দীপঙ্কর মণ্ডল, মির্জাপুর: ওয়েব সিরিজ দেখে ফের গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল৷ ভেবেছিলাম, গ্যাংওয়ারের কবলে গিয়ে না পড়ি। তা দেখলে যে চোখ সার্থক হত, এমনটাও বলছি না। তবে খুন হওয়া দস্যুরানি ফুলনদেবীর স্মৃতি কিছুটা সেই আশ মেটাল। নাই দেখা হোক লাইভ গ্যাংওয়ার, ফুলন– আগুনের ফুলকি যে এখনও মির্জাপুরে।
লোকসভা ভোটের শেষ দফার অন্তিম প্রচার। এখানে এখনও দিব্যি শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছেন সাংসদ ফুলন। মির্জাপুর তাঁকে দু’বার দিল্লি পাঠিয়েছে। চম্বলের ডাকাত সর্দারিনী নয়, কার্পেট নগরী ফুলনকে মনে রেখেছে ‘গরিবোঁ কি মসিহা’ হিসাবে।বারাণসী থেকে শাস্ত্রী সেতু পেরলে মৃত প্রাক্তন সাংসদের এলাকা শুরু। এক কিশোরীর গণধর্ষিত হওয়া এবং প্রতিশোধ নেওয়ার কাহিনি কান পাতলেই শোনা যায়। স্বামীর অত্যাচার থেকে বাঁচতে ফিরে আসা, পুলিশের বিছানা গরম করা, পরে ডাকাত দলে গিয়েও লালসার শিকার হওয়া। নিয়তির অভিশাপ এখানেই শেষ নয়। বিকৃত একদল পুরুষ তাঁর শরীরকে ছিঁড়ে খেয়েছিল। ঠাকুর সম্প্রদায়ের জমিদাররা টানা প্রায় একমাস বন্দি রেখে ধর্ষণ করেছিল মেয়েটিকে। তারপরও বেঁচে ছিল মেয়েটি। গড়ে নিজের ডাকাত দল। প্রতিশোধ নিতে ২২ জনকে খুনের অভিযোগ রয়েছে ফুলনের বিরুদ্ধে। বেহমাই হত্যাকাণ্ডের সেই ঘটনা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। যার জেরে তখনকার মুখ্যমন্ত্রী ভি পি সিংকে পদত্যাগও করতে হয়।
পুলিশকে এক সময় নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাত ফুলনের দল। চম্বলের ত্রাস কুখ্যাত ফুলন পরে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। শেখর কাপুর পরিচালিত হিন্দি ছবি ‘ব্যান্ডিট কুইন’ দেখলে তাঁর কাটাছেঁড়া জীবনের লড়াই প্রবলভাবে টের পাওয়া যায়। মির্জাপুরও দেখেছে সেসব। মনেও রেখেছে তাদের প্রাক্তন সাংসদকে। মুকেরি বাজার, সাকেতপুরি কলোনির আড্ডায় এখনও সেই ফুলন। সনু দেবী নামে বছর চল্লিশের এক মহিলা বললেন, “অন্যায়ের প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের জন্য এই মনে রাখা।”
১১ বছর জেলে থাকার পর গরিব এবং নিরক্ষর সেই ফুলনের উপর থেকে সব মামলা প্রত্যাহার করেছিলেন সমাজবাদী দলের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং। মুলায়ম পুত্র অখিলেশ এখন দলের সর্বেসর্বা। চলতি লোকসভায় তিনি হাত মিলিয়েছেন মায়াবতীর সঙ্গে। মির্জাপুরে এবারের জোট প্রার্থী রামচরিত্র নিষাদ। ভোট প্রচারে মহল্লায় মহল্লায় ঘোরার সময় যেখানেই বাবাসাহেব আম্বেদকরের মূর্তি দেখেছেন সেখানেই পুষ্পার্ঘ অর্পণ করেছেন এই দলিত প্রার্থী।
বিজেপি টিকিট না দেওয়ায় নিষাদ ভোটব্যাংকের একটি অংশ নিয়ে অখিলেশের দলে এসেছেন তিনি। মায়াবতীও তাঁর হয়ে জবরদস্ত প্রচার করেছেন এই ক্ষেত্রে। তবে মির্জাপুরে কংগ্রেস এবার ধারেভারে এগিয়ে। উত্তরপ্রদেশ কংগ্রেসের দায়িত্ব পেয়েই তেড়েফুড়ে প্রচার করেছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মেয়েকে দেখতে এবং তাঁর কথা শুনতে ঢলও নেমেছে মানুষের। এই লোকসভায় এবার কংগ্রেসের প্রার্থী ললিতেশ ত্রিপাঠী। সুদর্শন এই যুবকের মুখে সর্বদা হাসি। রাহুল-প্রিয়াঙ্কা ম্যাজিক ছাড়া তাঁর আর তেমন অস্ত্র নেই। ২৩ তারিখ জানা যাবে এই সংসদীয় এলাকার মানুষ ভিড় জমানোর পাশাপাশি ইভিএমে আঙুলের চাপ দেওয়ার সময় প্রিয়াঙ্কাকে মনে রেখেছেন কি না।
মির্জাপুর জেলাটি বেশ বিস্তৃত। গঙ্গার পূর্ব পাড় থেকে শুরু করে বিন্ধ্য পাহাড় এলাকা পর্যন্ত এর সীমা। লালগঞ্জ, হালিয়া, নদনা, পাহাড়ি, জামালপুর প্রভৃতি গ্রামীণ এলাকায় প্রবলভাবে উচ্চারিত হত ফুলনের নাম। আজও তাঁর কথা উঠলে মনখারাপ হয় মির্জাপুরের। দস্যু সত্তাকে মেনে নিয়েই ফুলনের ‘মসিহা’ ইমেজকে মনে রেখেছেন সবাই। এখানে কার্পেট ছাড়াও কাঁসা-পিতলের বাসন প্রচুর তৈরি হয়। বাংলা-বিহার থেকে আসা অনেকে কাজ করেন। মির্জাপুরে বিজেপির প্রার্থী নেই। আপনা দলের অনুপ্রিয়া সিং প্যাটেল এনডিএ জোটের প্রার্থী। তিনি গতবারের বিজয়ী সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। দিল্লির লেডি শ্রীরাম কলেজে স্নাতক পাস করে কানপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন। ৩৭ বছরের অনুপ্রিয়াকে জেতাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ থেকে শুরু করে বিজেপির শীর্ষ নেতারা ঝাঁপিয়েছেন। তবু গরিব মহল্লাগুলি ফুলনকেই মিস করে। শিক্ষিত শহুরে যুব সম্প্রদায়ের ক্ষোভ– পাশের বারাণসীর জন্য এত বরাদ্দ, কিন্তু মির্জাপুর বঞ্চিত। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় নেই। বেকারত্বের জ্বালায় ভিনরাজ্যে চলে যাচ্ছে অনেকে। শাস্ত্রী সেতুর ফুটপাথে বসা এক ফকির বলেন, “না পাওয়ার যন্ত্রণাই ভুলতে দেয় না ডাকাত রানিকে।”শেষ মুহূর্তের প্রচারে মোদির ‘তুরুপের তাস’ অনুপ্রিয়া সুরেলা কণ্ঠে গজল ধরেন: “হোঁশওয়ালো কো খবর ক্যায়া, বেখুদি ক্যায়া চিজ হ্যায়। ইশক কিজিয়ে ফির সমঝিয়ে, জিন্দেগি ক্যায়া চিজ হ্যায়।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.