকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। ১৯৬৬-৭১। ১৯৭২-৭৭। ১৯৮০-৮৪। একই মানুষ। কিন্তু যেন তিন প্রধানমন্ত্রী! ভোটে হারা ইন্দিরাকে গ্রেপ্তার করা হয় অক্টোবরে। কিন্তু তার আগে থেকেই প্রত্যাবর্তনের পালা শুরু হয়েছিল তাঁর। গ্রেপ্তারিকে কাজে লাগিয়ে দেশাই প্রশাসনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী চরণ সিংয়ের ‘ভুল চালে’র পরই কিস্তিমাত করে ফের দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। কিন্তু সেই পথ ছিল অসীম চ্যালেঞ্জের। ধীরে ধীরে হারানো জনসমর্থন ফিরে পেয়েছিলেন তিনি। সাড়ে চার দশক পেরিয়ে এসে সেদিনের সেই রাত এদেশের রাজনৈতিক কিংবদন্তি হয়ে থেকে গিয়েছে। আজও সেই দৃশ্য ফিরে ফিরে আসে এদেশের কুরসির কিসসার এক অধ্য়ায় হয়ে। অন্ধকার রাত, হাতির পিঠে দুর্গম অঞ্চল অবলীলায় পেরিয়ে যাচ্ছেন ৬০ বছরের ইন্দিরা গান্ধী, দুচোখে ঝিকঝিক করছে ফিরে আসার খিদে…
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.