বিশ্বদীপ দে: ”আই গ্যারান্টি ১০০ পার্সেন্ট ডিফিট।” সামনে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। বাকিরা সকলেই তাঁর সঙ্গে একমত। কিন্তু একজনই ভিন্নমত। আর রাখঢাক না করে সেকথা সটান বলেও দিলেন তিনি! যা দেখে বাকিরা বিস্মিত। ‘লৌহমানবী’র সামনে দাঁড়িয়ে এমন কথা বলতে পারার মতো লোক সেদিন গোটা ভারতে খুব বেশি ছিল না। কিন্তু তিনি, ফিল্ড মার্শাল স্যাম হরমুসজি ফ্রামজি জামশেদজি মানেকশ ছিলেন অন্যধাতে গড়া মানুষ। পদ কিংবা যশ নয়, দেশের সুরক্ষাই ছিল ‘স্যাম বাহাদুরে’র জীবনের বীজমন্ত্র। মৃত্যুর পাঁজরে লাথি মেরে ফিরে আসতে জানতেন। এই পজিটিভ মানসিকতাই সেদিন তাঁকে মনের কথা খুলে বলতে সাহায্য করেছিল।
এর ঠিক কয়েক মাস পরের কথা। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় তখন। ফের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎপ্রার্থী মানেকশ। অনুমতি মিলল। সোজা ইন্দিরার ঘরে ঢুকে পড়লেন তিনি। দরজা বন্ধ। মুখোমুখি দুজন। সেদিন নাকি স্যামের ঠোঁটে ছিল হাসির জলছাপ। বলেছিলেন, ”সুইটহার্ট, আই অ্যান রেডি।” শুনে ইন্দিরা তাঁকে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে ইঙ্গিত করেন। তাঁর আশঙ্কা ছিল, কোনও না কোনওভাবে এই ঘরে আড়ি পাতা হতে পারে। ইন্দিরা ইশারায় সাদা কাগজে আক্রমণের তারিখটি লিখতে বলেন স্যামকে। স্যাম লিখে দেন ৪ ডিসেম্বর। সঙ্গে সঙ্গে কাগজটি পুড়িয়ে ফেলেন ইন্দিরা। সত্যিই সেদিন মানেকশ প্রধানমন্ত্রীকে ‘সুইটহার্ট’ সম্বোধন করেছিলেন কিনা কিংবা ইন্দিরা সাদা কাগজে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর কথা লিখিয়ে সেটা পুড়িয়ে দিয়েছিলেন কিনা তা বলা কঠিন। এ এমন এক মিথ, যার সপক্ষে মজবুত প্রমাণ জোগাড় করাই কঠিন। কিন্তু ঘটনা যাই হোক, স্যাম-ইন্দিরার এই সাক্ষাৎ সত্যিই হয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে জেনারেল আশ্বস্ত করেছিলেন, আর হার নয়। ভারতীয় সেনা প্রস্তুত পাকিস্তানের সেনাকে উড়িয়ে দিতে। যার ফলস্বরূপ পরের মাসেই শুরু হয় যুদ্ধ। যার সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় পাক সেনা। জন্ম নেয় এক নতুন দেশ- বাংলাদেশ। কিন্তু এই কয়েক মাসে কী ম্যাজিক করেছিলেন মানেকশ। কোন পরিকল্পনায় ছকে ফেলেছিলেন ‘নিখুঁত’ যুদ্ধের নীল নকশা? কেনই বা জানিয়েছিলেন সেবছরের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ যুদ্ধ শুরু করলে হার নিশ্চিত?
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত সাড়ে দশটা নাগাদ একটি গোপন বৈঠক ডাকেন ইন্দিরা গান্ধী। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বাবু জগজীবন রাম-সহ ক্যাবিনেটের অনেকেই ছিলেন সেখানে। ইন্দিরা স্যামকে বলেন, শেখ মুজিবর রহমানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আগের রাতেই। যার জেরে পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করেছে। আর তা রুখতে খান সেনা আমজনতার দিকে এলোপাথাড়ি গুলি চালানো, ঘরবাড়ি লুটপাট থেকে ধর্ষণের মতো নানা ঘৃণ্য কাজ করে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে শরণার্থীরা আশ্রয় নিতে ভিড় জমাচ্ছে ভারতে। এই পরিস্থিতিতে কী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে পারে ভারত? স্যামের পরিষ্কার বক্তব্য ছিল, ”মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি আপনাকে অনুরোধ করেছিলাম এক বদমাশ বাহিনী গড়ার অনুমতি দিতে। আপনি তা দেননি।” যা শুনে ইন্দিরা বলেন, ”ধন্যবাদ জেনারেল। শুভ রাত্রি।” কয়েকদিন পরে ফের বৈঠক। আর সেই বৈঠকেই স্যাম জানিয়ে দেন, এখনই যুদ্ধ করলে ভারত জিততে পারবে না। কেননা তাঁর সেনা এই মুহূর্তে প্রস্তুত নয়।
ইন্দিরার সঙ্গীরা কেউই মানেকশর এমন জবাবে সন্তুষ্ট হননি। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর আস্থা ছিল মানুষটির উপরে। বৈঠক শেষে সকলকে চলে যেতে বলেন ইন্দিরা। কেবল থেকে যেতে বলেন মানেকশকে। আর সেই একান্ত বৈঠকেই স্যাম ব্যাখ্যা করেন, কেন তিনি সময় চাইছেন। প্রথমত, লোকসভা নির্বাচন শেষ হয়েছে কদিন আগেই। ১০ মার্চ শেষ হয়েছিল নির্বাচন। ফলে নির্বাচনের ডিউটি করতে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা সেনা জওয়ানদের দ্রুত একজায়গায় আনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা বেশ কঠিন। তাঁকে একত্রিত করা, মনঃসংযোগ করে সঠিক কৌশল ছকতে সময় লাগবে। তাছাড়া বর্ষা আসতে খুব বেশি সময় নেই। যুদ্ধ কতদিন চলবে আগাম আঁচ করা কঠিন। পূর্ব পাকিস্তানে একবার বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে নদী হয়ে যাবে সমুদ্র। দফারফা হবে সেনার ট্যাঙ্ক ও আগ্নেয়াস্ত্রের। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধে জেতা অসম্ভব। অন্যদিকে ওত পেতে বসে আছে চিন। চাম্বি উপত্যকার মধ্যে দিয়ে উত্তরবঙ্গে ঢুকে পড়ার ফন্দি আঁটতে পারে তারা। ফলে পাকিস্তানকে দুটুকরো করার বদলে ভারতই দ্বিখণ্ডিত হয়ে যেতে পারে নতুন করে। অথচ সেনার হাতে সেই মুহূর্তে রয়েছে মাত্র ৩০টি ট্যাঙ্ক। তাই আরও অস্ত্রশস্ত্রও প্রয়োজন। একথা বলার পরই স্যাম বলেন, ”মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি কি এমন পাগলের মতো দাবি করার জন্য ইস্তফা দেব?” শোনা যায়, তিনি নাকি পকেটে ইস্তফাপত্র নিয়েই সেদিন প্রবেশ করেছিলেন ইন্দিরার ঘরে।
ইন্দিরা স্যামের কথা শুনে হেসে ফেলেন। এবং সেই সঙ্গেই জানিয়ে দেন, তিনি নিজের মতো করে প্রস্তুতি শুরু করে দিন। স্যাম জানিয়ে দেন, নভেম্বরের মধ্যেই তিনি সব কিছু প্রস্তুত করে ফেলবেন। ততদিনে বৃষ্টিও থেমে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নদীগুলিও শুকিয়ে যাবে। পাশাপাশি পাহাড়ে বরফ পড়া শুরু হলে চিনারাও আক্রমণ করতে পারবে না সেই পথে।
পরবর্তী কয়েক মাসে স্যাম যা যা চেয়েছিলেন, সবই তাঁকে দেন ইন্দিরা গান্ধী। সেনাবাহিনীর সর্বস্তরে যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন স্যাম। পাশাপাশি ভারতীয় গোয়েন্দাদের থেকে পাকিস্তানের শক্তি, দুর্বলতা ও পরিকল্পনার পুঙ্খানুপুঙ্খ খোঁজখবর রাখতেন। পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের গেরিলা বাহিনী অর্থাৎ মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং তাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করে প্রস্তুত করে তুলেছিলেন স্যাম। অর্থাৎ যুদ্ধের সমস্ত দিক একেবারে ছকে নিয়ে প্রস্তুতির শিখরে পৌঁছে যাওয়া- এটাই ছিল স্যামের আসল পরিকল্পনা আর তাতে তিনি একশো শতাংশ সফল।
তবে মুক্তিযুদ্ধের এই প্রস্তুতি পর্বে ইন্দিরার অবদানও ভুললে চলবে না। একদিকে আরব বিশ্বের সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর জন্য পারিবারিক বন্ধু ও কূটনীতিক মহম্মদ ইউনুসকে পাঠানো, অন্যদিকে সেই সময়ে পাকিস্তানের ‘বন্ধু’ হয়ে থাকা আমেরিকার সঙ্গেও কথা বজায় রাখা। এবং এটা নিশ্চিত করা যে কোনওভাবেই যেন পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে গেলে ভারতের উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপানো না হয়। তবে ইন্দিরার সেরা কূটনৈতিক চাল ছিল মস্কো সফর। রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) দীর্ঘদিন ধরেই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে রেখেছিল। ইন্দিরা এতদিন সেই চুক্তিতে সই করেননি। কিন্তু সেবছরের আগস্টেই স্বাক্ষর করে দেন তাতে। আর সঙ্গে সঙ্গেই সোভিয়েত নেতা লিওনিড ব্রেজনভ রাষ্ট্রসংঘে ভারত বিরোধী প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া শুরু করেন।
যুদ্ধ শুরু হলে প্রমাণিত হয়ে যায়, ইন্দিরার মানেকশর প্রতি বিশ্বাস রাখা ভুল ছিল না। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয় দেশকে উপহার দিয়েছিলেন ‘স্যাম বাহাদুর’। সেই মাসের ১৬ তারিখ আত্মসমর্পণ করেন ৯৩ হাজার খান সেনা। আজকের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস এভাবে মুছে ফেলা যায় না। তা থেকে যায় হাওয়ায় হাওয়ায়। সেই কিংবদন্তিকে মুছে ফেলা অসম্ভব।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.