Advertisement
Advertisement

Breaking News

গৃহীও ভাসে, সাধুও ভাসে, পুণ্যতোয়া এই গঙ্গে

গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোর আয়োজন এইভাবেই যেন ক্লান্তিহীন ও সর্বাত্মক হয়ে উঠেছে কুম্ভের আনাচেকানাচে।

Devotees throng Kumbh Mela
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:January 14, 2019 11:04 am
  • Updated:January 14, 2019 11:04 am  

ভাস্কর লেট, প্রয়াগরাজ:  গোটা দুয়েক পুরুষ্টু নারকেল ভেসে যাচ্ছিল ঘোলা স্রোতে। মা গঙ্গার উদ্দেশেই নিবেদন করেছিলেন হয়তো বা কোনও বিশ্বাসী ভক্ত। পঞ্চাশ পার করে ফেলা পুরুতমশাই নৌকোয় বসেই সেদিকে নীরব অথচ অভিজ্ঞতায়-ভরা এমন উদাসীন দৃষ্টি হানলেন, শশব্যস্ত হয়ে তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট কোমর জলে নেমে নারকেল দুটো উদ্ধার করে আনল।

নৌকোর গলুইয়ে সেগুলি রাখা হল অন্য নারকেলের সঙ্গে। খান দশেক তো হবে। সবই এইভাবে নদীর বহতা ছেঁচে তুলে আনা। এ হল সেই সঙ্গমস্থল– গঙ্গা, যমুনা ও না-দেখতে পাওয়া সরস্বতীর সেই ত্র‌্যহস্পর্শময় পুণ্যভূমি, যেখানে তিথিডোরে ডুবকি দিলে সব পাপ নাকি খণ্ডন হয়। তাহলে একবারের পুজো দেওয়া সামগ্রী পরের বারের পুজোয় কাজে লাগিয়ে দিলে যদি বা পাপের উল্কা জ্বলতে জ্বলতে তিরবেগে ছুটেও আসে আকাশবাতাস কেটে- মাথা এবং আত্মা ভিজিয়ে স্নান করলে সেই সন্তাপও কি ধুয়েমুছে যাবে না?

Advertisement

মকর সংক্রান্তির মহালগ্নের মুখে গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোর আয়োজন এইভাবেই যেন ক্লান্তিহীন ও সর্বাত্মক হয়ে উঠেছে কুম্ভের আনাচেকানাচে। তিরতির করে কাঁপছে বিপুল মনস্কামনা। ব্যক্তির, সমষ্টির।

অবহমানের ইতিহাসেরও কি নয়?

শুধু এক নদীতে দু’বার স্নান করা যায় কি না, একটি মুহূর্তের পুণ্য পরের মুহূর্তে বাহিত হয় কি না – খবরদার এমন প্রশ্ন তোলার দরকার নেই। অর্ধকুম্ভের কাছে আসলে আমাদের অবচেতনই প্রকৃত ঋণী ভাবলে ত্রৈরাশিক মিলে যাবে চট করে।
গৃহী বনাম সন্ন্যাসী দ্বন্দ্বেই কুম্ভের মাহাত্ম্য। এবং চেতনার এই ছিলাটি আজও সমান শৈথিল্যহীন, সমান টানটান।

কাকভোরে এলাহাবাদ স্টেশন থেকে বেরিয়ে যখন অটোয় চেপে যাচ্ছি ‘বুক’ করে রাখা নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে, গেরুয়াজারিত সন্ন্যাসীদের দেখলাম, হনহনিয়ে হাঁটছেন। লোটাকম্বল পিঠে ফেলে, হাতে লাঠি। পায়ে কারও কারও উলের মোজা। গলায় আবছা গানের সুর। কোনও না কোনও আখড়ায় হয়তো আতিথ্য নেবেন। আর না হলে নদীর ধারে, সাদা বালির উপর জল-ছিটিয়ে নরম করা ভূমিতে বসেই দুপুরের রোদ পোহাবেন, আর রাতে সইবেন শীতহাঙর!

দিল্লি থেকে আসা দু’জন সাংবাদিক এমনই জটলা করে বসে থাকা জনা ছয়েক সাধুর ছবি তুলতে গিয়ে ছিটকে সরে এলেন। কী ব্যাপার? এত ত্রাস কীসের? না, একেকটা ছবির জন্য ৫০০ টাকা হেঁকেছেন সন্ন্যাসীরা! অন্তহীন লোভ ও বাসনার কুটিল ছবিতে ভারাক্রান্ত হয়ে যখন ওই সাংবাদিকরা দ্রুত পায়ে হাঁটা দিলেন সামনের দিকে, সাধুদের সম্মিলিত হাসিতে যে প্রীতি প্রতিফলিত হল, তাতে কিন্তু সাংসারিক বিষয়বুদ্ধির বীভৎস ছায়া দেখতে পেলাম না।

শক্ত মুঠোয় ধরে চাবুকটাকে মাঝে মাঝে সজোরে ঘোরাতে হয় এমনিই। অন্যকে মারার জন্য নয়, হিংসা ডেকে আনার জন্যও নয়। কারণটা বরং এই যে, কখনও কখনও আগ্রাসনের স্ক্রিপ্টে আত্মসুরক্ষার মন্ত্র রচনা করা থাকে। সেজন্যই হঠাৎ ফোঁস বিষ ঢালতে উন্মুখদের তফাত রাখে। চাবুকের ঘূর্ণায়মান সপাৎ চামড়ায় পড়লে যন্ত্রণার কালশিটে অবধারিত বুঝে অনেকেই আর বেশি এগোয় না। সূর্যাস্তে নির্মিত শান্তির গৃহ তছনছ করে না।

এদিকে, যমুনার দু’পাশে মাঝিদের উদ্দীপনার শেষ নেই। ‘যাবেন না কি সঙ্গম? চলুন না ঘুরিয়ে আনি প্রথমে, তারপর না হয় যেমন বুঝবেন দেবেন!’ দৃঢ়চেতা গৃহস্থকর্তা তবু আমন্ত্রণে কান দেন না। আরে বাবা, এতদূর তো আসা সঙ্গমের কোলাহল আস্বাদন করতেই। তাই বলে যা চাইছে দিতে হবে? সোজা কাঁটায় তিন আঙুল বুনে আবার উলটো কাঁটা পরিস্থিতি বুনতে থাকে তাঁর মন।

জীবনের অ্যাইসা একটা জম্পেশ স্রোত জমজমিয়ে উদ্‌যাপিত হচ্ছে, এত মানুষের এত ধরনের মুখোশ পরিহিত মুখ– বোঝাই যাচ্ছে না আসল ও নকলের ফারাক! তারই মাঝে গৃহীর প্রবণতা দু’দণ্ডের বাড়তি মোক্ষকামী প্রশান্তির প্রতি। আবার তারই নেপথ্যে সংসারবিমুখ সন্ন্যাসীর ব্যবহারিক বিন্যাসে সুখী গৃহকোণের পুরু সর লেপটে আছে বলে ভ্রম হচ্ছে।

নদী যদিও অষ্টপ্রহর এসব কাটাকুটিই দেখছে। নদী জানে, পৌষমাস কারও সঙ্গী হলে, সর্বনাশের টিকা কাউকে না কাউকে লাগাতে হবে। ‘দিল্লি পাবলিক স্কুল’ থেকে চমৎকার চওড়া রাস্তা কালো পিচের টিপ পরে সরসর করে এগিয়ে গিয়েছে। একসময় গিয়ে তা এলাহাবাদ কেল্লার ঠিক বিপরীত পাড়ে যমুনার ফেরিঘাটে পৌঁছে দেবে। কিন্তু অটোচালকদের দুঃখ, প্রথম শাহি স্নানের আগের দু’দিন প্রশাসন কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। অটো চলবে না। এই বছর বিভিন্ন ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নৌকোর গায়ে গায়ে ব্যাংকের নাম লেখা হবে। অভিনব বিজ্ঞাপন-বুদ্ধি। কোনও নৌকায় ‘এসবিঅআই ’। কোনওটায় ‘এলাহাবাদ ব্যাংক’। কোনওটায় লেখা থাকছে ‘ইউকো’। ব্যাংকের ঠিক করে দেওয়া অলংকরণ শিল্পীই সবটা করে দেবেন। রংতুলি ও শিল্পীর খরচ ব্যাঙ্কেরই। মাঝিদের প্রফিট বলতে, নৌকোগুলি ব্যাংকের টাকায় পালিশ হয়ে গেল। শীতালো রোদে বসে তাই মাঝিমাল্লারা নিবিষ্ট মনে নৌকোয় রং করার তত্ত্বাবধান করেন, ফিটফাট করে তোলেন ভাতঘরটির পাটাতন। সেই সঙ্গে এ দুশ্চিন্তাও ঝেড়ে ফেলতে পারেন না যে, সোম ও মঙ্গল জুড়ে নৌকো জলে না নামানোর খড়্গ নেমে আসছে না তো!

টাইব্রেকারে সেটের নিষ্পত্তি ঘটার আগে টেনিস খেলুড়েরা যে যার সিটে বসে পায়ের পেশিগুলি আরও একবার নাচিয়ে নেন। ঠোঁট চিপে খাওয়া একঢোক জলে ভিজিয়ে নেন জিভ। এলাহাবাদের কুম্ভ চত্বরের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে যে অগুনতি ক্যাম্প ও শিবির গড়ে উঠেছে, তারাও আপাতত এইভাবে শেষ মুহূর্তের পেশি সঞ্চালন করে নিচ্ছে। তাঁবু তৈরির কাজে যেখানে যেটুকু অপূর্ণতা, তা চিতাবাঘের গতিদিব্যতায় সেজেগুজে উঠছে। গৃহী ডুব দিক, বা সন্নিসি- নদী নিরপেক্ষ। আপন বেগে সকলের স্নানোদ্দীপনা ধারণ করে মোহনায় নিজেকে উত্তীর্ণ করতে পারলেই সে তৃপ্ত হবে। চিকচিকে পড়ন্ত রোদ জলের অক্ষরে তা-ই তো লিখছিল, আর আমি ও আমরা, একান্তে ও যৌথে তাই তো পড়ছিলাম। পড়ছিলাম। আর পড়ছিলাম। ও হ্যাঁ। আরও একটা কথা। শুনেছি কুম্ভদর্শনে নাকি ভারতের দর্শন হয়। বিশেষত, যে-ভারত কনভেন্ট উচ্চারণের ‘ইন্ডিয়া’ নয়। তা, সেই ভারতও দেখলাম বইকি! মেলাপ্রাঙ্গণে ডাইনে-বাঁয়ে অনেক মোবাইল পাবলিক ইউরেনাল। এবং সেসবই পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট। মেল অনলি। মেয়েদের জন্য তেমন ব্যবস্থা নেই। ন্যাচারালি, সনাতন নিয়ম!

[বিতর্ক এড়াতে সরকারি ‘উপহার’ ফেরালেন বিচারপতি সিকরি]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement