সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: জাতীয় রাজনীতি এমন দৃশ্যের সাক্ষী শেষ কবে দেখেছে তা ভেবে পাচ্ছেন না অনেকেই। রাজনীতিতে দলবদলের খেলা চলে। নেতাদের রং বদলে যায়। কিন্তু কেউ কেউ থেকে যান, ব্যক্তিগত দক্ষতায় যাঁরা দল ও ব্যক্তিকে সমার্থক করে তুলতে পারেন। প্রণব মুখোপাধ্যায় ও জাতীয় কংগ্রেস বিগত কয়েক দশক ধরে এক যোগসূত্রে বাঁধা। সেই প্রণববাবু বসে আছেন সংঘের মঞ্চে, তাও মোহন ভাগবতের পাশে। পুরনো কংগ্রেসীরা এ দৃশ্য কল্পনাই করতে পারেননি। এমনকী প্রণবের একান্ত অনুগত ভক্তরা, যাঁদের অবস্থান হয়তো অন্য কোনও দলে, তাঁরাও মেনে নিতে পারেননি। সংঘের মঞ্চে অবশ্য সত্যিকার ভারতবর্ষকেই তুলে ধরলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি।
আরএসস শুধু হিন্দুদের নয়। বহুত্ববাদের পক্ষে সওয়াল করেই অনুষ্ঠানের নান্দীমুখ করলেন সরসংঘচালক মোহন ভাগবত। সম্ভবত তিনি জানতেন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বক্তৃতার অভিমুখ ঠিক কোন দিকে। তাই গোড়াতেই দেশের বৈচিত্র, বহুমতের কথা শোনা গিয়েছিল তাঁর মুখে। বলেছিলেন, সরকার একা সবকিছু ঠিক করতে পারে না। বদল যদি কেউ আনতে পারে তবে তা সাধারণ মানুষ। প্রত্যেকের ভাবনাই বদলে দিতে পারে দেশের চেহারা। ভারত ভাগ্যবিধাতা তাই একমাত্র জনগণই। সংসদীয় গণতন্ত্রের এটাই তো মূল কথা। মোহন ভাগবত যখন এ কথা বলছেন, তখন পাশে বসে নিবিষ্ট মনে তা শুনছেন সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধি গুলে খাওয়া প্রণববাবু। রাজনীতির ছোট ছোট সিঁড়ি পেরতে পেরতে যিনি দেশের প্রথম নাগরিকও হয়েছিলেন, তাঁর কাছে তো এসব অজানা কিছু নয়। তবে তিনি এও জানেন, কথায় ও কাজে বিস্তর ফারাক হয়ে যায়। তত্ত্ব ও বাস্তবের মধ্যে থেকে যায় আকাশ এবং পাতাল। এদিনের বক্তৃতায় তাই বহু মাত্রা ছুঁয়ে গেলেন তিনি। হয়তো সংঘের সদস্যদের সামনে ভারতবর্ষের সনাতন রূপটি তুলে ধরাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।
[ স্ত্রীর ডেবিট কার্ড ব্যবহার করতে পারবেন না স্বামী, ব্যাংকের নিয়মে সায় আদালতেরও ]
কী সেই সনাতন ভারতবর্ষ? যেখানে ঠাঁই নেই গোঁড়ামি, ঘৃণা, অসহিষ্ণুতার। ভারতের ইতিহাসে ধর্ম বা অন্য কোনও মেরুকরণের উপর ভিত্তি করে বারবার আক্রমণ এসেছে। কিন্তু এক জাতি হিসেবে ভারত তা প্রতিহত করেছে। এই শক্তি এল কোথা থেকে? প্রণববাবু নজর ফেরাচ্ছেন বহুত্বের ইতিহাসে। যে বৈচিত্র ভারতকে সবার থেকে আলাদা করেছে, আবার স্বতন্ত্রভাবেই এক করে রেখেছে। এদিন তাঁর বক্তৃতার আনুষ্ঠানিক বিষয় ছিল জাতি ও জাতীয়তাবাদ। আসলে তিনি তুলে ধরলেন ভারত ইতিহাসের রূপরেখা। এই তো সেই ভারত যেখানে মেগাস্থিনিস থেকে হিউয়েন সাঙ এসে দেশের প্রশাসনকি ব্যবস্থার প্রশংসা করেছিলেন। এই তো সেই ভারত যা হাজার বছর আগেও গোটা বিশ্বের কাছে ছিল শিক্ষাকেন্দ্র। এই তো সেই ভারত, যে ভারতকে দেখে কবিগুরু বলেছেন কতজনের আসার কথা। এক দেহে লীন হয়ে যাওয়ার কথা। এই বহুত্বই ভারতের শক্তি। ইউরোপীয় রাষ্ট্রের ধারণা জন্ম নেওয়ার আগেই ভারতেই বহুমাত্রিক সভ্যতা বিকশিত। আজ দেশের সামনে সেই সনাতন ভারতকে তুলে ধরলেন তিনি। তাঁর কাছে তাই জাতীয়তাবাদ ভাষা বা জাতির মধ্যে আবদ্ধ নয়। পণ্ডিত নেহেরুর কথা ধার করে তিনি বলেন, জাতীয়তাবাদ হল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বহুমতের মিশ্রণ বা সমণ্বয়। কিন্তু তার একটা নির্দিষ্ট অভিমুখও থাকবে। সময় বদলেছে। কিন্তু ভারতের এই মূলচরিত্র বদলায়নি।
I am here amongst you to share my understanding with you of the concepts of nation, nationalism and patriotism in the context of India: Dr Pranab Mukherjee at RSS’s Tritiya Varsh event in Nagpur pic.twitter.com/2muh81g6JZ
— ANI (@ANI) June 7, 2018
তিনি বলেন, ভারতের আত্মা এই বহুমতের মধ্যেই বাস করে। সামাজিক সংস্কৃতির বুনন যখন কেউ বানচাল করতে উদ্যত হয়, হিংসা যখন বেড়ে যায়, যখন শিশু বা নারীকে নিগ্রহের শিকার হতে হয়, তখন লাঞ্ছিত হয় ভারতের সেই আত্মা। ক্রোধ, ঘৃণা, বিভেদ থেকে আমাদের পৌঁছাতে হবে শান্তি ও সংহতিতে। তরুণ সংঘ সদস্যদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, শান্তির পক্ষে থাকুন, আমাদের মা-ভূমি এখন এটাই চাইছে। এটাই দেশের কামনা। দেশ অর্থনীতিতে এগিয়েছে। কিন্তু হ্যাপিনেস ইনেডেক্সে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। এই পরিস্থিতি বদলানোর ডাক দেন তিনি। আধুনিক সরকারের ধারণা, বাই দ্য পিপল অফ দ্য পিপল ফর দ্য পিপল-এর জন্ম হওয়ার আগেই, কৌটিল্য মানুষকে সবার উপরে রেখেছিলেন। এদিন সে কথা স্মরণ করিয়ে দেন প্রণববাবু। প্রকারন্তরে দেশের শাসনে থাকা শক্তিকেই যেন রাজধর্মের মূল বার্তা স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।
Our national identity has emerged after a long drawn process of confluence and assimilation, the multiple cultures and faiths make us special and tolerant: Pranab Mukherjee at RSS’s Tritiya Varsh event in Nagpur pic.twitter.com/CbRNQ7QYyx
— ANI (@ANI) June 7, 2018
দেশের কথা বলতে গিয়ে সময় অনেকটা পেরিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সময়ের নাড়িই এদিন ছুঁয়ে গিয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর বক্তৃতার আগে বিস্তর টুইট যুদ্ধ চলেছে। কংগ্রেসীরা তো রীতিমতো রেগে গিয়েই প্রণবের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করেছেন। কিন্তু এদিন প্রণব বুঝিয়ে দিয়েছেন, যে ভারতের কথা তুলে ধরেছেন তিনি, সেই ধর্মনিরপেক্ষ-বহুত্ববাদের ভারতের কথাই আজও ঘুরেফিরে বলে চলেছে কংগ্রেস। গোঁড়ামি, ধর্মভিত্তিক বিভাজনের বিরুদ্ধে এই প্লুরালিটিই শতাব্দীপ্রাচীন দলটির আশ্রয়। সংঘের তরুণদের সামনে সেই সনাতন ঐতিহ্যের স্মারকটি তুলে ধরলেন প্রণববাু। যা হয়তো রাজনৈতিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব হত না। ভাষণ শেষে তাই অনেকেই বলছেন, এই জন্যই তিনি চাণক্য। বলেই তো ছিলেন, যা বলার নাগপুরে বলব। যা বলার বলেও দিলেন। এখন শুধু কংগ্রেসের গোঁসা কাটলেই হয়। এরপর প্রণবকে আক্রমণের অর্থ, সনাতন ভারত নিয়ে রাজনীতি করতে নামা। কংগ্রেস নিশ্চয়ই এতবড় ভুল করবে না।আর যদি তা হয়, তাহলে বুঝতে হবে চাণক্যও এ যাত্রা বাঁচাতে পারলেন না কংগ্রেসকে।
#WATCH Former President Dr Pranab Mukherjee speaking at RSS’s Tritiya Varsh event, in Nagpur https://t.co/REkQkhbYLG
— ANI (@ANI) June 7, 2018
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.