চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায়, আসানসোল: দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আর মর্যাদার প্রতীক হল জাতীয় পতাকা। ভারতের ত্রিবর্ণ জাতীয় পতাকার ইতিহাস নিয়ে পাঠ্যবইয়ে যা নেই তা আছে আসানসোলের কালীশঙ্করবাবুর বাড়িতে। কালীবাবুর অপ্রকাশিত বিশাল গবেষণা থেকে ভারতবর্ষের পতাকার বির্বতনের কথা এই বিশেষ প্রতিবেদনে।
জীবনের ৭৯টা বসন্ত পার করে এই বিষয়ে ডক্টরেট হয়েছিলেন কালীশঙ্কর ভট্টাচার্য। প্রাক্তন রেলকর্মী তথা কালী স্যার থাকতেন আসানসোলের গোপালপুরে। সারা বিশ্বের পতাকা নিয়ে তাঁর অদ্ভুত আগ্রহ, গবেষণা। দেশ বিদেশের জাতীয় পতাকা, ধর্মীয় পতাকা, রাজনৈতিক পতাকা মিলিয়ে ৪২২টি পতাকার ইতিহাস ও সন্ধান ছিল তাঁর গবেষণাধর্মী রিপোর্টে। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি পতাকার মতো বিষয় নিয়ে প্রথম গবেষণা করে ডক্টরেট হয়েছিলেন। ভারতের জাতীয় পতাকার প্রস্তাবিত ও গৃহীতরূপ নিয়ে আলোকপাত করেছিলেন। ভারতবর্ষের প্রস্তাবিত ও উত্তোলিত জাতীয় পতাকার বিবর্তন হয়েছে ১৭ বার। গবেষণার সেই মডেল পতাকাগুলি সংরক্ষিত রয়েছে কালীশঙ্করবাবুর বাড়িতে।
ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকার প্রবর্তন হয়েছিল ১৮৮৩ সালে। জাতীয় কথাটির উদ্ভবও হয় সেই প্রথম। সাদা বর্গাকার পতাকার মাঝে ছিল রক্তিম সূর্য। লাহোর নিবাসী শিরিষচন্দ্র বসু কর্তৃক এই পতাকাটি প্রস্তাবিত হয়। ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট জাতীয় পতাকা প্রথম তুলেছিলেন অনুশীলন সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কলকাতার পার্সি বাগান স্কোয়ারে পতাকাটি উত্তোলিত হয়েছিল। ওই একই দিনে কলকাতার স্বদেশী আন্দোলনকারীরা ধর্মতলা পার্কে গর্ভনর হাউসের সামনে গোপনে পতাকাটি উত্তোলন করে এসেছিলেন। পতাকার রং ছিল ত্রিবর্ণ। উপরে লাল, মাঝে হলুদ এবং নীচে সবুজ। লাল বর্ণের উপর আঁকা অষ্টবৃন্তের আটটি কুসুম। হলুদের উপর সংস্কৃতে লেখা ছিল বন্দেমাতরম। সবুজের উপর সূর্য ও অর্ধচন্দ্র। ওই একই আদলে চার রকমের পতাকা বিবর্তন হয়। মেদিনীপুরের স্বদেশী আন্দোলনকারীরা যে পতাকাটির প্রস্তাব দিয়েছিলেন তা ছিল লাল-হলুদ ও নীল। আর বাংলায় লেখা বন্দেমাতরঙ। ব্রিটিশ শাসনে আটটি প্রদেশকে চিহ্নিত করতে কখনও প্রস্ফুটিত পদ্ম, কখনও অষ্ট কুসুমকে পতাকার উপরে স্থান দেওয়া হয়েছিল।
১৯০৬ সালে বিপ্লবী সংগঠন যুগান্তর সমিতি পার্টি কংগ্রেসে যে পতাকাটি প্রস্তাব করেছিল তা ছিল লাল রঙের। ঋষি অরবিন্দের ভাই বিপ্লবী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ ও স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবিত পতাকাটি দেখতে ছিল তলোয়ার ও ত্রিশূলের গুণিতক আকারের। উপরে চাঁদ ও নিচে চক্র। দেশের বাইরে প্রথম প্রস্তাবিত ও গৃহীত জাতীয় পতাকাটি উত্তোলন করেছিলেন এক ফরাসী নাগরিক মাদাম কামা। ১৯০৭ সালের ২২ শে আগস্ট জার্মানির স্টুর্টগার্টে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে ওই পতাকাটি উত্তোলিত হয়েছিল। কালীবাবুর গবেষণা বলছে ওই তেরঙ্গার নাম সপ্তর্ষি পতাকা। উপরে গৈরিক মাঝে হলুদ ও নিচে সবুজ। গৈরিকে উপর আঁকা একটি কুসুমের সঙ্গে সাতটি তারা। মাঝে বন্দেমাতরম লেখা এবং নিচে সবুজের উপর সূর্য চন্দ্র।
১৯০৯ সালে ভগিনী নিবেদিতা প্রস্তাবিত জাতীয় পতাকাটি ছিল লাল রঙের। পতাকার মধ্যে বজ্র কুসুম দণ্ড। তার মধ্যে লেখা বন্দেমাতরম। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সেই পতাকাটির ছবি ছাপা হয়েছিল। যেহেতু দধিচির হাড় দিয়ে বজ্র তৈরি হয়েছিল তাই তিনি বজ্রকে ত্যাগের প্রতীক বলে মনে করতেন। আর ভারতবর্ষের মানুষের মন কসুমের মতো। এই চিন্তাধারার পতাকাটি বিভিন্ন চিত্রশিল্পী বিভিন্নভাবে অঙ্কন করেছিলেন। এরপর ১৯১৬ সালে লোকমান্য তিলক ও অ্যানি বেসান্ত হোমরুল লিগে যে জাতীয় পতাকাটি উত্তোলন করেছিলেন সেটি লাল সবুজ স্ট্রাইপের। উপরের বাম কোণে ইউনিয়ন জ্যাকের সিম্বল। পতাকার মাঝে সপ্তর্ষি ও চাঁদ। এটি পঞ্চকোনি অর্থ্যাৎ পাঁচ কোনের পতাকা। বেশ কয়েক বছর এটি উত্তোলিত হয়েছিল।
১৯২২ সালে বিজয়ওয়ারায় কংগ্রেস কমিটির বৈঠকে মহাত্মা গান্ধীর উপস্থিতিতে জাতীয় পতাকার প্রস্তাব হয়। যেখানে ঠিক হয় জাতীয় পতাকায় কোন জাতীয় চরিত্রকে চিহ্নিত করা হবে। পিঙ্গোলি ভেঙ্কাইয়া নামের এক ছাত্র একটি পতাকা বানিয়ে আনেন। যার উপরে লাল, নীচে সবুজ ও মাঝে চরকা। এর পরের বছর কংগ্রেস কমিটির বৈঠকে ওই লাল সবুজ পতাকাটি উলটে দেওয়া হয়। পরিবর্তে নিচে লাল, উপরে সবুজ ও তার উপর সাদা ও মাঝে চরকা আঁকা হয়। এই প্রথম সর্বধর্ম সমন্বয়কে মাথায় রেখে জাতীয় পতাকা তৈরি হয়। এর প্রণেতা স্বয়ং গান্ধীজি। লাল এখানে বৃহত্তর হিন্দু ধর্ম যারা সমস্ত ধর্মকে বহন করবে। তাই নিচে। উপরে সবুজ মানে মুসলিম সম্প্রদায় ও তার উপরে সাদা মানে সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। ১৯২৩ থেকে ৩০ সাল পর্যন্ত এই পতাকাটি উত্তোলিত হয়েছিল। ১৯৩১ সালের ৬ আগস্ট জাতীয় পতাকার রংয়ে ফের বদল। উপরে গৈরিক। মাঝে সাদা এবং নিচে সবুজ। আর মাঝে চরকা। ১৯৪৭ সালের ২২ আগস্ট চরকার পরিবর্তে সারনাথে যে অশোক চক্রটি রয়েছে সেই ২৪ স্পোকের চক্রটি নীল রঙের আঁকা হয়। অশোকের চক্রটি নেওয়ার অর্থ অশোক বিশ্বজয় করেছিলেন অহিংসা দিয়ে তাই। জওহরলাল নেহেরুর পছন্দ হয়েছিল এই ভাবনাটি। তাই মান্যতা পায়।
দেশ বিদেশে সমাদৃত হয়েছেন কালীশঙ্করবাবু। কিন্তু এই রাজ্যে তাঁর সম্মান পাননি। মেলেনি কোনও সরকারি সম্মান। সেই অসম্মানের অন্ধকারে থেকেই চলে গিয়েছেন তিনি। তবে তাঁর এই সম্পদ এখনও সাজানো রয়েছে আসানসোলের বাড়িতে। তাঁর ছেলে-বউমা চাইছেন, কালীশঙ্করবাবুর গবেষণা তুলে ধরা হোক আন্তর্জাতিক মঞ্চে। তাঁর গবেষণাকে স্বীকৃতি দিক সরকার।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.