সুমিত বিশ্বাস, তামাড় (ঝাড়খণ্ড): দু’হাতে আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে দক্ষ। শতাধিক মামলা তাঁর বিরুদ্ধে। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালানো ছিল তাঁর বাঁয়ে হাত কা খেল। একসময় বাংলা-ঝাড়খণ্ড পুলিশের ত্রাস মাওবাদী নেতাকে জালে আনতে ১৫ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে পরে তিনি আত্মসমর্পণ করে ফিরে আসেন সমাজের মূল স্রোতে। সেই কুন্দন পাহানই এখন ঝাড়খণ্ডের ভোটের ময়দানে। বিচারাধীন বন্দি হিসেবে কারাগার থেকেই তামাড় কেন্দ্র থেকে ঝাড়খণ্ড পার্টির হয়ে ভোটে লড়ছেন।
পাতলা ছিপছিপে চেহারা। হালকা গোঁফের লম্বাটে মুখের কুন্দন পাহানকে তামাম ঝাড়খণ্ডবাসী নামে চিনলেও চোখে দেখেননি অধিকাংশ মানুষই। কিন্তু তাঁর হয়ে ভোটের প্রচারে হাজার হাজার অনুগামী। শহর থেকে গ্রামে ঘুরছে প্রচার ভ্যান। রাঁচি জেলার তামাড় বিধানসভার প্রেমনগরের মত অজ পাড়া গাঁয়েও তাঁর নামে ব্যানার। প্রতীক – ফলভরতি ঝুড়ি। ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগ জেলে থেকেই ভোটে লড়াই চলছে তাঁর। বুন্ডু শহরে জামশেদপুর–রাঁচি ৩৩ নম্বর জাতীয় সড়কে তাঁর দলের বড় কার্যালয়ের পাশে পেল্লাই সাইজের হোর্ডিং। আলো ঝলমলে সেই নির্বাচনী কার্যালয় ভোটের আগের দিনও গমগম করছে।
বৃহস্পতিবার এই দফার প্রচার শেষ, তবু চলছে হুইস্পারিং ক্যাম্পেন। মুহূর্মুহূ স্লোগান উঠছে, “অবুওা দিশুম, অবুওা রাজ, বাটন টিপ কুন্দনকে পাশ”। প্রাক্তন মাওবাদী নেতা কুন্দন পাহানকে ভোটে লড়াইয়ের অনুমতি দিয়েছে এনআইএ–র বিশেষ আদালত। কিন্তু কয়েকদিন আগেই এই বিধানসভায় তাঁর খাসতালুক খুঁটি জেলার আঁড়কি থানা এলাকাতেও তাঁর বিরুদ্ধে পোস্টার দেয় মাওবাদীরা। যার বয়ান ছিল, “গদ্দার কুন্দন পাহান ভোট চাইতে এলে তাকে লাথি মেরে তাড়াও।” কিন্তু ঝাড়খণ্ড পার্টির কার্যকর্তারা মনে করছেন, প্রান্তিক জনজাতিকে বিভ্রান্ত করতে ওই পোস্টার ছিল বিরোধীদের চক্রান্ত। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস না থাকলেও এই ভোটে ‘মাওবাদী’রা কুন্দন পাহানের পাশে রয়েছেন।
কিন্তু টানা ১৭ বছর জঙ্গলে থেকে যে মাওবাদী নিজেই ভোট বয়কটের ডাক দিয়ে নির্বাচনে নাশকতার ছক কষে, সেই কমান্ডারই আজ ভোটের ময়দানে এলেন কীভাবে? জবাব দিলেন ঝাড়খণ্ড পার্টির এক কার্যকর্তা তথা কুন্দন পাহানের বাল্যবন্ধু অজয় চৌধুরি। তাঁর কথায়, “জঙ্গলে থেকে তিনি যে প্রান্তিক মানুষজনের লড়াই করছিলেন, এখন তাঁদের হয়ে লড়াই করতেই কুন্দন ভোটে প্রার্থী হয়েছেন। এখানকার ভোটাররা তাঁকে চেহারায় না চিনলেও নামে চেনেন।” আঁড়কি থানার বারিগাড়া গ্রামে বাড়ি কুন্দন পাহানের। আজ থেকে উনিশ বছর আগে সমাজ বদলের স্বপ্ন নিয়ে সিপিআই (মাওবাদী) সংগঠনে নাম লেখান। তারপর একের পর এক নাশকতা, মন্ত্রী-সাংসদকে খুন, ব্যাংকের ক্যাশ ভ্যান থেকে টাকা–গয়না লুঠ করে বাংলা–ঝাড়খণ্ড পুলিশের কাছে হয়ে গিয়েছিলেন ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’। তারপর ২০১৭ সালের ১৪ মে তিনি আত্মসমর্পণ করেন। ঝাড়খণ্ডের ‘সারেন্ডার পলিসি’ অনুযায়ী, তাঁর মাথার দাম ১৫ লক্ষ টাকা হাতে পেলেও, ঠিকানা হয় হাজারিবাগের জেলে। সেখান থেকেই তামাড় কেন্দ্রের ভোটে ইভিএমের আট নম্বরে উঠে এসেছেন কুন্দন পাহান।
এদিকে, ঝাড়খণ্ডে দ্বিতীয় দফা ভোটের ৪৮ ঘন্টা আগে বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমানা যেন কাশ্মীর। সীমানা সিল করে ওয়াকিটকিতে দু’রাজ্যের পুলিশের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদান চলছে। পাহাড় বরাবর জঙ্গল এলাকায় চলছে তল্লাশি অভিযান। পুরুলিয়ার বলরামপুর–বাঘমুন্ডি সড়কপথে দুয়ারসিনি মোড় থেকে ডানদিকে ঝাড়খণ্ডের ইচাগড়ের পথ ধরতেই দেখা গেল মাঠা বনাঞ্চলে বালির বস্তা দিয়ে দু’দুটি বাঙ্কার তৈরি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর ৮ জওয়ান এলএমজি, AK 47 নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে। সমস্ত ছোট-বড় গাড়ি, সাইকেল আরোহী বা পথচারীকে রীতিমত দাঁড় করিয়ে তল্লাশি চলছে। মাওবাদী নাশকতা রুখতেই এমন অতন্দ্র প্রহরা, জানাচ্ছে প্রশাসন।
ছবি: অমিত সিং দেও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.