দেবশ্রী সিনহা, নয়াদিল্লি: অনাহারে তিন শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় রাজধানী দিল্লিতে এবার নতুন জলঘোলা ‘রেশন কার্ড’ নিয়ে।
পূর্ব দিল্লির যে এলাকায় টানা আটদিন অভুক্ত থেকে মৃত্যু হয়েছে একই পরিবারের তিন শিশুর, সেই মন্ডাবলি ও সংলগ্ন এলাকায় কোনও বাসিন্দারই রেশন কার্ড নেই। শুক্রবার সেই খবর জানাজানি হওয়ার পরই দিল্লির শাসক দল আম আদমি পার্টির বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে বিজেপি। একদিকে আপ ও মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আক্রমণ শানিয়েছেন মনোজ তিওয়ারিরা। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ানের দপ্তর রিপোর্ট তলব করেছে দিল্লি সরকারের কাছে। চাপে পড়ে আইসিডিএস-এর কাছে বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট চেয়েছেন দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়া। সব মিলিয়ে রাজনীতির ঘোলাজলে ক্রমশ চাপা পড়ে যাচ্ছে শিশুমৃত্যুর মূল ঘটনাটাই।
সোমবারের মৃত্যুর এই ঘটনা বুধবার জানাজানি হওয়ার পর পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপের গোলাবর্ষণ শুরু হয়ে গিয়েছিল আপ ও বিজেপির মধ্যে। আর সেই কাদা ছোড়াছুড়ির মধ্যেই শুক্রবার জানা গিয়েছে, রাজধানীর ঝাঁ-চকচকে অভিজাত ইন্দ্রপ্রস্থ এক্সটেনশনের পিছনে ওই সাকেত ব্লক-সহ গোটা মন্ডাবলি এলাকার বাসিন্দাদের কারওরই কোনও রেশন কার্ড নেই। নেই, কারণ সেই কার্ড পেতে গেলে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিতে হয় বাবুদের। সেই ‘রেশন কার্ড না থাকা’-কেই অনাহারে মৃত্যুর জন্য দায়ী করছে বিজেপি।
[আরও আধুনিক হচ্ছে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ, উর্দিতে বসছে ক্যামেরা]
রেশন কার্ড নিয়ে স্থানীয় মহলে ক্ষোভ যে যথেষ্ট, তা এদিন স্পষ্ট হয়েছে মন্ডাবলির বিভিন্ন পাড়ায় ঘুরে। যেমন সাকেত ব্লক ১৪ নম্বর গলির বাসিন্দা কবিতা। তিন সন্তানের মা এই মহিলা থাকেন নারায়ণের ঘরের পাশের ঘরেই। স্বামী সামান্য কাজ করেন একটি কারখানায়। সংসার চালাতে আশপাশের বিভিন্ন বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন কবিতা নিজেও। রেশন কার্ডের প্রসঙ্গ তুলতেই শীর্ণ মুখ আর চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠল। ঝাঁজিয়ে বলে উঠলেন, “কীসের রেশন কার্ড? এখানে আমাদের কারওরই রেশন কার্ড নেই।” কেন নেই, জানতে চাওয়ায় কবিতার সাফ জবাব, “কার্ড বানানোর চেষ্টা করিনি ভেবেছেন? কিন্তু বাবুরা হাজার কিসিমের কাগজ চায়। না হলে মোটা অঙ্কের টাকা। অত টাকা কোথায় পাব আমরা? এমনিতেই দু’জনে দু’বেলা খেটে যা আমদানি, তাতে কোনও রকমে সংসারটুকু চলে। বাবুদের ঘুষ দেওয়ার টাকা কোথায়?”
কবিতার গলার সুরই দোতলা এই বাড়ির প্রতি বাসিন্দার। এঁদের কেউ রিকশা চালান। কেউ বা পরিচারিকার কাজ করেন। কেউ কারখানার মজুর। দিন আনা দিন খাওয়া পরিস্থিতি সবারই। রেশন কার্ডের জন্য সরকারি বাবুদের হাতে গুঁজে দেওয়ার টাকা আসবে কী করে? তাই কারওর কাছেই রেশনকার্ড নেই। স্বাভাবিকভাবেই এসব ক্ষোভ-বিক্ষোভকে পুঁজি করে রাজনীতির ফায়দা তুলতে নেমে পড়েছে বিজেপি। এদিকে ঘটনার পর চার দিন কেটে গেলেও এখনও খোঁজ মেলেনি মৃত শিশুদের পিতা মঙ্গলের। তাকে খুঁজে বার করার জন্য বিশেষ টিম গড়েছে দিল্লি পুলিশ।
[‘দূষিত’ গঙ্গার পাড়েও বিধিসম্মত সতর্কীকরণের ভাবনা পরিবেশ আদালতের]
এদিকে ঝাড়গ্রাম থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানাচ্ছেন, বোনকে ফিরে পেতে প্রশাসনের সাহায্য চাইছে মঙ্গলের স্ত্রী বীণার পরিবার। যদিও ‘বীণা’ নয়, পরিবারের দাবি তাঁদের মেয়ের নাম ‘বেণু’। ঝাড়গ্রাম জেলার সাঁকরাইল ব্লকের আঁধিরিয়া অঞ্চলের উপর কাঠমুন্ডি গ্রামের বাসিন্দা বেণু সিংয়ের তিন দাদা কাজল সিং, রতন সিং ও পুলিন সিং বোনকে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য চাইছেন জেলা প্রশাসনের। বেণুর বড় দাদা কাজল এখনো বুঝতে পারছেন না যে দিল্লির মতো জায়গায় না খেতে পেয়ে তিন শিশুকন্যার মৃত্যু আদৌ কী করে সম্ভব! এদিন কাজলবাবু ফোনে জানান, তিন মাস আগেও ফোনে তাঁর বোনের সঙ্গে কথা হয়েছিল। কিন্তু বোন যে মানসিক ভারসাম্যহীন বা তাঁদের সংসারে অভাব রয়েছে তা কখনই বুঝতে পারেননি।
কাজলবাবু জানিয়েছেন, ২০০৮ সালে পাশের গ্রামের এক পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে উত্তরপ্রদেশের মথুরার বাসিন্দা মঙ্গলের সঙ্গে বেণুর বিয়ে ঠিক হয়। তখন মঙ্গল দিল্লির হোটেলে কাজ করতেন। বিয়ের পর বোনের সঙ্গে মেজদা রতন দিল্লি গিয়েছিলেন। কিছুদিন পর ছোটভাই পুলিন দিল্লিতে বেণুদের কাছে দু’বছর থাকার পর গ্রামে ফিরে এসেছিলেন। ২০১২ সালে বেণু এবং মঙ্গল এক শিশুকন্যাকে নিয়ে শেষবারের মতো সাঁকরাইল ব্লকের উপর কাঠমুন্ডি গ্রামে ফিরেছিলেন। বেণুর ছোট দাদা যখন দিল্লি গিয়েছিলেন, তখন মঙ্গল ছোট্ট একটি চায়ের দোকান চালাতেন। থাকতেন দোকানের পিছনেই। বোনের সঙ্গে কাজলবাবুদের ফোনে যোগাযোগ ছিল। কাজলবাবু বলেন, তিন মাস আগেও বোনের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। কিন্তু কখনওই মনে হয়নি ওর মাথার কোনও সমস্যা রয়েছে। বুঝতে পারছি না, কী করে তিনটি বাচ্চা মারা গেল? কী অবস্থায় বা বোন এখন আছে? আমরা চাইছি বোনকে ফিরিয়ে গ্রামে আনতে।
[পচা আলুর সঙ্গে খারাপ জল, শহরে ফুচকা বিক্রি বন্ধের নির্দেশ]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.