লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে নানা কিসসা-কাহিনি পর্বে পর্বে সংবাদ প্রতিদিন ডট ইনে। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর ‘মৃত্যুরহস্য’ থেকে ইন্দিরা গান্ধীর ‘জেলযাত্রা’, জ্যোতি বসুর ‘ঐতিহাসিক ভুল’ থেকে মোদির ‘রাজধর্ম পালন’- ফিরে দেখা হারানো সময়। লিখছেন বিশ্বদীপ দে।
‘কুরসির কিসসা’র এটাই শেষ পর্ব। এই পর্বে আমরা ফিরে যাব দেশের স্বাধীনতার একেবারে গোড়ায়। ১৯৫১ সালে দেশে প্রথমবার নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু তার আগে দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় কোনও নির্বাচন ছাড়াই স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেওয়া হয় জওহরলাল নেহরুকে। ১৯৪৬ সালে কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে তাঁর নির্বাচনেই পরিষ্কার হয়ে যায়, দেশ স্বাধীন হলে নেহরুই হবেন প্রধানমন্ত্রী। আর সেই সিদ্ধান্তের পিছনে ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। কিন্তু কংগ্রেসের অধিকাংশ প্রদেশ কমিটির সমর্থন ছিল ছিল সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের দিকে। কিন্তু এর পরও গান্ধী নেহরুকেই বেছে নেন?
একথা সকলেরই জানা নেহরুর প্রতি গান্ধীর ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। ১৯২৯ সালে চল্লিশ বছরের জওহরকে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে বেছে নেওয়ার সময় ‘জাতির জনক’ বলেছিলেন, ”আমার আর জওহরলালের মধ্যে সম্পর্কে কথা যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন ওর চেয়ারে বসা আর আমার চেয়ারে বসা একই ব্যাপার। আমাদের মধ্যে হয়তো চিন্তাচেতনার পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু হৃদয় এক…”
পরবর্তী দেড় দশকেরও বেশি সময়ে নেহরু (Jawaharlal Nehru) ও গান্ধীর (Mahatma Gandhi) ‘হৃদয়ে’ ভিন্নতা এসেছে, এমন কথা কেউ বলতে পারবেন না। বরং তাঁদের সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। ১৯৩৬ সালেও নেহরুকে কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন গান্ধী। ফলে ১৯৪৬ সালেও নেহরুর নির্বাচন আপাত ভাবে কোনও চমক নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আগের দুবারের চেয়ে এবারের নির্বাচন ছিল আরও গুরুত্বপূর্ণ। দেশ তখনও ব্রিটিশদের হাতে। কিন্তু পরিস্থিতি এটা বুঝিয়ে দিয়েছিল স্বাধীনতা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। ফলে যাঁকে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচন করা হবে, তিনিই যে অদূর ভবিষ্যতে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হবেন তা ছিল দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। তাই নেহরুর পাশাপাশি বল্লভভাই প্যাটেলের (Vallabhbhai Patel) কথাও নিশ্চিত ভাবে মহাত্মা গান্ধীর মাথাতেই ছিল। এদিকে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা পনেরোটি রাজ্য/ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির মধ্যে বারোটি কমিটিই নেহরু নয়, ‘লৌহমানব’কেই বেছে নিয়েছিলেন। বাকি তিনটি কমিটি কাউকেই বাছতে পারেনি। অর্থাৎ কমিটিগুলোর কেউই নেহরুর পক্ষে ভোট দেয়নি। এর পরও নেহরুকে বেছে নেওয়ার কারণ কী ছিল?
এই সঙ্গে আরও একজনের কথা বলা দরকার। তিনি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। ৬ বছর আগে তাঁকেই কংগ্রেস সভাপতি করা হয়েছিল। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কায় এর পর আর নির্বাচন হয়নি। কেননা অধিকাংশ নেতাই ছিলেন গরাদের ওপারে। এর পর ১৯৪৬ সালে যখন ফের সভাপতি নির্বাচনের পালা আসে, তখনও আজাদ আশাবাদী হয়ে ওঠেন পুনর্নির্বাচিত হওয়া নিয়ে। শোনা যায়, তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। কিন্তু গান্ধী জানিয়ে দেন, পর পর দুবারের জন্য কাউকে কংগ্রেস সভাপতি করা হবে না। আর তখনই গান্ধী পরিষ্কার করে দেন অন্য কেউ নয়, নেহরুকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে সভাপতি হওয়ার বিষয়ে। সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় আজাদের সম্ভাবনা। কিন্তু আলোচনায় টিকেছিলেন বল্লভভাই প্যাটেল।
১৯৪৬ সালের ২৯ এপ্রিলের মধ্যে সভাপতি হিসেবে মনোনয়ন জমা দিতে বলা হয় প্রদেশ কমিটিগুলোকে। তারা কাকে মনোনীত করেছিল সেটা আগেই বলা হয়েছে। পনেরোটি কমিটির মধ্যে বারোটি বেছে নেয় বল্লভভাইকে। অন্য তিনটি কমিটি কাউকে না বাছায় সংখ্যাগরিষ্ঠ কেবল নয়, একমাত্র মনোনীত প্রার্থী হিসেবে থেকে যান প্যাটেলই। ফলে গান্ধীর পক্ষে নেহরুকে বেছে নেওয়াটা নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জের হয়ে ওঠে। তিনি আচার্য বি কৃপালিনীকে নির্দেশ দেন, কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির তরফেও যেন কয়েকটি প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়। বলাই বাহুল্য, নেহরুকেই বাছতে বলা হয়েছিল।
কিন্তু এর পরও গান্ধী ভালোই বুঝেছিলেন ভাবীকাল তাঁর এই নির্দেশকে ‘অনৈতিক’ হিসেবে দেখতে পারে। তিনি নেহরুকেও পুরো পরিস্থিতি খুলে বলেন। শোনা যায়, সব শুনে জওহরলাল নাকি থ হয়ে যান। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি পরিষ্কার করে দেন, কারও ‘ডেপুটি’ হতে তিনি চান না। এর পর গান্ধীর নির্দেশে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন। পরিষ্কার হয়ে যায় নেহরুর পথ। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মনোনয়ন প্রত্যাহার করার বিষয়টি নাকি ভালোভাবে মেনে নেননি দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট রাজেন্দ্র প্রসাদও। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কেন এমন পরিস্থিতিতেও নেহরুকেই বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেননি গান্ধী?
মনে করা হয় নেহরুকে প্রধানমন্ত্রী করার বিষয়ে মহাত্মা গান্ধীর এমন অনমনীয় মনোভাবের পিছনে রয়েছে দুটি কারণ। ১) গান্ধী বিশ্বাস করতেন, বিদেশে শিক্ষিত আধুনিক চিন্তাধারার মানুষ নেহরু দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সঠিক বাছাই। তুলনায় বল্লভভাই প্যাটেল কিছুটা রক্ষণশীল।
২) আর একটা বিষয়ও ছিল। গান্ধীর নাকি এমন আশঙ্কাও ছিল, যদি নেহরুকে প্রধানমন্ত্রী না করা হয় তিনি ব্রিটিশদের সঙ্গে কথা বলে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ার গতি ধীর করে দিতে পারেন! সত্যি-মিথ্যে যাই হোক, ইতিহাসের বুকে কান পাতলে এই সব মিথও শোনা যায়। আর একটা ব্যাপারও ছিল। নেহরু যেমন জানিয়েছিলেন, তিনি কারও ‘ডেপুটি’ হবেন না, এর ঠিক উলটো অবস্থানে ছিলেন প্যাটেল। তিনি তাঁকে যা নির্দেশ দেবেন তিনি সেটাই পালন করবেন এবিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন গান্ধীজি।
পেরিয়ে গিয়েছে সাড়ে সাত দশক। তবু কুরসির কিসসায় ফিরে আসে শুরুর সেই অধ্য়ায়। যা আমাদের এই ধারাবাহিকের শেষ পর্বে ফিরে এল। যেমন ভাবে তা ফিরে ফিরে এসেছে দশকের পর দশক ধরে। আগামিদিনেও আসবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.