সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: বাংলায় বিজেপিকে ধরাশায়ী করার পর থেকেই জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্ব বেড়েছে তৃণমূলের। দিল্লির রাজনীতিতে বিজেপি বিরোধিতার অন্যতম মুখ হয়ে উঠছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) দল। আর সেই আসন মজবুত করতে তৃণমূলের নজর এবার ত্রিপুরায়। সেখান থেকে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলে লোকসভা নির্বাচনের আগে আরও অক্সিজেন পাবে তৃণমূল। কিন্তু এই জয় কি সহজেই হাসিল করতে পারবে তারা, নাকি ত্রিপুরার মাটি তৃণমূলের কাছে হয়ে উঠবে দুর্জেয় ঘাঁটি ?
সর্বভারতীয় স্তরে তৃণমূলের (TMC) সংগঠন মজবুত করার দায়িত্ব নিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আর সেই দায়িত্ব নেওয়ার পর পাখির চোখ করেছেন ত্রিপুরাকে (TMC in Tripura)। ১৬ মাস পরেই সেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। এই সময়টাকেই কাজে লাগাতে চাইছে ঘাসফুল শিবির। সংগঠন মজবুত করতে তৃণমূলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হতে পারেন দুই ব্যক্তি-সুদীপ রায়বর্মন এবং রাজা প্রদ্যোৎ মাণিক্য দেববর্মা। তাঁদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনার আগে ত্রিপুরার রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা একবার বুঝে নেওয়া দরকার।
দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকার পর ২০১৮ সালে ত্রিপুরায় গদিচ্যুত হয় বামফ্রন্ট সরকার। ক্ষমতায় আসে বিপ্লব দেবের (Biplab Dev) বিজেপি। এর পর প্রায় চার বছর অতিক্রান্ত। নদী দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করে শিরোনামে এসেছেন বিপ্লব দেব। নিয়েছেন বেশকিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তও। ফলে চার বছরের শাসনকালের মধ্যেই ত্রিপুরাবাসীর একাংশের মধ্যে জনপ্রিয়তা খুইয়েছেন তিনি। এদিকে বামেদের রক্তক্ষরণ অব্যাহত। ত্রিপুরার রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন কংগ্রেস, আইপিএফটি। ফলে বিকল্প খুঁজছেন আম ত্রিপুরাবাসী। রাজনৈতিক মহল বলছে, বিকল্প শক্তি হিসেবে উঠে আসছে তৃণমূল। এদিকে ত্রিপুরার জনজাতির মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে প্রদ্যোত মাণিক্যর-তিপরা। স্থানীয় নির্বাচনে বিজেপিকে ধাক্কা দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভাল ফল করেছে তারা। এদিকে আবার বিজেপি বিরোধিতা করতে গিয়ে তৃণমূলকে প্রচ্ছন্নে মদত দিচ্ছে বামেরা। এমনকী, তৃণমূল নেতা-কর্মীদের উপর হামলার জন্য বিজেপির নিন্দা করেছে বামেরা। এর থেকে স্পষ্ট যে বামেরা তৃণমূলের উপর নির্ভর করে সংগঠন চাঙ্গা করতে চাইছে।
রাজনৈতিক মহল বলছে, তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি বিশেষ আবেগ রয়েছে ত্রিপুরাবাসীর। কারণ, তিনি যখন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী ছিলেন বারবার উত্তর-পূর্ব ভারতের এই রাজ্যে সফর করেছেন। একাধিক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন তিনি। সেকথা এখনও ভোলেনি ত্রিপুরাবাসী। মমতার প্রতি অনুরাগ থাকলেও মুশকিল হয়েছে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের নিয়ে। ইতিপূর্বে বেশকিছু নেতা তৃণমূলের টিকিটে জয় পেয়েও দলবদল করেছেন। মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন বলে অভিযোগ করেছে স্থানীয়রাই। এদিকে ত্রিপুরা ২.০ পরিকল্পনায় এখনও নতুন করে কোনও মুখকে তুলে ধরতে পারেনি তৃণমূল। গঠিত হয়নি রাজ্য, জেলা বা ব্লকস্তরের কোনও কমিটি। বাংলা থেকে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা নিয়মিত সে রাজ্যে গেলে মানুষের কাছে কতটা পৌঁছতে পারছেন তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এমন পরিস্থিতিতে ঘাসফুল শিবিরের পক্ষ থেকে বারবার বিক্ষুব্ধ বিজেপি নেতা সুদীপ রায়বর্মনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
এদিকে বিজেপি বিক্ষুধ্ব বিধায়কের অবস্থান নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। কখনও তিনি ফেসবুকে বিজেপির প্রতি আস্থা রাখেন আবার কখনও ত্রিপুরার গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কখনও তিনি অসমে বিজেপির উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘চাণক্য’ হিমন্ত বিশ্বশর্মার সঙ্গে বৈঠক সারেন তো কখনও কলকাতায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হন। যদি শেষ পর্যন্ত বিজেপি ছেড়ে সুদীপবাবু তৃণমূলে ফেরেন তাহলে তিনিই যে এ রাজ্য ঘাসফুল শিবিরের অন্যতম মুখ হবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর তিনি হাল ধরলে এ রাজ্যের ৩৬ শতাংশ বাঙালি ভোটের বেশকিছুটা তৃণমূলের ঝুলিতে আসবে বলে মনে করছে।
কিন্তু শুধু বাঙালি ভোট নয়, ত্রিপুরায় দাঁত ফোটাতে হলে তৃণমূলের ঝুলিতে দরকার জনজাতির ভোটও। আর সেই ভোট টানতে ঘাসফুল শিবিরের নজর রাজা প্রদ্যোৎ মাণিক্য দেববর্মা ও তাঁর দল তিপরা মোথার-র দিকে। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া জনজাতি এলাকার স্থানীয় নির্বাচনে ২৮টির মধ্যে ১৪টি আসন পেয়েছে রাজা প্রদ্যোৎ মাণিক্যর দল। ১১টি পেয়েছে বিজেপি। রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন কুণাল ঘোষ। কিন্তু মুশকিল হল তিপরা প্রধানের দাবিদাওয়া। তিনি বরাবরই আলাদা তিপরাল্যান্ডের দাবি জানিয়ে আসছেন। স্থানীয় রাজনৈতিক মহল বলছে, যে দল লিখিতভাবে তিপরাল্যান্ডের আশ্বাস দেবে, তাদের সমর্থন করবেন রাজা। কিন্তু এই শর্তে কি রাজি হবেন তৃণমূল সুপ্রিমো? কারণ এই শর্ত মেনে নিলে বাংলায় ফের গোর্খাল্যান্ডের দাবি মাথাচারা দিতে পারে। এদিকে আবার ত্রিপুরা ষষ্ঠ তফসিলি অন্তর্ভুক্ত রাজ্য। ফলে জনজাতির উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রের সাহায্য দরকার। আর সাধারণত কেন্দ্রে যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তার দিকেই ঝুঁকে থাকে উত্তর-পূর্বে রাজ্যের দলগুলি। প্রদ্যোৎ মাণিক্য চরম বিজেপি বিরোধী হলেও তৃণমূলকে সমর্থন করার ঝুঁকি কি নেবেন তিনি, উত্তরটা অবশ্য সময় দেবে।
অর্থাৎ ত্রিপুরা জয় করতে হলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে এখনও একাধিক ‘পাজল’ মেলাতে হবে। আর তিনি যদি এই অঙ্ক একবার কষে ফেলতে পারেন, তাহলে জাতীয় রাজনীতিতে রাতারাতি নায়ক হয়ে যাবেন তিনি। আর যদি না পারেন, তাহলেও তিনি বিশেষ কিছু হারাবেন না। বলছেন স্থানীয় রাজনৈতিক মহল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.