ভাস্কর লেট: ‘নিউটন’ সিনেমার পরিচালক অমিত ভি. মাসুরকর আজ চওড়া করে হাসতেই পারেন। সাধারণতন্ত্র দিবসেই যে দেশের ভূতপূর্ব নির্বাচন কমিশনার তারিফ করে তাঁর সিনেমার রেফারেন্স দিয়েছেন একমেলা লোকের সামনে!
শনিবারের ‘জয়পুর লিটারারি ফেস্টিভ্যাল’ বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে চমৎকার যুগলবন্দিতে এগোল। সকালের দিকে বক্তব্য রাখলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক রাজদীপ সরদেশাই। আর, পড়ন্ত বেলায় প্রাণ খুলে কথা বললেন ভূতপূর্ব নির্বাচন কমিশনার নবীন চাওলা। দু’জনের আলাপেই প্রবলভাবে অস্তিত্বময় হয়ে উঠল সাধারণতন্ত্র দিবসের উপলক্ষ ও তাৎপর্য।
২০১৭, ২০১৮। পরপর এই দু’বছর ‘জেএলএফ’ আসার অভিজ্ঞতায় একটা বিষয় নিশ্চিত করে বলতে পারি, এখানে সামঞ্জস্যের অভাব সচরাচর ঘটে না। আর, বিষয়ের বৈচিত্র স্বতঃই ধরা দেয়। নির্ভেজাল সাহিত্যের সমাবেশ হিসাবে জেএলএফ নাম কিনতে চায়নি। সমাজ ও গণতন্ত্রের বুক ছ্যাঁদা করে যেসব রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিরন্তর চলাচল করে, জেএলএফ তাদেরও হাজির করতে চায় জনতার দরবারে।
সদ্য রাজস্থানে সরকার বদলেছে। যার প্রতিফলন ঘটেছিল এবারের জেএলএফের প্রথম দিনে। হাজির হয়েছিলেন শচীন পাইলট, রাজ্যের বর্তমান উপমুখ্যমন্ত্রী। পরিবর্তিত রাজস্থানে, রাজদীপ সরদেশাই কী বলেন তা জানতেও কৌতূহলের বাতাস চনমনে হয়ে উঠেছিল।
কর্তৃপক্ষের বিচক্ষণতার প্রশংসা করতে হবে। সাধারণতন্ত্র দিবসে রাজদীপের সঙ্গে কথার বলার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় মধু ট্রিহানের উপর। যিনি ‘ইন্ডিয়া টু ডে’ ম্যাগাজিনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং আরেকজন দিকপাল সাংবাদিক অরুণ পুরীর বোন। হতে পারে পূর্বপরিচিত, কিন্তু প্রশ্ন করার সময় মধু যথেষ্টই সাহসী হলেন। রাজদীপ সারদেশাইয়ের উদ্দেশ্যে ধাবিত হল এমন সব আউটসুইং, যা যেচেপড়ে ছেড়ে দিলে মুখ পোড়ার আশঙ্কা, আর ভুল ব্যাকরণের সঙ্গে খেললে পতন অনিবার্য। তিনি বস্তুত চেয়েছিলেন রাজদীপকে কথা বলাতে। অন্দরমহলের অন্ধকার থেকে যা সত্য, তা আলোয় আনতে। রাজদীপ তুখড় বক্তা। সুযোগের অসদ্ব্যবহার করেননি।
[ আপনি ভাল আছেন? আমরা ভাল নেই… ]
একসময় (১৯৮৮) ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ গ্রুপের মুম্বই সংস্করণের সিটি এডিটর ছিলেন রাজদীপ। কেন তাঁকে সরে আসতে হল? এর জন্য কি পাবলিশার সমীর জৈনের ‘পেড নিউজ পলিসি’ কোনওভাবে দায়ী? ‘এনডিটিভি’ লোকরণ্যে জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম ‘এক্স ফ্যাক্টর’ রাজদীপ সরদেশাই স্বয়ং। পরে বেরিয়ে তিনি ‘সিএনএন আইবিএন’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু ক্রমে সেখান থেকেও নিষ্ক্রান্ত হন। কেন? এক্ষেত্রে কি অবুর্দপতি শিল্পবণিক মুকেশ আম্বানির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অবদান ছিল?
মধুর দু’টি প্রশ্নেই হাততালির ঝড় ওঠে। যদিও রাজদীপ এমন কোনও মন্তব্য করেননি যা বিশেষভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সমীর জৈনর ‘পলিসি’কে তিনি বরং অভিনন্দিত করেন এই বলে যে, ১৯৯৪ সালের আগে পেড নিউজের কোনও কনসেপ্ট ভারতে ছিল না। জনগণ কী চাইছে, সেই রুচি ও চাহিদা নির্মাণ করার প্রশ্নে সমীর জৈন যে দূরদর্শিতা এবং অভিনবত্ব দেখিয়েছিলেন- পরে সংবাদমাধ্যম সেদিকেই ঝুঁকে পড়েছিল। এখানে, রাজদীপ কথাচ্ছলে নিজেকে ‘আরশোলা’ বলে অভিহিত করেন। তাঁর মতে, আমি ছিলাম বিরাট সিস্টেমের ভিতরে হেঁটে বেড়ানো একটি আরশোলা। সেই আরশোলাটি আজও সিস্টেমে রয়ে গিয়েছে। এবং আজও সে বিশ্বাস করে, সাংবাদিকের প্রধান ও একমাত্র কাজ সংবাদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা। সমীর জৈনের জায়গায় আমি থাকলে আমি অন্যরকম করে ভাবতাম। কিন্তু আসলে তো আমি ওঁর জায়গায় নেই!
আর মুকেশ আম্বানির প্রসঙ্গে রাজদীপের মন্তব্য ছিল, ‘বিষয়টা আমিই তো ভাল করে জানি না। এইভাবে সাধারণের হাটে বলব কী করে?’ মধু ট্রিহানকে বরং তিনি অনুরোধ করেন, প্রশ্নটি মুকেশ আম্বানিকেই জিজ্ঞাসা করতে।
এরপর রাজদীপ সরদেশাই প্রবেশ করেন দেশজুড়ে বইতে থাকা অসহিষ্ণুতা ও বিরুদ্ধ-স্বর চেপে দেওয়ার সাইক্লোনিক বিষয়টিতে। তাঁর মতে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্রমশ কুণ্ঠিত হচ্ছে। ‘আমরা বনাম ওরা’র বিভাজনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ‘খবরের মান’। সাংবাদিক যদি ক্ষমতাসীনের অনুকূলে কথা বলে, তাহলে যে ফল পাওয়া যায়, ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বললে বিপরীত ফল মেলে। আসলে, যারা ক্ষমতায় আছে তাদের সঙ্গে বিরোধীদের আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক আজ তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে। সংবাদমাধ্যম সেই অচলাবস্থারই শিকার। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি যদি খারাপ হয়, তাহলে সংবাদমাধ্যমের বলা উচিত, পরিবারতন্ত্রের রাজনীতিও খারাপ। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপর হওয়া অত্যাচার যতটা খারাপ, শিখনিধন যতটা ঘৃণ্য, গুজরাত কাণ্ডও ততটাই সংবাদমাধ্যমের সরব প্রতিবাদ দাবি করে।
এদিনের আলোচনাতেও আলোকপাত করেছিল ‘ন্যাশনালিজম’ বিতর্ক। রাজদীপের স্পষ্ট অবস্থান- কে বলেন একজন ডাক্তার বা স্কুলমাস্টারের চেয়ে একজন সৈনিক বেশি জাতীয়তাবাদী? সেনাবাহিনীতে দুর্নীতি আছে কি নেই এটা জানতে চাইলেই একজন বুঝি ‘দেশদ্রোহী’ হয়ে যায়? তাঁর মতে, ভারতবাসী সরকারের চোখ দিয়ে দেশের অবস্থা বুঝতে চায়। হওয়া উচিত ঠিক উলটো। নিচ থেকে অর্থাৎ মানুষের চোখ দিয়ে সরকারের উচিত দেশের পরিস্থিতি কেমন তা অনুধাবন করা।
‘আপনি কী লেফট লিবার্যাল?’ মধু ট্রিহানের এই প্রশ্নের উত্তরে রাজদীপ সরদেশাই জানান- আমি একজন ইন্ডিয়ান লিবর্যাল। নানা ধরনের মত ও অবস্থান আমি সাদরে বরণ করতে চাই এবং তারপর নিজের চেতনার সাড়াতে আমি বেছে নিতে চাই আমার নিজের সামাজিক ও রাজনৈতিক অক্ষাংশ।
একজন দর্শক প্রশ্ন করেছিলেন রাজদীপকে- ‘ভারতরত্ন পাওয়ার জন্য প্রণব মুখোপাধ্যায়কে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন টুইটে। নানাজি দেশমুখ বা ভূপেন হাজারিকার নাম দু’টি বাদ দিলেন কেন?’ একগাল হেসে রাজদীপ বলেন, প্রণববাবু আমার বন্ধু। সেজন্যই টুইট করে সৌজন্যবার্তা দিয়েছি। তবে যদি আমার মত জানতে চান, তাহলে বলব, এইবার ‘ভারতরত্ন’ দেওয়া উচিত ছিল ভার্গিস কুরিয়েন এবং এম. এস. স্বামীনাথনকে। প্রথমজন ‘হোয়াইট রেভোলিউশন’ বা ডেয়ারি ডেভলেপমন্টের ‘জনক’। পরেরজন ‘সবুজ বিপ্লব’-এর হোতা।
২৬ জানুয়ারির শেষবেলার মিঠে রোদে ফ্রন্ট লনে আয়োজন করা হয়েছিল নবীন চাওলার ‘এভরি ভোট কাউন্টস’ বইটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের। পৌরোহিত্য করেন বরিষ্ঠ সাংবাদিক ও ‘দ্য হিন্দু’র ম্যানেজিং ডিরেক্টর এন রাম। তিনি জানতে চান, ‘এভরি ভোট কাউন্টস’ নাম রেখেছেন কেন বইয়ের? শুনতে ভাল বলে? না, এ কথার বৃহত্তর ব্যঞ্জনাও আছে?
[ পদচিহ্ন, পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রথম চৈতন্য সংগ্রহশালা শহরে ]
ভারতের ভূতপূর্ব নির্বাচন কমিশনার নবীন চাওলা উত্তরে একটি সত্যাশ্রয়ী গল্প বলেন। গুজরাটের গির জাতীয় উদ্যান সংলগ্ন এলাকায় নির্বাচন করাতে গিয়ে একবার স্থির হয়েছিল, বন্যপ্রাণীদের মুভমেন্ট ও আমজনতার নিরাপত্তার খাতিরে ওখানকার সবাইকে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে ভোট দেওয়ানো হবে। সকলে রাজি হলেও একজন পূজারি প্রস্তুত ছিলেন না অন্য কোথায় গিয়ে ভোট দিতে। মন্দিরের নিত্যপূজা উপেক্ষা করে যাওয়া সম্ভব নয়। এই ছিল ওঁর যুক্তি। তখন ওই একজনের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই আমরা নির্বাচনের সমস্ত বন্দোবস্ত করেছিলাম। যথারীতি সকাল ৮টায় শুরু হয়েছিল ভোটগ্রহণের কাজ। চলেছিল নিয়মমাফিক, বিকেল ৫টা অবধি।
এরপরই নবীন চাওলা সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, দেশের মাওবাদী এলাকায় বা প্রত্যন্ত গ্রামে বা পাহাড়ি জনপদে ভোট করানো দুর্গম কাজ। কিন্তু একটিও ভোট ফেলনা নয় বলেই নির্বাচন কমিশন প্রতিবার ভোট করিয়ে আসছে। আপনারা ‘নিউটন’ নামের সিনেমাটা ক’জন দেখেছেন?
প্রচুর হাত ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে। এবং তা অবলোকন করেই মুহূর্তের মধ্যে নবীন চাওলা বলেন, ‘ওইরকম নিউটনদের সুবাদেই এত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নির্বাচন করাতে পারি।’
অমিত ভি. মাসুরকর তাঁর ‘নিউটন’ সিনেমায় এমন একজন সরকারি আধিকারিকের প্রতিচ্ছবি এঁকেছিলেন। যে কর্তব্যে একনিষ্ঠ, সৎ। দায়িত্ব পালনে সে এতটাই প্যাশনেট যে আপনজানের পরোয়া অবধি করে না। প্রয়োজনে কঠোর হতে পারে। আরও প্রয়োজনে হতে পারে পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট।
সমাজে এই ধারার একগুঁয়ে, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানুষের সংখ্যা যত বাড়তে থাকবে, ততই ‘সৈনিকের দেশপ্রেমই সর্বসেরা’ বলার প্রবণতায় লাগাম পরবে। অদূরের কোনও এক প্রজাদিবসের সকালে আমরা হয়তো বা উচ্চকণ্ঠে গাইতেও পারব- ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে।’
ছবি : রোহিত পরশ জৈন
[ সাহিত্য জগতে নক্ষত্রপতন, প্রয়াত অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় ]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.