বিশ্বদীপ দে: একটা কথা প্রায়ই ভেসে আসে। গুজবে কান দেবেন না। সময়ে অসময়ে ‘পাবলিক’ তথা আমজনতার দরবারে জেগে ওঠে সতর্কবার্তা। সেই সঙ্গে থাকে আরও এক আরজি। গুজব ছড়াবেন না। অর্থাৎ নিজের বোধবুদ্ধি ও চর্মচক্ষুর উপরে ভরসা রাখাই শ্রেয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা? হালফিলে করোনা টিকা নিয়ে অনেকেই ‘অতিমানব’ হতে শুরু করেছিলেন। ছোটবেলা থেকে দেখা সুপারম্যান, স্পাইডারম্যানদের ভিড়ে হাজির হয়েছিলেন ম্যাগনেট ম্যানরা (Magnet Man)! কল্পনায় নয়, রক্তমাংসে। শরীরে টিকার (COVID vaccine) ডোজ পৌঁছতেই তাঁরা নাকি হয়ে উঠেছেন আস্ত চুম্বক!
স্বাভাবিক ভাবেই কয়েকদিন যেতে না যেতে বেরিয়ে এসেছে আসল সত্যিটা। অতীন্দ্রিয় সেই ক্ষমতা দুম করে উবে গিয়েছে পিঠে পাউডার লাগাতেই। আসলে বর্ষাকালের আর্দ্রতা ভরা পরিবেশ ও গায়ে বিনবিনে ঘামের দৌলতেই ওইভাবে গায়ে সেঁটে যেতে দেখা গিয়েছে বাসনকোসনগুলিকে। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই গুজবের প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই বলছেন, ইদানীং মানুষের ধৈর্য এত কম যে কিছু একটা রটলেই আর তা তলিয়ে দেখার চেষ্টা করেন না কেউই। কিন্তু খামোখা ‘যুগের ধর্ম’ বলে গাল পাড়ার আগে ভেবে দেখুন তো, এ অভ্যেস কি আজকের? তাহলে ১৯৯৫ সালের সেই সেপ্টেম্বর মাসে কী হয়েছিল? যেদিন দেশশুদ্ধ সর্বত্র গণেশ ঠাকুর (Ganesha drinking milk miracle) চোঁ চোঁ করতে খেতে শুরু করেছিলেন দুধ! আজ থেকে প্রায় ছাব্বিশ বছর আগে ১৯৯৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল এই রোমাঞ্চকর দাবি।
খুব ভোর থেকেই হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসতে শুরু করেছিল খবরটা। যাঁরা মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলেন কিংবা যাঁরা দুধের ডিপোয় হাজির হয়েছিলেন ক্যান হাতে তাঁরা সকলেই বাড়ি ফিরে খবরটা ছড়িয়ে দিতে দেরি করেননি। ফলস্বরূপ, বেলা একটু গড়াতে না গড়াতেই গণেশমন্দিরগুলিতে লাইন ক্রমেই দীর্ঘ হতে শুরু করল। এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের দাবি, মুম্বইয়ের ৫৫ শতাংশ, দিল্লির ৬৩ শতাংশ ও কলকাতার ৬৭ শতাংশ মানুষ জানিয়েছিলেন তাঁর মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, এই ‘মিরাকলে’! যদি মেট্রোপলিটন শহরেরই এই অবস্থা হয়, তাহলে শহরতলি কিংবা গ্রামের ছবিটা কী ছিল ভেবে দেখুন।
পরিস্থিতি কী দাঁড়িয়েছিল তা বোঝাতে কয়েকটা তথ্য জানানো যাক। দিল্লি ও বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পাঞ্জাবে টহলরত সেনারা থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। স্কুল-কলেজ মায় অফিস-কাছাড়িতে অ্যাটেন্ডেন্সের খাতায় অনুপস্থিতির হার চোখ কপালে তোলার মতো। আর সেই সঙ্গে দেশজুড়ে তৈরি হয়েছিল দুধের সাময়িক আকাল! কেবল ভারত তো নয়, নেপালের রাজা বীরেন্দ্র থেকে শুরু করে আমেরিকা-ব্রিটেনের প্রবাসী ভারতীয়রা। বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল সেই গুজব। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা আচার্য গিরিরাজ কিশোর বিভিন্ন মিডিয়া দপ্তরে ফ্যাক্স পাঠিয়ে খবরটা দিতে শুরু করেন। দাবি করেন, ‘হিন্দুত্ববাদের’ এক নতুন যুগের ভোর হয়েছে। উত্থান হয়েছে শিবশক্তির। যদিও দুপুর গড়ানোর পরে বিজ্ঞানী ও যুক্তিবাদীরা বলতে শুরু করলেন সারফেস টেনশন কিংবা ক্যাপিলারি ক্রিয়ার কথা। যেসবের কারণেই দেবতার মুখে ধরা চামচের দুধ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে কমে আসে লোকশ্রুতির মাত্রা।
কিন্তু এরপরও ২০০৬ সালের আগস্ট, ২০০৮ সালের জানুয়ারি ও ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে এমন দাবি শোনা গিয়েছিল। তবে প্রথমবারের মতো তা সর্বত্রগামী হয়ে পড়েনি। এছাড়াও ২০১৭ সালের মার্চে এলাহাবাদের মীরগঞ্জে হনুমান মূর্তির চোখে অশ্রুবিন্দু ঘিরেও হইহই পড়ে যায়।
ভক্তির মতোই দ্রুত ছড়ায় প্রতিহিংসার তুলোবীজ। উড়তে উড়তে এক জায়গা থেকে বহু জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে আজকের এই সোশ্যাল মিডিয়া ও মেসেজিং প্ল্যাটফর্মের দাপাদাপির যুগে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০১৭ সালের মে মাস। হোয়াটসঅ্যাপে (Whatsapp) ঘুরতে লাগল একটা মেসেজ। বলাই বাহুল্য আদ্যন্ত ফেক। যে রাজ্যে ছড়াচ্ছে, সেই রাজ্যের নাম ধরে বলে দেওয়া হল সেখানে নাকি শয়ে শয়ে ছেলেধরারা ছড়িয়ে পড়েছে। সঙ্গে থাকল একটা রোমহর্ষক ভিডিও। ঠিক যেন গোপন সিসিটিভি ফুটেজ। আসলে সেটা ছিল পাকিস্তানের করাচি শহরের ভিডিও। শিশুদের কিডন্যাপিং সংক্রান্ত একটি শিক্ষানবিশ ভিডিও সেটি। সেটাকেই এডিট করে ব্যবহার করা হল বিশ্রী গুজবের ইঞ্জিন হিসেবে। এরপরই শুরু হয়ে গেল ছেলেধরা ধরার ধুম। ঝাড়খণ্ডে পিটিয়ে মারা হল ৭ জনকে। এখানেই শেষ নয়। পরের বছরও আবার ঘুরতে শুরু করল সেই মেসেজ। এবার আর ঝাড়খণ্ড কেবল নয়, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, অসম, মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা, পশ্চিমবঙ্গ হয়ে সে ছড়িয়ে পড়ল বহু দূরে। ভিন্ন এলাকায় রুটিরুজির সন্ধানে যাওয়া নিরীহ মানুষরা পড়ে গেলেন সেই ভয়াবহ গুজবের হাঁমুখে। প্রাণ হারালেন বেঘোরে। আর এই মৃত্যুমিছিলের জন্মদাতা একটি মাত্র ভুয়ো মেসেজ। যে এক থেকে বহু হয়ে এভাবেই মরণফাঁদ তৈরি করে দিয়েছিল। কাছাকাছি সময়ে আমাদের রাজ্যে এক রহস্যময় বৃদ্ধার কথা ছড়িয়ে পড়েছিল। যে নাকি লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পেঁয়াজ চায়! সেই গুজবকে কেন্দ্র করেও বহু অশান্তির জন্ম হয়েছিল।
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে যোগাযোগের সহজলভ্যতা বেড়ে যাওয়াটা গুজবের পথকে আরও পিচ্ছিল করে দিয়েছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাবতে অবাক লাগে নয়ের দশকে গণেশের (Lord Ganesha) দুধ খাওয়ার খবর কেমন করে ছড়িয়ে পড়েছিল! সেখানেই তো শেষ নয়। তার আগেও বছর বছর এমনই কত কিছুই লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে। সাতের দশকের শেষ হোক কিংবা আটের দশকের শুরুতে যাদের জন্ম, তাদের ছোটবেলা জুড়ে ছিল ‘ব্যান্ডেজ ভূত’-এর গুজব। সারা শরীর জুড়ে ব্যান্ডেজ জড়ানো। ছোট ছেলেমেয়েকে একলা পেলেই সিরিঞ্জ ফুঁড়ে নিমেষে শুষে নেয় রক্ত! কে সে? ভূত নাকি প্রেতের বেশে কোনও ঘৃণ্য অপরাধী? প্রাক-ইন্টারনেট যুগেও সস্তা থ্রিলারের মোড়কে গড়ে তোলা এই ‘ভৌতিক’ দাপাদাপি ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি।
এমনই কত। একটা লেখায় আর ক’টা প্রসঙ্গ তোলা যায়? তবে উনবিংশ শতাব্দীর একটা ঘটনার কথা বলতেই হয়। ‘হুজুকে কলকাতা’-র এক আশ্চর্য ছবি আমরা ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় পাই। আচমকাই রটে গেল সেবছরের ১৫ কার্তিক, রবিবার, বিগত দশ বছরের সমস্ত মৃত মানুষ আবার নাকি ফিরে আসবেন পৃথিবীতে। চলতি কথায় ‘মরাফেরা’। খোদ নদিয়ার রামশর্মা আচার্যের মতো লোক নাকি বলেছেন একথা। ব্যাস! শহরময় আর কোনও কথা নেই। কেবল মৃতের মর্ত্যে আগমনের গুঞ্জন। নিমতলা, কাশী মিত্রের ঘাটে লাইন পড়ে গেল ১৫ কার্তিক। একবুক উৎকণ্ঠা, রোমাঞ্চ আর প্রতীক্ষা জমে উঠল শ্মশান চত্বরে। বলাই বাহুল্য, কেউ আসেনি। দিনটি পেরিয়ে যাওয়ার পরে তবে ভুল ভাঙে।
সময় পেরিয়েছে। এক গুজবের ভুল থেকে অন্য গুঞ্জনের ভুলভুলাইয়ায় ঢুকে পড়েছি আমরা। যুগের পর যুগ পেরিয়েছে। কিন্তু ‘গুজবে কান দেবেন না’ ও ‘গুজব ছড়াবেন না’, এই দুই আপ্তবাক্য আজও হজম হয়নি। কেবল তৃতীয় বিশ্বকে দোষ দিয়ে লাভ নেই কিন্তু। তথাকথিত প্রথম বিশ্বেও ইউএফও, মথম্যান, লকনেস মনস্টার তথা ‘কন্সপিরেসি থিয়োরি’র ছড়াছড়ি। কাজেই গুজবের ‘ফাঁদ পাতা ভুবনে’। ধরা পড়াও বোধহয় অনিবার্য নিয়তিই হয়ে উঠেছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.