গৌতম ব্রহ্ম, নয়াদিল্লি: নোবেল জয়ের পর ‘সংবাদ প্রতিদিন’-কেই দূরভাষে প্রথম সাক্ষাৎকার দেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশে ফিরে বাংলা সংবাদমাধ্যম হিসাবে সেই ‘সংবাদ প্রতিদিন’-কেই প্রথম সাক্ষাৎকারের সুযোগ দিলেন। কথা ছিল মঙ্গলবার বিকেলে ইন্টারভিউ দেবেন। সময় এবং স্থান জানতে চেয়ে হোয়াটসঅ্যাপ করেছিলাম। সোমবার বিকেলে উত্তর এল। সন্ধে সাতটা, ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার। কিন্তু যেতে হবে এদিনই। হাতে মাত্র দেড় ঘণ্টা সময়। চাণক্যপুরীর বঙ্গভবন থেকে অ্যাপ ক্যাবে দিল্লির লোধি রোডের আইসিসিতে পৌঁছলাম। ঠিক সাতটা পাঁচে সিঁড়ি ভেঙে নিজেই রিসেপশনে নেমে এলেন। ব্ল্যাক প্যান্ট, তুঁতে রঙের শার্ট। ঈষৎ ঝুঁকে পড়া শরীর। মুখে মেধার বিচ্ছুরণ। উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে নিজেই নিয়ে গেলেন ৪৪ নম্বর ঘরে। এটাই নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদের দিল্লির ঠিকানা। ফ্লাস্কে ব্ল্যাক টি বানিয়ে খাওয়ালেন। নিজে অবশ্য গ্লাসে ঢেলে নিলেন গরম জল। গলা পুরোপুরি চোকড। আওয়াজ বেরোচ্ছে অনেক কষ্টে। রবিবার ডাক্তারের কাছেও গিয়েছিলেন। রেকর্ডার অন করলাম। মোদি থেকে মমতা। আরএসএস থেকে নির্মলা সীতারমণ। রশিদ খাঁর কিরওয়ানি। জেএনইউ থেকে প্রেসিডেন্সি। সবই খোলসা করলেন ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর সামনে। ১০ মিনিট সময় বরাদ্দ ছিল। প্রায় পঁচিশ মিনিট সাক্ষাৎকার দিলেন। ইনি এক অচেনা অভিজিৎ।
‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর পক্ষ থেকে আপনাকে আরও একবার নোবেল জয়ের জন্য অভিনন্দন। অবশ্যই এত ব্যস্ততার মধ্যে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
সংবাদ প্রতিদিন: আপনার পুওর ইকোনমিক্সে আধপেটা খাওয়া মানুষের টিভি কেনার গল্প আছে। দ্বিতীয় বই গুড ইকোনমিক্স ফর হার্ড টাইমস আজ প্রকাশ হচ্ছে। এখানেও কি তেমন কোনও গল্প, চমক?
অভিজিৎ: এখানে গল্প একটু কম রয়েছে। আমাদের গবেষণার বিষয় নয়, এমন অনেক কিছুকে টেনে আনা হয়েছে। এখানে অন্য গবেষকদের অভিজ্ঞতাকে আমরা বেশি মলাটবন্দি করেছি।
সংবাদ প্রতিদিন: বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে। নোবেল জয়কে এর আগে কেউ এভাবে ব্যাখ্যা করেনি। বাংলার প্রতি আপনার অনুরাগ অনুকরণযোগ্য। অথচ ইদানীং বাংলা ভাষার একটা অদ্ভুত দারিদ্র চোখে পড়ছে। নতুন প্রজন্মকে কী বলবেন?
অভিজিৎ: আমার জীবনে অনেক কিছু আছে, যেগুলো আমি বাংলায় বলতে পারব না। যেমন র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল নিয়ে টেকনিক্যাল লেকচার বাংলায় দিতে পারব না। আবার বাংলায় বই পড়া আমার পক্ষে অনেক সহজতর। অনেক বেশি ভাল লাগার। নতুন প্রজন্ম কম্পিউটারে এক ভাষা ব্যবহার করে। বান্ধবীর সঙ্গে আরেক ভাষায় প্রেম করে। এই ফারাকটা থাকবেই। আসলে ভাষার মজাটা পেতে হবে। ফুটিয়ে তুলতে হবে। বাংলায় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে হবে। বাংলা বলুন বাংলা বলুন বললে হবে না। যারা বলছেন, তাঁদের নিজেদের দৃষ্টান্ত হতে হবে।
সংবাদ প্রতিদিন: ফুটবল নিয়ে আপনার আগ্রহের কথা শুনেছি। আপনি ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের ভক্ত। ময়দানে বাঙাল-ঘটির দ্বৈরথ কতটা উপভোগ করেন?
অভিজিৎ: মোহনবাগান ক্লাব আমাকে আজীবন সদস্যপদ দিতে চেয়ে মেল পাঠিয়েছে। আমি উত্তর দেওয়ার সাহস পাইনি। খুব ছোটবেলায় আমি মোহনবাগান সাপোর্টার ছিলাম। আমার থেকে দু’বছরের বড় এক পিসতুতো দাদা ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার ছিল। দু’বছর আগে মারা গিয়েছে। ও-ই আমায় ভুলিয়ে ভালিয়ে পরে ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার করে দেয়। সুতরাং আমি নিজেকে নির্ভেজাল মোহনবাগানি বলতে পারব না।
সংবাদ প্রতিদিন: নিম্নবিত্ত পরিবারের অনেকের সঙ্গেই আপনার সখ্য ছিল। আপনি ঝুপড়িবাসীদের সঙ্গেও খেলেছেন। দারিদ্রকে কাছ দেখা শৈশবেই। মহানির্বাণ মঠ রোডের সেই দিনগুলোর কোনও স্মৃতি?
অভিজিৎ: বাড়ির সামনে রাস্তায় গুলি, ডাংগুলি, চু-কিতকিত খেলেছি দীর্ঘদিন। কখনও ওদের সোশ্যাল ক্লাস ভাবার অবসর ছিল না। খেলাটাই ছিল মুখ্য। হয়তো দারিদ্র নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে সেই সময়ই আমার তৈরি হয়েছিল। আমি বিভিন্ন জায়গায় সেই কথা বলেওছি। আমার আসলে অন্য মানুষ, অন্যরকম জীবনের প্রতি আগ্রহ বরাবরের। কিছু বাচ্চা স্কুলে যায় না, আমি রোজ স্কুলে যাই, বিষয়গুলো ভাবাত।
(ঘরে আলো কম থাকায় ইন্টারভিউ থামাতে হল। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে ফের শুরু হল কথোপকথন। সেই ফাঁকে নিজের প্রথম বই পুওর ইকোনমিক্স ও সংবাদ প্রতিদিন-এ প্রকাশিত তাঁর নোবেল পাওয়ার খবরে অটোগ্রাফ দিলেন অভিজিৎ।)
সংবাদ প্রতিদিন: গণিত এবং অর্থনীতি- দুটো প্রবেশিকাতেই আপনি প্রেসিডেন্সিতে প্রথম হয়েছিলেন। গণিত ছেড়ে কেন অর্থনীতি?
অভিজিৎ: কারণটা আমার বাবা। তিনি বেঁচে নেই, তাই বলছি। উনি তখনকার প্রেসিডেন্সির গণিত বিভাগ প্রসঙ্গে খুব একটা উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন না। সরাসরি না বললেও ওঁর আলোচনা শুনে সেটা বুঝেছিলাম।
সংবাদ প্রতিদিন: চাইলে আপনি নাকি ভুবনবিখ্যাত শেফ হতে পারতেন। আপনার রান্নার সুখ্যাতি নোবেলজয়ের খবরের মতোই ছড়িয়ে পড়েছে। নিজে কোনও রেসিপি আবিষ্কার করেছেন? আমিষ না নিরামিষ? কোনটা বেশি পছন্দ?
অভিজিৎ: হ্যাঁ, আমি রান্না করতে ভালবাসি। বিভিন্ন সবজি নিয়ে রাঁধতে গিয়ে নতুন পদ তৈরি করেছি। কিন্তু সেটা ঠিক আবিষ্কার বলা যায় না। যাঁরা রান্নার বই লেখেন, তাঁরাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মশলা কমিয়ে-বাড়িয়ে নতুন পদের জন্ম দেন। রাঁধতে রাঁধতেই শেফরা নতুন কায়দা রপ্ত করেন। আমি আমিষ, নিরামিষ, মিষ্টি- সবই রান্না করি। তবে মিষ্টিটা একটু কম।
সংবাদ প্রতিদিন: আপনার মা আপনার তৈরি হালুয়ার ভক্ত। এবার কলকাতায় গিয়ে হেঁশেলে ঢুকবেন?
অভিজিৎ: এবার আর সময় পাব না।
সংবাদ প্রতিদিন: আপনি গান ভালবাসেন। নাচের ব্যাপারেও আপনার বেশ সুখ্যাতি আছে। ওস্তাদ রাশিদ খাঁর গান আপনি বিশেষভাবে পছন্দ করেন।
অভিজিৎ: আমি শাস্ত্রীয় সংগীত খুব ভালবাসি। বিশেষ করে উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত। অনেকে টেকনিক্যাল বিষয়ের উপর বেশি জোর দেন। আবার অনেকের পিওর মিউজিক্যালিটি আছে। রাশিদ খাঁ গান ধরলেই দু’-তিন সেকেন্ডের মধ্যেই রাগটা চিনে ফেলা যায়। এটা আমার কাছে ভীষণ আশ্চর্য লাগে। প্রত্যেকটা রাগের একটা ইমোশনাল প্রোফাইল আছে। ভাল গায়ক হলে তিনি দেড় মিনিটের মধ্যেই রাগ চিনিয়ে দেবেন।
সংবাদ প্রতিদিন: রাশিদ খাঁর কাছে কোন রাগ শুনতে চাইবেন?
অভিজিৎ: অবশ্যই কিরওয়ানি রাগ শুনতে চাইব। ওঁর গলায় অসম্ভব সুন্দর লাগে। সুযোগ পেলে ওঁর রেওয়াজও শুনতে চাইব।
সংবাদ প্রতিদিন: নাচ নিয়ে বলুন।
অভিজিৎ: হ্যাঁ, আমি নাচতে ভালবাসি। বলিউড মিউজিক থেকে বিদেশি পপ মিউজিক। পা মেলাতে ভাল লাগে। তবে সাংঘাতিক কিছু নাচি না। খুব শক্ত নাচ হলে পারব না।
সংবাদ প্রতিদিন: আরএসএস নিয়ে আপনার কোনও ছুঁৎমার্গ? জেএনইউ-তে পড়ার সময় আপনি আরএসএস করা এক সহপাঠীর নম্র ব্যবহারের ভক্ত ছিলেন। নির্মলা সীতারমণও আপনার সহপাঠী ছিলেন। তাঁরও প্রশংসা করেছেন।
অভিজিৎ: নির্মলা অনেকটা আমার মতো পরিবার থেকেই এসেছিলেন। ওই সময় আমাদের ক্লাসে বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা পড়ুয়া ছিল। এর মধ্যে আমায় বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল এভিবিপি করা একটি ছেলে। সে অত্যন্ত মার্জিত। কথাবার্তা অত্যন্ত সুন্দর। হিন্দিটা খুব ভাল বলত। আরএসএস নিয়ে আমার কোনও ছুঁৎমার্গ নেই। সবার সঙ্গেই আমি আলোচনায় বসতে রাজি আছি। অকারণ চেঁচামেচি করলে নেই।
সংবাদ প্রতিদিন: মোদিজির সঙ্গে আপনার মঙ্গলবার দেখা হচ্ছে। কী বলবেন?
অভিজিৎ: উনি যখন ডেকেছেন, উনিই বলবেন। আমি শুনব।
সংবাদ প্রতিদিন: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আপনার সহযোগিতা চেয়েছেন। কী বলবেন?
অভিজিৎ: পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে আমরা আগেও কাজ করেছি। রাজনীতির ভিত্তিতে কোনও বৈষম্য করতে আমরা রাজি নই। মোদিজি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন গুজরাতে কাজ করেছি। এখন হরিয়ানায় খট্টর সরকারের সঙ্গে করছি। এতে আমাদের কোনও সমস্যা নেই। সরকার যদি বিভিন্ন প্রকল্প সফলভাবে কার্যকর করতে পারে, তার চেষ্টা করাটাই আমাদের কাজ। অমুক পার্টির সরকারের কাজ করব, তমুক পার্টির সরকারের কাজ করব না, এমন চিন্তা প্রথম থেকেই বাতিল করেছি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.