মণিশংকর চৌধুরি, গুয়াহাটি: অপেক্ষার প্রহর শেষ। ৩১ আগস্ট, সকাল ১০টায় প্রকাশিত হবে চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি। এই তালিকায় যাঁদের নাম থাকবে, তাঁরাই ভারতের নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন। তাঁরাই হবেন ‘সার্টিফায়েড সিটিজেন’। অন্যথায় ‘বিদেশি’ বলে চিহ্নিত হবেন। এই সংখ্যক জনগণকে আবার নাগরিকত্ব প্রমাণে পেরতে হবে দীর্ঘ পথ। আইনি জটিলতা, অর্থব্যয়ের হরেক ঝক্কি। তাই অসম জুড়ে চাপা টেনশন।
যেন যুদ্ধ-যুদ্ধ একটা ব্যাপার। গোটা রাজ্যে মোতায়েন ২০ হাজার বাড়তি আধা সামরিক বাহিনী। গুয়াহাটি, কামরূপের মতো স্পর্শকাতর এলাকাগুলিতে জারি ১৪৪ ধারা। বাড়তি সতর্কতা রয়েছে গুয়াহাটির বাঙালি অধ্যুষিত উদালবাকড়া, গণেশগুড়িতে।
১৯৫১ সালে বর্তমান বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশের ভিত্তিতে তৈরি হচ্ছে নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি। কিন্তু অসমে রাজীব গান্ধী এবং অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘অসম অ্যাকর্ড’ অনুযায়ী সেখানে এনআরসি তৈরির সময় হিসেবে ধরা হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ।সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এনআরসি কো-অর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলার নেতৃত্বে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ হয়েছে। প্রথম খসড়া থেকে বাদ পড়েছিলেন ৪১ লক্ষ মানুষ। তাঁরাই এবার দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষা করছেন, শনিবার প্রকাশিত হওয়া তালিকায় তাঁদের নাম থাকবে তো? সরকারি ওয়েবসাইট আর রাজ্যজুড়ে থাকা এনআরসি সেবাকেন্দ্রে এই চূড়ান্ত তালিকা দেখতে পাবেন সকলে। তার আগে পর্যন্ত কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যাতে কোনওরকম বক্তব্য পেশ না করেন, তার জন্য অসমের বিজেপি সরকারের তরফে হুইপ জারি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়াল বলেছেন, ‘এনআরসি সম্পূর্ণভাবে প্রথা মেনে প্রকাশিত হচ্ছে। রাজ্যবাসী সহযোগিতা করবেন। কোনওরকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতি রুখতে তৎপর সরকার। গুজবে কেউ কান দেবেন না। যাঁদের নাম চূড়ান্ত তালিকায় থাকবে না, তাঁদের যে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, তা নয়।’ পাশাপাশি তিনি আরও জানিয়েছে, রাজ্যজুড়ে এক হাজার ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল খোলা হয়েছে। যেখানে ‘বিদেশি’
তকমাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা গিয়ে নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণে তথ্য পেশ করতে পারবেন। এর সময়সীমাও বাড়ানো হয়েছে। ৬০ দিনের বদলে ১২০দিন করা হয়েছে।
কিন্তু ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল যে খুব স্বস্তি দিতে পারে, তেমনটা নয়। এভাবে নাগরিকত্ব প্রমাণে অনেক আইনি পদ্ধতি রয়েছে। প্রচুর অর্থব্যয়ও হওয়ার আশঙ্কা। তাই আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া ব্যক্তিদের আইনি সহায়তা দেবে রাজ্য সরকার।এরপরও সংশয় আছে অনেক। এনআরসি তালিকা কতটা স্বচ্ছ, তা নিয়ে বিজেপির অন্দরেই প্রচুর দ্বিধা রয়েছে। মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা এবং রাজ্য বিজেপি সভাপতি রঞ্জিত দাসের অভিযোগ, প্রতীক হাজেলার নেতৃত্বে এনআরসি তালিকা স্বচ্ছভাবে তৈরি হচ্ছে না। কারণ, ইতিমধ্যেই বহু সন্দেহভাজন ব্যক্তির নাম তালিকায় রয়েছে বলে দাবি করেছেন তাঁরা। উলটোদিকে, অসমের ভূমিপুত্রদের অনেকে বাদ পড়েছেন বলেও ইঙ্গিত মিলছে। এক সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশ লাগোয়া তিন জেলা দক্ষিণ সালমারা, ধুবড়ি, করিমগঞ্জ থেকে যথাক্রমে ৭.২২ শতাংশ, ৮.২৬, ৭.৬৭ শতাংশ আবেদনকারীর নাম খারিজ হয়েছে। আরেকদিকে, আপার অসমের কার্বি আংলং, যা কিনা কার্বি উপজাতি অধ্যুষিত, সেখানে এনআরসি তালিকা থেকে খারিজ হয়েছে ১৪.৩১ শতাংশ জনতার নাম।আর তিনসুকিয়ায় ১৩.২৫ শতাংশ বাসিন্দার নাম বাতিল হয়ে গিয়েছে।আর এই নাম বাদ যাওয়া নিয়েই সংশয় দানা বাঁধছে বিজেপি নেতত্বের অন্দরে।
শনিবারের তালিকায় যাঁদের নাম উঠল, তাঁরা চিন্তামুক্ত। কিন্তু যাঁরা বাদ পড়লেন, তাঁদের কী হবে?এনিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় অসমের অত্যন্ত দক্ষ ডিজিপি কুলধর সইকিয়ার মেয়াদ ৩ মাস বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে অশান্তি হলে, তা দক্ষ হাতে তিনি সামলাতে পারেন। সরকারের তরফে যতই আশ্বাস দেওয়া হোক যে এই মুহূর্তেই তাঁদের ঠিকানা ডিটেনশন ক্যাম্প নয়, নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে না। দিন
কয়েক আগে অসম পুলিশের এক এসআইয়ের গ্রেপ্তারির ঘটনাই স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। ওই এসআইয়ের নাম ছিল না নাগরিকপঞ্জিতে। তিনি নিজেও ‘বিদেশি’ খোঁজার অভিযানে গিয়েছিলেন। অথচ তাঁকেই গ্রেপ্তার হতে হল। এরপরও থাকছে আইনি জট। বহু দূরে দূরে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে গিয়ে নথিপত্র জমা দিয়ে জুতোর শুকতলা ক্ষয়ে যাওয়ার জোগাড়। তারউপর সেসব নথি কাঁটাছেঁড়া করে সত্যতা প্রমাণিত হতে লেগে যাবে ৪ থেকে ৫ বছর। এই কয়েক বছর তাহলে কোন পরিচয়ে, কোন অধিকারে থাকবেন তাঁরা? নাগরিক নয় বলেই যদি তাঁদের ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ডিটেশন ক্যাম্পে, তাহলে ভবিষ্যত অন্ধকার। এই দোলাচলেই এখন ভুগছেন ৪১ লক্ষ মানুষ। এ যেন এক
অগ্নিপরীক্ষা। এ দেশ কার? তার প্রমাণ দেওয়ার পরীক্ষা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.