সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: তিনবছর আগে যখন জম্মু-কাশ্মীরে জোট করে সরকার গঠন করেছিল বিজেপি ও পিডিপি, তখনই অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন। প্রশ্ন তুলেছিলেন, আদৌ কি টিকবে এই জোট? তাঁদের যুক্তি ছিল, এই জোট একপ্রকার উত্তরমেরু ও দক্ষিণমেরু একসঙ্গে আসা৷ তাঁদের আশঙ্কাই সত্যি হল, সাড়ে তিনবছর একসঙ্গে ঘর করার পর গতকালই পিডিপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে বিজেপি৷ সরকারের সাহায্য পাওয়া সত্ত্বেও জম্মু-কাশ্মীরে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ, মেহবুবা মুফতি সরকারের উপর কার্যত সব দায় চাপিয়ে সরে এল কেন্দ্রের শাসনে থাকা বিজেপি৷ প্রশ্ন উঠেছে, জোটসঙ্গী হিসাবে তাঁরা কেমন করে দায় এড়াতে পারেন? ইতিমধ্যে, সেখানে জারি হয়েছে রাজ্যপালের শাসন৷ উত্তপ্ত উপত্যকায় জোর কদমে জঙ্গি নিকেশের কাজ শুরু করেছে সেনা৷ বিতর্ক তৈরি হয়েছে, বিজেপির জোট ভাঙার কারণ নিয়ে৷ কারও যুক্তি মানুষের স্বার্থে জোট ভেঙেছে বিজেপি৷ উপত্যকায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সন্ত্রাসবাদকে মেটানো প্রয়োজন। অন্যদিকে বিরোধীদের যুক্তি, কাশ্মীর ইস্যুতে ডাহা ফেল করেছে মোদি সরকার। ফলে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখে কাশ্মীর ট্রাম্পকার্ডকে ব্যবহার করতে চাইছে কেন্দ্র। পাশাপাশি তৈরি হয়েছে আরও বেশকিছু যুক্তি৷
১) পিডিপি-র কাশ্মীর ভিত্তিক রাজনীতি: ২০১৪-র শেষের দিকে জম্মু-কাশ্মীরে বিধানসভা ভোট হয়েছিল৷ ২৮ আসন নিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়েছিল পিডিপি৷ ২৫ আসন পেয়ে তারপরেই ছিল বিজেপি৷ ২০১৫-তে সেখানে সেখানে জোট সরকার গড়ে পিডিপি ও বিজেপি৷ তবে প্রথম থেকেই পিডিপির রাজনৈতিক শক্তি কেন্দ্রীভূত হয়েছে কাশ্মীর উপত্যকায়৷ সেখানে বিজেপির শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে জম্মু অঞ্চলে৷ বিজেপি-র নেতাদের মধ্যে থেকে বরাবরই একটা অভিযোগ উঠে এসেছে, জম্মু অঞ্চলের উন্নয়নে কম নজর দিচ্ছে পিডিপি সরকার৷ ভোট ব্যাংকের স্বার্থে কাশ্মীর উপত্যকাকেই সর্বদা তুষ্ট করেছে মেহবুবা মুফতির সরকার৷ তুলনায় অনেকটা অবহেলা করা হয়েছে জম্মুকে৷
[২০২২-র মধ্যে দ্বিগুণ হবে কৃষকদের আয়, আশ্বাস মোদির]
২) কাঠুয়া গণধর্ষণ কাণ্ড: কাঠুয়া গণধর্ষণ কাণ্ডের ফলে সমগ্র দেশে তৈরি হয়েছে প্রবল সরকার বিরোধী মনোভাব৷ সর্বমহল থেকে দাবি উঠে এসেছে, নারীদের নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ মোদি সরকার৷ যাতে আরও ঘৃতাহুতি পড়ে যখন দোষীদের সমর্থনে মিছিল বেরতে দেখা গিয়েছে উপত্যকায়৷ সূত্রের খবর, সেই সময় স্থানীয় ও রাজ্যস্তরের অনেক বিজেপি নেতাই চেষ্টা করেছেন ঘটনাটির তদন্ত কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআই-কে দিয়ে করানোর৷ তবে তাদের দাবিতে কার্যত কর্ণপাত করেননি মেহবুবা মুফতি৷ জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ দিয়েই ঘটনার তদন্ত করান তিনি৷ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনা বিজেপি-পিডিপি জোটের ফাটলকে অনেকটাই চওড়া করেছে৷
৩) মুখ্যমন্ত্রীর একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাঙন এখন হলেও, শুরুটা হয়েছিল অনেকদিন আগেই৷ দীর্ঘদিন ধরেই পিডিপির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হচ্ছিল রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের৷ তাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলে একাধিকবার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে সরব হয়েছেন রাজ্য বিজেপি নেতারা৷ সরকারি প্রকল্প ঘোষণা থেকে কেন্দ্রীয় অনুদান ব্যবহার কোনও বিষয়েই বিজেপির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন না মেহবুবা মুফতি৷ বিজেপি জনপ্রতিনিধিদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্ধকারে রেখেই প্রকল্পের ঘোষণা করা হয়৷ এই অভিযোগেই বেশিরভাগ সময় দিল্লির দ্বারস্থ হতে দেখা গিয়েছে জম্মু-কাশ্মীরের বিজেপি নেতাদের৷
৪) জঙ্গিবাদের বাড়বাড়ন্ত: কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ বন্ধে এবং যুব সমাজের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব তৈরি হওয়া স্তব্ধ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ মুফতি সরকার৷ দিনদিন কাশ্মীরের অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে, বাড়ছে মৌলবাদ৷ মঙ্গলবার জোট ভাঙার সময় পিডিপি সরকারের বিরুদ্ধে এমনই গুরুতর অভিযোগ করেছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব৷ রমজান মাসে কাশ্মীরে শর্তসাপেক্ষে জঙ্গিদমন অভিযান বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্র৷ সাম্প্রতিক গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, এই একমাসে উপত্যকায় একশো শতাংশ বেড়ে গিয়েছে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ৷ নৃশংসভাবে মৃত্যু হয়েছে এক জওয়ান ও এক সাংবাদিকের৷ এরপরেই কাশ্মীরে জঙ্গিদমন অভিযান পুনরায় শুরুর নির্দেশ দেয় কেন্দ্র৷ কিন্তু তা একদমই মেনে নিতে পারেননি মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি৷ কেন্দ্রের কাছে দাবি করেন আরও কয়েকদিন বহাল থাকুল আগের নির্দেশ৷ বন্ধ থাকুক জঙ্গি দমন অভিযান৷ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তখনই কার্যত চূড়ান্ত হয়ে যায় জোটের ভাঙন৷ কেবল অপেক্ষা ছিল সময়ের৷
[শহিদ ঔরঙ্গজেবের বাড়িতে নির্মলা, সুবিচারের আশ্বাস প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর]
৫) ২০১৯-এর লোকসভা ভোট: ২০১৪-র লোকসভার রাজনৈতিক ইস্তাহারে অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল কাশ্মীর সমস্যা সমাধান৷ তবে গত চারবছরে ক্রমাগত খারাপের দিকে গিয়েছে উপত্যকার অবস্থা৷ বছরের বেশির ভাগ সময় উত্তপ্ত থেকেছে নিয়ন্ত্রণরেখা ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেয়েছে উপত্যকার অন্দরে৷ বেড়ে গিয়েছে জঙ্গি হানাও৷ বিরোধীরা এখন থেকেই সুর চড়াতে শুরু করেছেন, কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ মোদি সরকার৷ এক্ষেত্রে বরাবরই মুফতি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি নরম মনোভাব পোষণ করার৷ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে চাইলেও কথাবার্তার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পক্ষপাতী পিডিপি৷ সেক্ষেত্রে আগামী বছরেই আবার লোকসভা নির্বাচন হতে চলেছে৷ এমত অবস্থায় মোদি সরকারের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িছে কাশ্মীর সমস্যার মোকাবিলা করা৷ আর এই চ্যালেঞ্জই জোটের ভাঙনকে আরও তরান্বিত করেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ তাঁদের সহযোজন, রাজ্যপাল শাসন কায়েম হওয়ার পর জঙ্গিদমন অভিযান আরও সহজতর হল সেনার পক্ষে৷ থাকল না কোনও পায়ের বেড়ি৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.