বিশ্বদীপ দে: আবারও অশান্তির আঁচ পাঞ্জাবে (Punjab)। নেপথ্যে খলিস্তানি (Khalistan) আন্দোলন। কুখ্যাত খলিস্তানি নেতা অমৃতপাল সিংকে আটক করেছে পুলিশ। শোনা যাচ্ছে এমনটাই। তবে সত্য়িই তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন কিনা তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারণ পুলিশ হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বলেনি। এলাকায় অশান্তি ছড়াতে পারে এই আশঙ্কায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা। এমনিতেই গত কয়েক বছরে যেন নতুন করে খলিস্তানি আন্দোলনের পালে হাওয়া লেগেছে। কেবল ভারত নয়, ভারতের বাইরেও। অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মতো দেশে হিন্দু মন্দিরে ভারতবিরোধী স্লোগান লিখতে দেখা গিয়েছে আন্দোলনকারীদের। যা ২০২৩ সালে এসে নতুন মাত্রা পেয়েছে। অমৃতপালকে বলা হচ্ছে ‘ভিন্দ্রানওয়ালে ২.০’। যা নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছে জার্নেল সিংহ ভিন্দ্রানওয়ালে ও অপারেশন ব্লু স্টারের কথা। খলিস্তানি আন্দোলনের জন্ম অবশ্য তারও আগের কথা। প্রশ্ন উঠছে, কেন কয়েক দশক ধরে এই বিষবৃক্ষ বারবার মাথাচাড়া দিচ্ছে? কেন বিচ্ছিন্নতাবাদী এই আন্দোলনকে পুরোপুরি দমন করা যাচ্ছে না? একথা ভাবতে গেলে খলিস্তানি আন্দোলনের ইতিবৃত্তকে একবার ফিরে দেখা দরকার।
প্রথমেই জেনে নেওয়া দরকার, খলিস্তানিরা কী চায়। তাদের আন্দোলন আসলে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। তারা চায় শিখদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র। যার মধ্যে থাকবে ভারতের পাঞ্জাব ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ। থাকবে হিমাচল প্রদেশ, রাজস্থান ও হরিয়ানারও কিছু অংশ। পাঞ্জাব ছাড়া এই রাজ্যগুলির অংশ অবশ্য প্রথম দাবি করা হতে থাকে আটের দশকে এসে।
এই আন্দোলনের উৎস খুঁজতে গেলে দেশভাগের সময়ে পৌঁছে যেতে হবে। আসলে সেই যে আমাদের বাংলার মতো পাঞ্জাবও দু’টুকরো হয়ে গেল সমস্যা তখনই তৈরি হয়ে গেল। পাকিস্তানের জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ শিখ ধর্মাবলম্বী। অন্যদিকে বিপুল সংখ্যাক শিখ রয়েছেন ভারতে। কিন্তু পাকিস্তানেই রয়ে গিয়েছে মহারাজা রণজিৎ সিংয়ের শিখ সাম্রাজ্যের রাজধানী লাহোর। রয়েছে নানখানা সাহিব- গুরু নানকের জন্মস্থান। স্বাধীনতার পর থেকেই শিরোমণি অকালি দল দাবি করেছিল পৃথক শিখ রাষ্ট্রের। শুরু হয় সুবা আন্দোলন। ১৯৫৫ সালে রাজ্যগুলির পুনর্গঠন কমিশনের রিপোর্টে সেই দাবি খারিজ করে দেওয়া হয়। কিন্তু আন্দোলন থামেনি।
১৯৬৬ সালে পাঞ্জাবের পুনর্গঠন আইন পাশ হয় সংসদে। এর ফলে পাঞ্জাব ভাগ হয়ে যায় পাঞ্জাব ও হরিয়ানায়। সেই সঙ্গে হিমাচল প্রদেশ ও চণ্ডীগড়ের কিছু অংশকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইন্দিরা গান্ধী সরকার পাঞ্জাবের গঠন মেনে নিলেও চণ্ডীগড়কে এর রাজধানী হিসেবে মেনে নেয়নি। একে স্বশাসন দিতেও রাজি হয়নি। এদিকে ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ সালে কংগ্রেসকে কড়া টক্কর দিলেও ১৯৭১ সালে লোকসভা নির্বাচনের পর ক্রমশই কমজোরি হয়ে পড়তে থাকে অকালি দল। এই পরিস্থিতিতে ১৯৭৩ সালে নতুন একদফা দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করে তারা। আনন্দপুর সাহিব অঙ্গীকার নামে পরিচিত সেই দাবিসমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল শিখ ধর্মকে হিন্দু ধর্ম থেকে পৃথক একটি ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি, চণ্ডীগড়কে ফের পাঞ্জাবের রাজধানী হিসেবে ফিরিয়ে দেওয়া এবং পাঞ্জাবের স্বশাসনের মতো ইস্যু। কিন্তু অকালি দলের সেই সব দাবি তেমন আলোড়ন ফেলতে পারেনি ১৯৮২ সালের আগে পর্যন্ত। সেই বছরই জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের নাম দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া শুরু হল। ভিন্দ্রানওয়ালে হাত মেলালেন অকালি দলের সঙ্গে। তৈরি করলেন ধর্মযুদ্ধ মোর্চা। হাজার হাজার মানুষ সেই আন্দোলনে যোগ দিলেন।
এর ঠিক দু’বছর পরে ‘অপারেশন ব্লুস্টারে’ প্রাণ হারান ভিন্দ্রানওয়ালে। মাঝের দু’বছরে বারবার রক্তাক্ত হতে থাকে পাঞ্জাব। রীতিমতো সহিংস এই অভ্যুত্থানে রাজ্যের সাধারণ মানুষ বিপণ্ণ বোধ করতে থাকেন। আলাদা করে উল্লেখ করা যায় ১৯৮৩ সালে দরবার সাহেবের গেটে ডিআইজি অবতার সিং অটওয়ালের হত্যাকাণ্ডের। সেই সময় ভিন্দ্রানওয়ালের দাপট নাকি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তাঁর অনুমতি না থাকায় মৃতদেহ স্পর্শ পর্যন্ত করেনি পুলিশ। রোদ ঝলমল দিনের বেলা প্রকাশ্যে পড়েছিল হতভাগ্য সেই অফিসারের মৃতদেহ।
ক্রমশই বিষিয়ে উঠেছিল পরিবেশ। এর আগে ১৯৮২ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসকে ভণ্ডুল করতে চেয়েছিল অকালি দল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেও চাঞ্চল্য ছড়িয়েছিল। কিন্তু পরের বছর পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছিল। পাঞ্জাবে জারি হয়ে যায় জরুরি অবস্থা। এই অবস্থায় অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে ট্রাকে করে অস্ত্র এনে মজুত করা হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছিল। খলিস্তানিরা মন্দিরে আশ্রয় নিচ্ছে বলেও পুলিশের কাছে খবর ছিল। কিন্তু শিখ ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে সেই আশঙ্কায় কোনও অপারেশন চালানো যাচ্ছিল না। ক্রমেই নিজেকে অপ্রতিরোধ্য মনে করতে শুরু করেছিলেন ভিন্দ্রানওয়ালে (Jarnail Singh Bhindranwale)। অদ্ভুত বিষয় হল, পৃথক খলিস্তানি রাষ্ট্র কিন্তু চাননি তিনি। তিনি কার্যতই স্বর্ণমন্দিরকে তাঁর দলের সদর দপ্তর বানিয়ে একটি সমান্তরাল সরকার গঠন করার স্বপ্ন দেখছিলেন।
কেন্দ্রে সেই সময় ইন্দিরা গান্ধী সরকার। পাঞ্জাবের এই সমস্যার সমাধান কী করে করা সম্ভব তা কার্যতই যেন ভেবে পাচ্ছিলেন না ইন্দিরা। এপ্রসঙ্গে একটা অন্য কথা বলা দরকার। ওয়াকিবহাল মহলের একাংশের দাবি, ভিন্দ্রানওয়ালে নাকি একসময় ইন্দিরা-পুত্র সঞ্জয় গান্ধীরই ‘কালো ঘোড়া’ ছিলেন। অকালি দলের বিরুদ্ধে তাঁকে দাঁড় করিয়ে কংগ্রেসকে রাজনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দিতে চেয়েছিলেন সঞ্জয়। যদি এই গুঞ্জন সত্য়ি হয়, তাহলে মানতেই হবে ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’-এর দানবের মতোই তা উলটে কংগ্রেসকেই বিপাকে ফেলতে শুরু করেছিল। হিন্দুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ডাক দিয়েছিলেন ভিন্দ্রানওয়ালে। সরকারি অফিসারদের খুনের ঘটনা যেন নিয়মিত হয়ে উঠেছিল।
এহেন পরিস্থিতিতে স্বর্ণমন্দিরে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকা ভিন্দ্রানওয়ালে ও তাঁর দলবলকে সরাতে ‘অপারেশন ব্লুস্টারে’র পরিকল্পনা করেন ইন্দিরা। ১৯৮৪ সালের ৩ থেকে ৮ জুন- প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে চলেছিল অপারেশন। যদিও তার দু’দিন আগে ১ জুনই কিন্তু সেনা ভিন্দ্রানওয়ালেকে সরাতে অভিযান শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু প্রাথমিক ভাবে ভিন্দ্রানওয়ালে ও তাঁর দলবলের সশস্ত্র জবাব ছিল সেনার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। স্বাভাবিক ভাবেই সেনা আরও বড় করে পরিকল্পনা করে। শেষ পর্যন্ত ভিন্দ্রানওয়ালের মৃত্যু হয়। সব মিলিয়ে জঙ্গি ও সাধারণ মানুষ মিলিয়ে ৪৯৩ জনের মৃত্যু হয় ওই অপারেশনে। পাশাপাশি ৮৩ জন সেনাও শহিদ হন। আহত হন প্রায় আড়াইশো জন। যদিও বেসরকারি মতে মৃতের সংখ্যাটা নাকি তিন হাজারেরও বেশি। এদিকে ‘অপারেশন ব্লুস্টারে’র পর শিখদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে থাকে। যেহেতু স্বর্ণমন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর নিজের দুই দেহরক্ষীর হাতে ইন্দিরার প্রয়াণের পিছনেও ছিল সেই প্রতিক্রিয়াই।
ভিন্দ্রানওয়ালের মৃত্যুর পর পাঞ্জাব শান্ত হয়ে যাবে মনে করা হলেও তা হয়নি। রাজ্যজুড়ে অশান্তি চলতেই থাকে। যা চলেছিল মোটামুটি নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। শোনা যায়, পাকিস্তান নাকি নিয়মিত অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য জুগিয়েছে এই আন্দোলনকে জল-সার দিতে। কিন্তু জনতার গরিষ্ঠ অংশের প্রতিরোধের ধাক্কায় ধীরে ধীরে একসময় নিভে আসে আন্দোলনের আগুন।
দীর্ঘ দীর্ঘ দিন ধরে পাঞ্জাব শান্তই ছিল। যদিও দেশের বাইরে অন্যত্র যেখানেই শিখ ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যায় বেশি, সেখানে কিন্তু ধিকি ধিকি জ্বলছিল খলিস্তানি আন্দোলনের আগুন। মার্কিন ‘শিখ ফর জাস্টিস’ সংগঠনকে ২০২০ সালে জঙ্গি দল হিসেবে ঘোষণা করে ভারত। গত বছর তিনেক ধরে নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে এই আন্দোলন। নতুন করে। কৃষক আন্দোলনেও খলিস্তানিদের যুক্ত থাকার কথা শোনা গিয়েছিল!
এই অবস্থায় খলিস্তানি সংগঠন ‘ওয়ারিস পাঞ্জাব দে’র নাম শোনা যাচ্ছে। তৈরি করেছিলেন প্রয়াত রাজনীতিবিদ দীপ সিধু। তাঁর মৃত্যুর পরই সংগঠনের দায়িত্ব বর্তেছে অমৃতপালের উপরে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই ফের নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে খলিস্তানি আন্দোলন। এই পরিস্থিতিতে অমৃতপালের গ্রেপ্তারিতে কি আপাতত শান্তি ফিরবে? নাকি নতুন বাঁক নেবে আন্দোলন? উত্তর আপাতত ভবিষ্যতের গর্ভে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.