সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ”আমি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী বলিয়া অনেকে নির্দেশ করিয়া থাকেন। আমার বোধ হয় সে নির্দেশ অসংগত নহে।” একথা যিনি বলেছিলেন তাঁকে আপামর বঙ্গদেশ তো বটেই, গোটা দেশ কুর্নিশ করে। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (Ishwar Chandra Vidyasagar)। যে মানুষটির হাত ধরে বিধবা বিবাহ রদ রয়েছিল। বাল্যবিবাহের কুফল ও স্ত্রী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা তাঁর মতো করে কজনই বা বলেছেন! কিন্তু মহারাষ্ট্রের (Maharashtra) ধন্ড কেশব কার্ভের (Dhondo Keshav Karve) কথা কি বাঙালি মনে রেখেছে? বিধবা বিবাহের প্রচার থেকে শুরু করে সামগ্রিক ভাবে নারী কল্যাণে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ১০০ বছর বয়সে তিনি পেয়েছিলেন দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন। এও এক আশ্চর্য জীবন।
১৮৫৮ সালের ১৮ এপ্রিল মহারাষ্ট্রের রত্নগিরি জেলার শেরাবালি গ্রামের এক নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম মহর্ষি কার্ভের। চিৎপবন ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান তিনি। ১৮৮৪ সালে এলফিনস্টোন কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর অঙ্কের অধ্যাপনা করতে শুরু করেন পুণের ফার্গুসন কলেজে। ১৮৯১ সাল থেকে শুরু করে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ওই পেশায় ছিলেন। কিন্তু জীবনের প্রধান ফোকাস ছিল বিধবা বিবাহের প্রসার ঘটানো। নিজেও বিয়ে করেছিলেন এক বিধবা নারীকেই। দেশের প্রথম মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। এসএনডিটি উওমেন্স বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের সব মেয়ে শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী হয়ে উঠুক, এই ছিল তাঁর স্বপ্ন। সারা জীবনের এই কর্মকাণ্ড সত্যিই অবাক করে দেয়।
সবচেয়ে বড় কথা, কার্ভের জীবন ছিল নিতান্তই প্রতিকূলতায় ভরা। কিন্তু সেসবকে অবহেলা করে এভাবে অন্যের সেবায় জড়িয়ে পড়া বুঝিয়ে দেয় তাঁর হৃদয় ছিল নিখাদ সোনায় গড়া। মানবহিতৈষী, নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা এই মানুষটিকে এমনিই ‘মহর্ষি’ বলা হয় না। উচ্চশিক্ষার জন্য বম্বে (আজকের মুম্বই) আসার পর রীতিমতো কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছে। কিন্তু টলানো যায়নি তাঁর পুরুষকারকে। নিজের পড়ার খরচ চালাতে টিউশনি করেছেন। ডিগ্রি পাওয়ার পর টিউশনি ও বিচিত্র সব চাকরি করে গিয়েছেন। কিন্তু এত কষ্টে উপার্জিত অর্থের বড় অংশই দরিত্র পড়ুয়া ও অন্যদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। এই সময় মারা যান তাঁর প্রথম স্ত্রী। ভগ্ন হৃদয়েই প্রতিজ্ঞা করেন, গোটা জীবনটা মানবসেবাতেই কাটাবেন। বিশেষ করে নারী কল্যাণের লক্ষ্যেই ব্রতী হবেন। এই সময়ই ডাক পান পুণের ফার্গুসন কলেজে অঙ্কের অধ্যাপনা করার।
এখান থেকে জীবনটা অন্যদিকে বাঁক নেয়। কলেজে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন অচিরেই। আর বেতনও পাচ্ছিলেন ভালোই। ফলে মেয়ের বাবারা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হতে শুরু করলেন। কার্ভে বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন। এর পরই সিদ্ধান্ত, বিয়ে করলে কোনও বিধবাকেই করবেন। আসলে সমাজের আলোকিত মাঝে একটি আদর্শ তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত বন্ধু নরহরি পন্থের বিধবা বোন আনন্দী বাইকে বিয়ে করলেন।
এর ফল হল মারাত্মক। কেবল পুণে নয়, গোটা মহারাষ্ট্রে তোলপাড় পড়ে গেল। সমাজের বহু বিশিষ্ট জন তাঁকে সমর্থন করলেও সমালোচনাও হল প্রবল ভাবে। তাঁর নিজের গ্রামের একটা অংশ সামাজিক ভাবে তাঁদের পরিবারকে বয়কট করল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, এমন চরিত্রের মানুষদের এভাবে রোখা যায় না। গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে নারী ও বিধবাদের অবস্থার উন্নতির চেষ্টা করতে লাগলেন মহর্ষি।
পুণের কাছেই তৈরি হল অনাথ বালিকাশ্রম। বিদ্যাসাগরের মতোই তাঁর এই ‘উত্তরসূরি’টিকেও বার বার পড়তে হয়েছে বাধাবিপত্তির মুখে। কিন্তু তিনি সমালোচনা ও বাধাকে অতিক্রম করে দেশ ঘুরে অর্থ জোগাড় করতে লাগলেন। ১৯২৯ সালে চলে গেলেন বিদেশে। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান ঘুরে সংগ্রহ করলেন বিপুল অর্থ। কেবল অনাথ আশ্রম নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও পেলেন অনুদান। এই সময়ই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় আইনস্টাইনের।
বিংশ শতাব্দীর তিনের দশক থেকে সকলের কাছেই ‘মহর্ষি’ হয়ে উঠলেন কার্ভে। বহু প্রতিষ্ঠান তাঁকে সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদান করে। তথাকথিত নিচু জাতের মহিলাদের জন্যও তিনি যা করে গিয়েছেন তা অবিস্মরণীয়। ১৯৫৫ সালে সম্মানিত হলেন পদ্ম বিভূষণে। আর ১৯৫৮ সালে পেলেন ভারতরত্ন। সেই সময় তাঁর বয়স ‘মাত্র’ ১০০। কর্মযোগী এই মানুষের নামে পুণেয় প্রতিষ্ঠিত হয় কার্ভে নগর। পাশাপাশি বম্বের কুইন রোড হয়ে যায় মহর্ষি কার্ভে রোড। ৯ নভেম্বর ১৯৬২ সালে প্রয়াণ হয় তাঁর। ১০৪ বছর বয়সে। কিন্তু এমন মানুষদের কি সত্যিই মৃত্যু হয়? শারীরিক মৃত্যু তো অবধারিত। শতায়ু কার্ভেকেও চলে যেতে হয়েছিল। কিন্তু তাঁর আদর্শ, লড়াই ও প্রতিজ্ঞার জলছাপ থেকে গিয়েছে। যা অনুপ্রাণিত করেছে, করে চলেছে অসংখ্য মানুষকে।
১৯৭২ সালে একটি মারাঠি নাটক মুক্তি পায়। নাম ‘হিমলয়াচি সাভলি’। বসন্ত কানিৎকারের লেখা সেই নাটকের মূল চরিত্রে ছিল কার্ভেরই ছায়া। নানাসাহেব ভানু নামের চরিত্রটি আসলে মহর্ষিই। যে নাটকের ছত্রে ছত্রে ধরা রয়েছে সামাজিক জীবনে কত রকম অপমান ও অসহযোগিতায় পড়তে হয়েছে মানুষটিকে। ইতিহাসের পাশাপাশি এভাবে শিল্পেও ধরা রয়েছে কার্ভের লড়াই। তাঁর অনমনীয় জেদের সেই সব আখ্যান যেন লোককথার মতো জেগে রয়েছে আজও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.