গৌতম ব্রহ্ম: প্রাতঃভ্রমণের পর এক ঘণ্টা চণ্ডীপাঠ। চারটি অধ্যায় শেষ না করে প্রাতরাশ স্পর্শ করতেন না তিনি।
রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও এই অভ্যাসে নড়চড় হয়নি। রাইসিনা হিলের বাসিন্দা হওয়ার পরও কীর্ণাহারের বাড়িতে নিজের হাতে দুর্গাপুজো সেরেছেন। মা দুর্গার সেই বরপুত্রের প্রয়ানে হিমালয়েও শোকের ছায়া। পাণ্ডববর্জিত পাহাড়চূড়ায় চোখের কোণ ভিজেছে সন্ন্যাসীর। হবে না কেন?
সেনা হাসপাতালে ভরতির পর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির (Pranab Mukherjee) আরোগ্য কামনায় হিমালয়ের দুর্গম পর্বতশৃঙ্গে প্রার্থনায় বসেছিলেন সন্ন্যাসীরা। মহামৃত্যুঞ্জয় যজ্ঞ হয়েছে। ‘প্রাণিক হিলিং’-ও করার চেষ্টা হয়। সেখানেই তাল কাটে। যজ্ঞের পরই এক সন্ন্যাসী প্রবল অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতা এতটাই বেড়ে যায় যে তাঁকে হাসপাতালে ভরতি করতে হয়। হাসপাতাল শয্যায় শুয়েই সেই সন্ন্যাসী আফশোস করেছিলেন, “প্রণবদাকে বাঁচানো গেল না। অনেক চেষ্টা করলাম।”
ওই সন্ন্যাসী স্বামী শংকরচৈতন্য মহারাজ। প্রণববাবুর বহুদিনের পরিচিত। উত্তরকাশীর শিখর পর্বতে ২০ বছর ধরে সাধনারত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির এই আত্মীয়সম ভাই। প্রণববাবু নিজে বেশ ক’বার গেরুয়াধারী ভাইকে রাইসিনা হিলসে ডেকেছেন। মহারাজের লেখা বই ‘তিব্বতের অলৌকিক জ্ঞানগঞ্জ’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছেন। রাষ্ট্রনায়ক দাদার প্রয়াণে যারপরনাই ভেঙে পড়েছেন সেই শংকর মহারাজ। সোমবার রাতে দূরভাষে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-কে জানালেন, “সন্ন্যাসীদের পূর্বাশ্রমের কথা ভুলে যেতে হয়। কিন্তু, প্রণবদাকে ভুলতে পারিনি। বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। রাষ্ট্রপতিভবনে গিয়েছি। অসুস্থ হওয়ার পর দাদার আরোগ্য কামনায় যজ্ঞ করি। ছেলে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও দাদা হাসপাতালে ভরতির পর বেশ কয়েকবার কথা হয়। প্রণবদার এক ভাইজি সন্ন্যাস নিয়ে গঙ্গোত্রীতে আছেন। তিনিও যজ্ঞের অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু যজ্ঞ শেষ করার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ‘শাপমোচন’ আর করা হয়নি। চোখের সামনে শুধু ভেসে উঠছিল মুঘল গার্ডেনের দু’টি গোলাপ ফুল।”
প্রণববাবু একমাত্র রাষ্ট্রপতি, যাঁর নামে গোলাপ গাছ রয়েছে রাষ্ট্রপতি ভবনের মুঘল বাগানে। জওহরলাল নেহরু থেকে মাদার টেরেসা, এমন প্রায় ১৪০ জন বিখ্যাত মানুষের নামে এখানে গোলাপ গাছ রয়েছে। তার পাশেই ২০১৭ সাল থেকে দু’টি অপূর্ব গোলাপ শোভা পাচ্ছে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও তাঁর স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের নামে। রাজনীতির ময়দানে থাকলেও প্রণববাবু ছিলেন ধর্মপ্রাণ মানুষ। চণ্ডীপাঠ না করে খাবার ছুঁতেন না। প্রণববাবু নিজের মুখেই একাধিকবার জানিয়েছেন, তিনি আস্তিক। ঈশ্বরে বিশ্বাসী। রোজ চণ্ডীর চারটি অধঅযায় পড়েন। সময় থাকলে ত্রয়োদশ অধ্যায় পর্যন্তও পড়ে ফেলেন। চণ্ডীপাঠের সময়ও কেউ বিরক্ত করতেন না কীর্ণহারের ভূমিপুত্রকে। এমনকী, কংগ্রেস দলনেত্রী সোনিয়া গান্ধীও না। চণ্ডীপাঠের পর খাওয়া-দাওয়া সারতেন।
রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও কীর্নাহারের মিরিটি গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন। শংকর মহারাজ জানালেন, পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাবান ছিলেন দাদা। পরিবারের একজনকে সক্রিয়ভাবে পুজোয় অংশ নিতে হয়, মহিলাদের রান্না করতে হয় ভোগ। এটাই মুখোপাধ্যায় পরিবারের ঐতিহ্য। তা মেনেই দশমীর পুজো দাদা নিজে করতেন। বাইরের পুরোহিতরা থাকলেও তন্ত্রধারকের ভূমিকায় তিনদিন চণ্ডীপাঠ করতেন প্রণববাবু। দশমীর দিন সাতবার মন্দির প্রদক্ষিণ করে পুজোয় বসতেন। কোনওবার তার অন্যথা হয়নি। কিন্তু, সাধু-সন্ন্যাসীদের কাছে কখনও যাতায়াত ছিল না প্রতিরক্ষা, অর্থ, বিদেশ মন্ত্রক সামলানো চাণক্যর। হিমালয়ের যোগসূত্র বলতে এই গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী ভাই ও ভাইজি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.