বিশ্বদীপ দে: হিন্দুত্ববাদ (Hindutva)। গত কয়েক বছরে ভারতের রাজনৈতিক আঙিনায় ক্রমশই শক্তি বাড়িয়েছে এই শব্দ। যদিও সকলেরই জানা, বীর সাভারকর গত শতকের দুইয়ের দশকে শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। তারও বহু আগে সেই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে শব্দটি ব্যবহৃত হলেও সাভারকরের সময় থেকেই তা অন্যতর এক মাত্রার জন্ম দিয়েছিল। এতগুলি দশক পেরিয়ে এসে আধুনিক ভারতে সেই হিন্দুত্ববাদ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর আধিপত্য বিস্তারকারী শব্দ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তা বলে ধর্ম ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে এক সুতোয় বাঁধতে গিয়ে কেবল ভারতের নামই যদি চায়ের কাপে ঝড় তোলে, তাহলে সেই আড্ডা অসমাপ্ত থেকে যাবে।
ধর্ম (Religion) আর রাজনীতি (Politics)। আপাত ভাবে মনে হতেই পারে পরস্পরবিরোধী দু’টি শব্দ। কিন্তু একথা অস্বীকারের জায়গা নেই, ক্ষমতা কাঠামো নির্মাণে পৃথিবীর বহু দেশেই রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। হতে পারে কোথাও তা একটু কম। কোথাও আবার তা খুব স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ। একথাও অস্বীকার করার জায়গা নেই যে, ধর্ম বা জাতিগত বিদ্বেষকে কাজে লাগানো হয়েছে বহুবার। ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে বা নিছক আড্ডার পরিসরেও এপ্রসঙ্গ উঠলে সেই মাছিগোঁফ মানুষটিকে মনে পড়ে যাবে। যাবেই। ১৯৩৩ থেকে ‘৪৫। এই বারো বছরে অ্যাডলফ হিটলারের (Adolf Hitler) নাৎসি বাহিনীর সম্মিলিত অত্যাচারে ইহুদিদের করুণ মৃত্যুমিছিল আজও যে কোনও শান্তিকামী মানুষকে বিষণ্ণতার অতলতায় ডুবিয়ে দিতে পারে। কেবল জার্মানিতেই নয়, প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল অন্যান্য দেশের নানা দলের মধ্যে। ফ্রান্সের ‘কাগোলার্ডস’, হাঙ্গেরির ‘অ্যারো ক্রস’, ইংল্যান্ডের ‘ব্রিটিশ ইউনিয়ন অফ ফ্যাসিস্টস’ কিংবা আমেরিকার ‘সিলভার শার্টস’ ইত্যাদিদের কথাও এপ্রসঙ্গে বলা যায়। এরা সবাই ইহুদি-বিদ্বেষ তথা অ্যান্টি-সেমিটিজমের পক্ষে সওয়াল করে গিয়েছে।
কিন্তু জার্মানিতে সম্মিলিত ভাবে যে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন তৈরি হয়েছিল তেমনটা আর কোথাও হয়নি। হওয়া সম্ভব ছিলও না হয়তো। কেননা জার্মানি তো কেবল ইহুদিদের মানবসভ্যতার ‘রেসে’ পিছিয়ে পড়া শ্রেণি হিসেবে গণ্য করেই ক্ষান্ত হয়নি। তাদের কাছে ইহুদিরা তো এমন এক ‘ক্যানসার’, যা জার্মানিকেই ধ্বংস করে ফেলবে। অতএব পুরুষ, মহিলা, শিশু নির্বিশেষে ইহুদিদের মারো। এবং এটাকে একেবার সরকারি নীতি হিসেবেই ঘোষণা করা হয়েছিল! স্কুলের পাঠ্যবই হোক কিংবা বিজ্ঞানের জার্নাল, সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এই ‘থিয়োরি’। জার্মানির আমজনতা দিব্যি গিলে নিয়েছিল হিটলারের এই সব আজগুবি মারণ মন্ত্রকে। কীভাবে সেই বিদ্বেষের থিয়োরি হিটলারকে রাতারাতি জার্মানির অধীশ্বর করে তুলেছিল তা আর কার অজানা।
জাম্প কাট টু ২০২০। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানের (Pakistan) করাচি ও পাঞ্জাব প্রদেশের শহুরে অঞ্চলে আচমকা শিয়া ও সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়ে যায়। যদিও পাক মিডিয়া একে নেহাতই ‘ভারতের ষড়যন্ত্র’ বলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে। কিন্তু বহু অঞ্চলেই শিয়াদের উপরে সুন্নি চরমপন্থী সংগঠনের আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার খবর সাধারণ জনতার অগোচরে থাকা সম্ভব ছিল না। আর তা চায়ওনি প্রশাসন! আসলে শিয়া-সুন্নি সংঘর্ষ খুব নতুন কিছু নয়। তবে আচমকাই ওই সময়ে তা শিরোনামে উঠে আসার পিছনে কিন্তু অন্য কারণ ছিল। পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল সেলিম বাজোয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল সেই সময়। তিনি পদত্যাগও করেন দ্রুত। এবিষয়ে জনমানসে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হতে দেওয়ার সহজ উপায় লোকের নজর ঘুরিয়ে দেওয়া। ওয়াকিবহাল মহলের একাংশের প্রশ্ন, সেই কারণেই সুকৌশলে ওই সংঘাত তৈরি করা হল না তো? আসলে বিদ্বেষ খুব সহজে ছড়ায়। আর তার কণ্টকময় উপস্থিতি অন্য বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর থেকে মানুষের নজরকে সরিয়ে দিতে পারে। এমনিতে পাকিস্তানে, বিশেষ করে সেদেশের পাঞ্জাব প্রদেশে বরাবরই দেওবান্দি (শিয়া-বিদ্বেষী এক গোষ্ঠী) ভোটারদের সংখ্যা যথেষ্ট বেশি। প্রতিটি নির্বাচনী কেন্দ্রেই ২০ হাজারেরও বেশি দেওবান্দি ভোটার রয়েছে। আর স্বাভাবিক ভাবেই তারা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে সেখানকার রাজনীতিতে।
একটা লেখায় উদাহরণের সংখ্যা সীমিত হতে বাধ্য। তবু ‘ঘরের পাশে আরশিনগর’ বাংলাদেশকে (Bangladesh) বাদ রাখা যায় না। ১৯৭১ সালে তাদের স্বাধীনতার অন্যতম ভিত্তি ছিল ধর্মনিরেপক্ষতা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের হত্যার পর থেকে বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে ইসলামপন্থীদের শক্তি ক্রমশ বেড়েছে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রৌনক জাহান এই সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানিয়েছেন, ”বাংলাদেশের বড় দুটো দলই এখন বিশ্বাস করে, ইসলামপন্থীদের সাথে সম্পৃক্ততায় ভোটের রাজনীতিতে বাড়তি সুবিধার সাথে সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতাও বাড়বে।” উদাহরণ হিসেবে তিনি তুলে ধরেছেন সেদেশের সবচেয়ে বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামি লিগ ও বিএনপির কথা। বলা যেতে পারে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ‘জামাত-এ-ইসলামি’র কথা। সেই অর্থে ভোটবাক্সে বড়সড় প্রভাব ফেলতে না পারলেও সরকারের উপরে তাদের প্রভাব অনস্বীকার্য। ১৯৭৫ সালের আগে তারা ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু এরপর ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে তারা ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। এদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বৃহত্তর জাতীয় মঞ্চ হয়ে ওঠা আওয়ামি লিগের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে পথ বদলানোর। সেদেশের সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের ‘রক্ষাকর্তা’ ইমেজ তাদের সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও বিরোধীদের অভিযোগ, নিজেদের আদর্শগত অবস্থান বদলে ইসলামকে তারাও ব্যবহার করেছে রাজনীতিতে।
ইতিহাস ও বর্তমান এভাবেই মিলেমিশে ধর্ম ও রাজনীতির এই সহাবস্থানকে স্পষ্ট করে তুলেছে। প্রায় এক দশক আগের একটা বাংলা ছবির কথা মনে পড়ছে। অঞ্জন দত্তের ‘ম্যাডলি বাঙালি’। সেখানে বাজি নামের একটি ছেলে যখন মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত, তখন তাকে অঞ্জন দত্ত অভিনীত চরিত্রটি বুঝিয়েছিল, ”তুমি রাজনীতির কথা বলছ বাজি। ধর্মের কথা নয়।” এই সংলাপ থেকে পরিষ্কার, রাজনীতির ফাঁসে ধর্মের আটকে পড়াকে বুঝতে পারেনি সংখ্যালঘু ওই কিশোর। হয়তো এটাই বহুক্ষেত্রে লক্ষ্য থাকে শাসনযন্ত্রের। যাতে তারা এই সংশয়কে কাজে লাগাতে পারে। কবীর সুমন তাঁর গানে এক অমোঘ প্রশ্ন তুলেছিলেন, ”কবে ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু?” সেদিনটা কবে আসবে তা আমরা জানি না। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনেরা যে মানুষকে এমনটা বুঝতে দিতে চান না, তা বলাই যায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.